গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৪

সুজাতা ঘোষ

২০১২ পেরিয়ে

                                                 ১

       কিসের শব্দ ? বাজ! চিরধরা তীব্র শব্দ বুকের উপর সজোরে আঘাত করে চলেছে  ক্রমান্বয়ে। শাবলের ফলা ক্রমশ এগিয়ে  আসছে আমার বুকের উপরে জোরে আরও জোরে।

       মনে হয় বহু যুগ পেড়িয়ে কোন শব্দ ছুঁতে চাইছে আমার শুয়ে থাকা স্তব্ধ শরীর আর অনুভূতিকে। কিন্তু কৌতূহলী মানুষের শব্দ যান্ত্রিক শব্দকে ভেদ করে এগিয়ে আসছে তাদের হাত বাড়িয়ে আমাদের দিকে। আমি শুধুই অনুভব করতে পারছি। আমার স্তব্ধ, শ্রান্ত শরীরের উপর তাদের কঠিন হাতের কৌতূহল আমার সারা শরীর বেয়ে ওঠা নামা করছে।

       আমাকে উপরে তুলে মাটির উপর শোয়ানো হচ্ছে সযত্নে।  এবারে কিছু অল্প   বয়সী ছেলে মেয়ে হাতে ব্রাশ নিয়ে আমার শরীরের আনাচে কানাচে লেগে থাকা, জমে থকা সমস্ত ভূমণ্ডলীয় ধুলো ঝেড়ে আমাকে বোঝার চেষ্টা করছে, ঠিক কত যুগ আগের মানুষ এমন দেখতে হবে। আমার দুচোখ এখনো খোলা, সেদিনের পর আর বোধ হয় বন্ধ হয় নি। ওরা আমার চোখেও ব্রাশ লাগাবে না - কি? এতো মহা জ্বালা হোল। আমিও তো ওদের মতোই একটা মানুষ। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে আমার শরীরের যত্রতত্র ধুলো ঝাড়া শুরু করেছে !

                                               ২

      ওফ  আবার কে এল? অনেক ঝড় ঝাপটার পর এই কাঁচের ঘড়ের ভিতর উঁচু টেবিলটাতে আমার শরীরটা টানটান করে ফেলার সুযোগ হয়েছে। এতক্ষণ তো সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল, কেউ কেউ সুযোগ হাতছাড়া না করতে চেয়ে ছুঁয়েও দেখেছে। আবার কেন? কে বোঝাবে ওদের, মুখের উপর অত বড় একটা আলো ঝুললে ঘুমনো যায় না! এ যুগের মানুষরা ঘুমায় না, না – কি? 

       লোকটা কিছু জিনিস বের করে নিল আলমারি থেকে, দুবার আমার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ঘড় থেকে। অনেক ধ্যন্যবাদ, যাওয়ার আগে আলোটাকে নিভিয়ে গেছে। কি অদ্ভুত না! আলোর দিকে তাকিয়ে যেই চোখ বন্ধ করল, অমনি আলো নিভে গেল। বাঁচা গেছে, এবার একটু একা থাকা যাবে। ঘুম আসবে না, কতযুগ ধরে যে ঘুমিয়ে আছি কে জানে। এটা কত সাল?

       ২০১২, বছরের শেষ দিন, সবাই মিলে জমিয়ে পার্টি চলছে শীতের রাতে। বড়দিন ২৫শে ডিসেম্বর থেকেই মোটামুটি নানা রকম জল্পনা – কল্পনা শুরু করে দিয়েছিলাম, কিভাবে ৩১শে ডিসেম্বরটা কাটাব। এত উত্তেজনা ছিল যে ভাবা যায় না। অন্যান্য বছরের চেয়ে আলাদা, কারন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, এই দিনটা নাকি পৃথিবীর শেষ দিন। এর পরে নাকি আর কিছুই থাকবে না আমাদের চারপাশে। এমনকি আমরাও না। শেষ দিন বলে না, আসলে ২০১৩ কে স্বাগত  জানাতে চেয়েছিলাম অনেক আশা আর ভবিষ্যৎ বিষারদদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। কোলকাতা পৌঁছে গেছিলাম বাঙ্গালুরু থেকে, নিজের লোকদের কাছে গিয়ে ২০১৩ কে অভিনন্দন জানানোর জন্য।

