গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৪

সিদ্ধার্থ শর্মা

"যানা কাহা ম্যাডাম?


প্রতিদিনের মতো কুয়াশা সরিয়ে দিল্লীর পথে এক চিলতে রোদের হাসিমুখ । প্রতিদিনের মতই পারিবারিক প্রয়োজন মিটিয়ে - সকালের ব্রেকফাস্ট গুছিয়ে রেখে , মেয়েকে তৈরী করে উর্ধশ্বাসে বেরিয়েছে ঝিলিমিলি । দাঁতে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাসের অপেক্ষায়। সকাল বেলা তখনো দিল্লীর ব্যস্ততা জমে ওঠেনি। চোখের সামনে তিনি এক অটোয়ালাকে দেখতে পেয়ে তাকে ডেকে চেপে বসে। কিছুটা সময় তো তার একান্ত নিজস্ব। ঝিলিমিলি নাম টা ওর নিজের নাম নয় । বাস্তবের আঘাতে যখন সে স্বপ্ন দেখতে প্রায় ভুলেই গেছে সেই সময় অকস্মাৎ স্বপ্নের সেই কিশোর হাজির । বড্ড দেরী করে ফেলেছে সে - মনে মনে ভাবে ঝিলিমিলি। কিন্তু বড্ড জেদী স্বভাবের এই অজানা মানুষটা । ওর জেদটা টের পায় যখন 'একটা আনকমন নাম দিও " একে অগ্রাহ্য করেই ঝিমলি ঝিলিমিলি স্বপ্ন আঁকতে থাকে ওর-ই রঙ মেখে। ঝিলিমিলি আধার কার্ড করাতে গিয়ে এই সেদিন। "আপনার নাম? " - "ঝিলিমিলি" বলেই জিভ কাটে বৈশাখী সেন। ইশ! " আমি আমার মত থাকতে চাই " এই মনে স্বপ্ন কি পাকাপাকি ভাবে দখল নিতে চাইছে? সাবধানী হতে গিয়েও সাবধানী হওয়া ভারী মুস্কিল। বৈশাখী ঝিলিমিলি জলতরঙ্গেই বাজতে চায় যে মন।
না এর পরের প্রশ্নগুলির উত্তরগুলো সঠিক ভাবেই উচ্চারণ করে সে বাস্তবে ফিরে এসে। কিন্তু সাথে সাথেই নিজের মত একটা উত্তর গুছিয়েও ফেলে অজান্তেই।

-আপনি কী করেন ম্যাডাম? -আমি স্কুলে পড়াই, ক্লাস নেই, ছাত্র ছাত্রী পড়াই। (আমি স্বপ্ন দেখি। আমি ভালোবাসি। আমি তারা দেখি - অভিমান করি "সে কেন আসেনা - সে কেন থাকেনা আমার সাথে সবসময়") একরাশ বিস্ময়ে হতবাক ঝিলিমিলি। কী এক ছোঁয়ায় তার জীবন কেমন করে বদলে যায়, বুঝতে পারেনা - বুঝতেও মন চায়না - মন চায় শুধু মেঘ হতে - শুধু ওকে ভেজাতে। ইচ্ছেটা পেয়ে বসে 'একদিন গিয়ে স্বচক্ষে দেখলে হয় রাতজাগা তারা হয়ে চাঁদের ঘরণী হয়ে কেমন লাগে!'

কথাগুলো বলতে বলতে নিজেকেই বলতে বলতে অটোওয়ালা চলে এল গন্তব্যে। এতক্ষণ ঝিলিমিলি তন্ময় হয়ে ভাবছিলো এক অজানা অচেনা মানুষের ফিসফিসিয়ে কানের পাশে এসে বলে যাওয়া কথাগুলো। ইচ্ছে করছিল সেই মানুষটাই যদি হোত এই অটোওয়ালা - জিজ্ঞাসা করত "যানা কাহা ম্যাডাম?"

