গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৪

সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী

মুসাফিরনামা

-
"রাস্তা"
ব্যাস এই মাত্র ছোট্ট একটা শব্দ আমার সকাল দুপুর সন্ধে রাত্রি বদলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। অন্যদিন সকালের রোদ যখন জানলা দিয়ে ঢোকে চোখ খুলেই একের পর এক কাজের মিছিল। মেশিন টা সেই যে চালু হয়ে যায়, থামে এক্কেবারে সেই মাঝরাত্তির পেরিয়ে। গতের অনুগত এই প্রাত্যহিকী নিজের মানুষ জাতের চিহ্ন গুলো মুছে ফেলে যান্ত্রিক ছাপ দেগে দিতে সদাই সচেষ্ট।
তাহলে? দুত্তোর সংসার। সেই জন্ম থেকেই যাযাবর আমি। আজ পর্যন্ত একটানা দশ বছর কোথাও থাকিনি। থাকতে পারিনা। নতুন বাড়ি, নতুন মুখ, নতুন কাজ, নতুন আনন্দ। হ্যাঁ, কাজও ছেড়েছি একের পর এক। জায়গাও। চলো মুসাফির বাঁধো গাঁঠোরি রাস্তা বহুত দূর হ্যায়।
কাল যখন বেরিয়ে পড়লাম, ভাবলাম খুব তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্যে মাথার দিব্যি তো কেউ দেয়নি। কিন্তু স্বভাব চিমটি! আস্তে চলার অভ্যাস টাই রপ্ত হয়নি। একশো / একশো কুড়ি তে ছুটতে গিয়েই হোঁচট। আমাদের জাতীয় সড়ক গ্রামের কাদাভরা ভাঙাচোরা রাস্তা কেও লজ্জা দেবে। কোথাও কোথাও তো রাস্তাই নেই। পিচের চিহ্ন দূর অস্ত, খোয়া আর বিশাল বড় বড় গর্তে নাচতে নাচতে তা তা থৈথৈ। আহা কি আনন্দ রাস্তায় রাস্তায় ...

তিলপাড়া ব্যারেজের প্রায় ছ সাত কিলোমিটার দূর থেকেই লম্বা যানজট। বড় বড় লরি নিশ্চিন্তে মাল ঘাড়ে নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে একটু নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়েছে। -কি ব্যাপার দাদা? উত্তর চাওয়া যার কাছে তার চোখ ওপরের দিকে। যোগী ফকিরের দেশে নির্মোহ নিস্পৃহ হওয়া টা মনে হয় জিন্মগত (জন্মগত ও নিশ্চিত)।
একজন বললে, হাতি মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। শুনেই দুমকার এক তিলক পড়া ব্যবসায়ী, ঘুরে গেলে কিতনা নাফা, কিতনা ঘাটা আঙুলে হিসেব করেই মুখ ঘুরিয়ে দে দৌড়। কব খুলেগী ইয়ে জামওয়া কওন জানে? অতএব মুখ ঘুরিয়ে সিউড়ি র ভয়ংকর সরু আর থিকথিকে মানুষ, গরু, ছাগল, বাস, লরি, গাড়ির গলির মতো বাজারি পথ ভরসা হি কেবলম।

মাঝে মাঝে মন কেড়ে নেওয়া মাঠের পর মাঠ, উদাস হু হু দিগন্ত। নাম জানা আর না জানা অজস্র গাছের সারি। গ্রামের সরল সজীব সন্তান সেই অপুর সময় থেকে এখনো ঠিক সেইরকমই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আর যাই হোক, চালাকি টা এরা এখনো শেখেনি। ছোট্ট ছাগলের বাচ্চা, মন্থর গতিতে হেলেদুলে চলা সেই মৌর্য যুগের গরুর গাড়ি, রাস্তার ওপরে বিছানো সোনালি ধান কে পাশ কাটিয়ে গন্তব্যে যখন পৌঁছলাম, সূর্য হেলে পড়েছে তার অন্য শিফটের ডিউটির পথে।
আজকের মতো ক্ষান্তি এই মফস্বল গঞ্জ শহরে। যেখানে মানুষ থাকে মানুষের মতোই। এখনো তারা পাস্তা খেতে কিম্বা অন্যের মোবাইল এ অশ্লীল মেসেজ পাঠাতে শেখেনি। এখনো ময়ূরাক্ষী এখানে বয়ে চলে কবিতার অন্তর্ছন্দে, মনমাতাল হাওয়ার দ্বৈতসঙ্গীতে।