       সারা রাত, সেই সন্ধ্যে থকে সে কি আনন্দ, ভাবা যায় না! সমস্ত বন্ধু – বান্ধব, আত্মীয় – স্বজন সবাই মিলে প্রচণ্ড আনন্দ, হৈ – চৈ, নাচ – গান, খানা – পিনা ------ ওফ, ভাবা যায় না।

       আমরা সকলে উদ্মাদের মত আনন্দকে জড়িয়ে ভেসে এসেছি ২০১২ র হাত ধরে নতুন বছরকে আমন্ত্রন জানাতে। ঠিক এক মিনিট বাকি রাত ১২ টা বাজতে, হঠাৎ করে মনে হোল ডান্স ফ্লোরটা কেঁপে উঠল। আমরা একটু থমকে আবার নাচার জন্য পা বাড়াব, অমনি কেমন যেন সব ওলট – পালট হয়ে গেল; সমস্ত মানুষ ছিটকে এদিক ওদিক হয়ে গেল যেন কেউ রেগে গিয়ে কাঁপ – ডিশ ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। সবাই আমরা দিশাহারা হয়ে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছিলাম। সবই হাতের বাইরে, নিজেরাও আর পৃথিবীটাও। এভাবে সবাই একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে অপরিচিত এক তাণ্ডবের সঙ্গে মোকাবিলা চলছিল, নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য।  

                                                ৩ 

       বহুকাল পেড়িয়ে চোখের পাতা দুটো কেমন যেন বন্ধ হয়ে গেছিল। তাহলে কি আমি ঘুমচ্ছিলাম? তবে এত দিন – এত কাল; ওকি জেগে থাকা, না-কি ঘুমিয়ে থাকা? আমি কি আজও বেঁচে? অবশ্যই, না হলে এ সব কিছু অনুভব করছি কিভাবে? এখন ঠিক কোন সময়? কতগুলো বছর এগিয়েছি আমরা? পৃথিবী যদি  ধ্বংস হয়েই থাকে তবে আমি কি করছি এখানে? আর এই মানুষগুলোই বা এল কোথা থেকে? আবার কি নতুন পৃথিবী ...... নতুন প্রান .........এত তাড়াতাড়ি? কিভাবে সম্ভব? আমি এখন কোথায়? পৃথিবীতে – নাকি চাঁদে – নাকি মঙ্গলগ্রহে? ওফ, মাথাটা কেমন গোল গোল ঘুরছে। ওরা কোথায়? কাউকেই তো দেখছি না, বাড়ির লোকজন, বন্ধুরা ......... সবাই কি আলাদা হয়ে হয়ে গেছে তাহলে! আমি এখানে এভাবে ........., আর ভাবতে পারছি না, কাউকে যে জিজ্ঞাসা করব তারও উপায় নেই। এদের ভাষাও কি পাল্টে গেছে? পাতি বাংলায় জিজ্ঞাসা করব একবার? হ্যাঁ সেই ভাল। মনে হচ্ছে সকাল হয়েছে। জানলা দিয়ে সূর্যের সোনালী আলো আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ঘরের ভিতর।

                                                ৪

              পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে, হ্যাঁ, ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই, সবগুলো হাতে নানা রকম হাতুড়ি, ছেনি নিয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়েছে। এবারে আর ব্রাশ নেই, বাঁচা গেছে;  আরে তাহলে কি এবারে আমাকে মিউজিয়ামে ঝুলিয়ে রাখা ফসিলগুলোর মতন করে শরীর কেটে হাড় বার করবে না-কি? বাপরে বাপ, কি করি? আমার দিকেই তো এগিয়ে আসছে সব।