ভাড়া মিটিয়ে তার চেহারায় এক পলক তাকিয়ে দেখে, আরে সত্যিই তো এই লোকটাই যদি সেই লোকটা হোতো ! হতেই পারতো - তার তো কোনো দ্বিধা নেই, নেই সংকোচবোধ, কোন এক অপার্থিব বিভোরতা মিশে আছে তার চেহারায়, দরদমাখা মায়ার আবেশ তার কথায়, ঝিলিমিলি ভাবনার গভীরে ডুবে থাকতে চাইল সারাটা দিন। মনে করতে চাইল সে এসেছে ক্লাসে বাধ্য ছাত্র হয়ে। ঝিলিমিলি আজ পড়াচ্ছেও গভীর মমতায় ভালবাসার চোখ দিয়ে। সে যে দেখছে তাকে দুচোখ মেলে।
রাত গভীর হলেই শুরু হয় তার বয়ান। সাদামাটা কথা, যুক্তির বাইরে, বাছবিচারের বাইরে, ভড়ংহীন, বাহাদুরি না দেখানো অথচ এক অমোঘ আকর্ষণ - কেমন নীরব হয়ে শুনে যেতে হয় কথাগুলো, কারো চেহারার একটা অস্পষ্ট আভাস, কল্পনার এই স্বপ্ন পুরুষ। চোখের সামনে কখনো তার হাসিমুখ কখনো চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া আনন্দাশ্রু। কখনো বা ঢেউ খেলানো মাদকতা।

ঝিলিমিলি কেমন যেন আবিষ্ট, অজান্তেই প্রভাবিত হয়ে যায় এই পরিবেশে এসে। তার ভেতরেও তাড়না তাড়িত করছে তাকে, শুধু নিজের অপ্রাপ্তি নিয়ে বসে থাকলেই কী হবে? কত মানুষ নিজেকেই জানেনা, ভুলে বসে আছে আপন পরিচয়, ছুটে যাচ্ছে দেখাবতের দুনিয়ার দিকে, কিন্তু শান্তি কি আসে এতে? নিজেকে কি বোঝা হয় ? না জীবনের বোঝা ক্রমশঃই আরও ভারী বলে বোধ হয়? আলাপী সন্ধ্যা ধুসর আস্তরণে ঢেকে যাওয়া চাঁদ - ধুলিমলিন চিলেকোঠা ছাদ তবুও দিতে চায় আশ্রয়।

এসব ভেবে আনমনা হয়ে যায় ঝিলিমিলি। বারবার তার মনে পড়ছিল ঐ মন লিখিয়ের কথা। তার মায়াবী অস্পষ্ট মুখখানা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। কেন এত দেরী করে এলো সে? কেন সে দেরী করে আসে? এই অপেক্ষা ঝড় হয়ে সে আসুক - নিমেষেই উড়িয়ে নিক মনের ঝরাপাতা - সে আসুক পৌরুষ দাবি নিয়ে - তছনছ করে দিক - তছনছ হতে ইচ্ছে পেয়ে বসুক। একান্তে থাকুক প্রজাপতি হয়ে মৌফুলে - ভুলে যাক তার আছে ডানা - লেপ্টে থাকুক একটুও না নড়ে শুধুই মিশে।

সময় গড়িয়ে যায়। ঝিলিমিলির স্কুল শেষ। ফিরে যেতে হবে তাকে আবারও সংসারে। কিন্তু আজ যে এই সংসারটা কেই বড় সুন্দর মনে হয়। সাথী করতে চাওয়া ভালবাসার মানুষটির, সংসারের মানুষগুলির অবহেলা প্রত্যাখ্যান, ভুল বোঝা সব-ই যে মনে হয় আজ তুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া তলে টুপ টুপ জলে ভেজা ওই স্বপ্ন কিশোরের মনোবন্দিনী হয়ে - মনে হয় বড়ই আপন। ভালবাসতে শুরু করেছে ঝিলিমিলি মিঠে গালে যার দরদমাখা না কামানো দাঁড়ির খোঁচা তাকে কৌতুহলী করে তুলছে সংসারে স্বপ্ন বুনতে - আসেপাশের সব মানুষগুলিকেও ইচ্ছে করছে স্বপ্ন দেখাতে - ইচ্ছে করছে সাথী করতে - গড়তে ইচ্ছে করছে সংসারের মধ্যেই এক স্বপ্ন সংসার । স্বপ্নের ছোঁয়ায় নিজের জীবন শুধু নয়, যেন বদলে যায় অসংখ্য সাথী জীবন। সে ইচ্ছেটা নিয়ে ঝিলিমিলি এগিয়ে যাচ্ছে সীমানা পেরিয়ে।

অটোওয়ালাকেই ভাবতে ইচ্ছে করলো সেই স্বপ্ন পুরুষ । ঝিলিমিলি চোখ খোঁজে ভীড়ের মাঝে সেই অটোওয়ালার দুটো চোখ "যানা কাহা ম্যাডাম? "