          বাক্সটা খুলছে চার কোনা থেকে। আমি এখন বন্দিদশা থেকে খোলা হাওয়ায়। বেশ গরম হচ্ছিল এখানে। আঃ কি আরাম, কেমন বেশ একটা ফুঁড়ফুঁড়ে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে আমার শরীর বেয়ে। কেমন সুড়সুড়ি লাগছে, আঃ ............... আঃ ............ হাসি পাচ্ছে আরামে। আরে, আরে, একি; আমার সমস্ত পোষাক খুলে ফেলছে যে। কোন বুদ্ধি-সুদ্ধি নেই নাকি। কেমন নির্লজ্জের মতন তাকিয়ে আছে দেখ আমার দিকে। সবচেয়ে বয়স্ক ভদ্রলোকটি ভিতরে আসতেই সবাই হাতে কাগজ আর কলম তুলে নিয়ে কি যেন লিখতে শুরু করে দিল। আমার দিকে দেখছে আর লিখছে, এবার ফিতে এনে মাপতে শুরু করল বছর তিরিশের একটি ছেলে। কি অস্বস্তি ......... মাথার চুল থেকে পায়ের নখ প্রর্যন্ত সমস্ত বিষয়ে ফিতে দিয়ে মেপে মেপে মুখে বলল আর সবাই মিলে লিখল।   

       এক সময় ছোট বেলায় আমার ফ্যাশন শো তে একেবারে সামনে দাঁড়ানোর ইচ্ছা ছিল। সে অনেক দিন আগের কথা, খোলা মেলা পোষাকে নিজের ঢেউ খেলান সুন্দর চেহারাকে উন্মুক্ত করে সকলের সামনে তুলে ধরতে। তখন সবে বারো ক্লাস পাস করেছি। সে স্বপ্ন পূর্ন হয় নি বাবার মারের ভয়ে। আরে, কি করছে কি? আমার পা দুটো উপরে তুলে দিচ্ছে কেন? কি লিখছে? আঃ, এত জোরে কেউ পা দুটো ফেলে? এবারে উপরের দিকে এগিয়ে আসতেই ......... আমি অনুভব করছি দৃঢ়, বলিষ্ঠ সুপুরুষটির হাত, কাঁধ, নাক, চোখ............ ।

       ওরা চলে যাচ্ছে, অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা করে, লেখালেখি করে। আমাকে টেবিলের উপর ফেলে রেখে একে একে সবাই বেড়িয়ে যাচ্ছে ঘড় থেকে।
       আমি স্থির হয়ে তাকিয়ে আছি ঐ মানুষটার দিকে, যার আঙ্গুলগুলি ঢেউ খেলে গেছে আমার সমস্ত শরীরে। আর শিরা - উপশিরায় বয়ে গেছে তিরতির করে  কাঁপানো সেই বহু পুরনো উত্তেজনা।
            
        এত সময় ধরে পৃথিবীর ভূগর্ভস্ত লাভার ভিতর পড়ে থেকে আছি আমি,  আজও বেঁচে আছি একই ভাবে সেই ২০১২র শেষ দিনের মতন। কোন পরিবর্তন  নেই আমার শরীর আর মনের ভিতরের। এবারে বুঝলাম, প্রাকৃতিক কোন সৌন্দর্যের কেন পরিবর্তন হয় না। হয়ত নিয়ম মতন আমার বয়স বেড়েছে, কিন্তু, আজও আমি সেই একই মানুষ যা ছিলাম ২০১২তে। আচ্ছা, ওরা কি বুঝতে পারছে না, আমি বেঁচে আছি। সব কিছু অনুভব করতে পারছি। হ্যাঁ, চোখ দুটো আমার প্রায় স্তির হয়ে থাকে, ওদের সামনে প্রায় বন্ধ হয়না বললেই চলে। কিন্তু আমার শরীর,  সে তো সেই আগের মতনই নরম পাপড়ির মতনই আছে। আমার এই অনুভূতি, যখনই সে এসে দাঁড়াচ্ছে, তখনই কেমন যেন আমি ভয়ে কাঁপছি ভিতর থেকে। সে
কি বোঝে?
                                                  ৫

       আমাকে ব্যালকনির ধারে গাছ পালার সামনে বসিয়ে রাখা হয়েছে, যেন কোন মডেল। আচ্ছা, আমি কি তাহলে ‘মমি’ হয়ে গেছি? অথচ ভিতরে এখনও প্রান আছে, হ্যাঁ – হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। নাহলে আমি অনুভব করছি কি করে। প্রেমও আছে বেঁচে। না হলে তাঁর স্পর্শে .........সে কি বোঝে?  
         বাইরেটা এখনও একই রকম সুন্দর, নাকি আরও বেশি? চাঁদ উঠেছে, আচ্ছা, পৃথিবী ধ্বংস হলে চাঁদ বেঁচে থাকল কিভাবে? ওর ও কি বয়স বাড়ছে? বেশী হলদেটে লাগছে আজকে, তবে কি পূর্নিমা? হবে হয়তো। এদের ভাবগতি ছাতা বুঝি না। কি যে করি। আমার কাঁধে আলতো করে হাত রেখেছে। আমাকে নিয়ে বোধহয় আজ অন্য কিছু করবে। আমার মুখোমুখি বসলেন আমার আকাঙ্খিত সুপুরুষটি দু পা ছড়িয়ে। আমার ব্রেন কাজ করছে, আমি অনুভব করছি শরীরে। চোখের পলক পড়ল এই প্রথমবার ওনার সামনে। লক্ষ্য করলেন কিনা জানি না। পা দুটি যতটা সম্ভব জড়ো করে এক করলাম। আস্তে আস্তে দুহাতে নিজেকে যতটা সম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করলাম। আমার কোন পোষাক নেই, ওদের কাছে আমি এক “ভূগর্ভস্ত বস্তু” ছাড়া আর কিছু নই।

         চকিতে উনি উঠে দাঁড়ালেন, ছিটকে গেলেন দুহাত দূরে, তারপর দৌড়ে  ঘরের ভিতরে। আমি কিছুই বুঝতে পালাম না, ভাবলাম ভয় পেয়ে গেছে। একটু অস্বস্তিতে পড়লাম নিজের জন্যে। চাঁদের আলোটা মেঘ তাড়িয়ে আবার আমার  উপর এসে দাঁড়িয়েছে নির্লজ্জের মতন। পায়ের শব্দ ........., আমার শরীরটা মুড়ে  দিলেন চাদর দিয়ে নিজের হাতে। এবারে আমি মাথা তুলে তাকালাম, প্রথমবার  আমার চোখে চোখ রাখলেন উনি। ঠিক কতক্ষণ মনে নেই, তবে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দুজনেই দুজনকে বোঝার চেষ্টা করলাম। ক্রমশ চোখ আর হাতের আঙ্গুলই হয়ে উঠল আমাদের দুজনের মনের ভাষা। চাঁদটা আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে মেঘেদের হাত ধরে, দূরে ......বহু দূরে।।
                                               ৬ 

       এতক্ষণে সবাই বুঝতে পেরে গেছে যে, আমি একজন মানবী যে ঐ ধ্বংসস্তূপের ভিতর ‘মমি’ হয়ে বেঁচে আছি। আমাকে এখন পোষাক পড়ান হয়েছে, ‘ওনার’ নির্দেশে। আগের চেয়ে একটু মানবিকতার সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান হচ্ছে আমার উপড় দিয়ে। এখনও কাঁটা ছেঁড়া হয়নি দেহের কোন অংশ। বলে রাখা ভালো, আমি এখনো পর্যন্ত ঠিক আগের মতনই প্রচণ্ড আকর্ষনীয় পুরুষদের কাছে।  সবাই আমার খুব কাছে আসুক তা ‘উনি’ যে পছন্দ করছেন না, তা বেশ ভালই বুঝতে পারি মুখের আর হাতের অঙ্গুলির অভীব্যাক্তি দেখে। ভালো লাগছে -----  বেশ ভালো লাগছে, এই অচেনা পরিবেশেও কেউ তো আছে যে আমার মনের কাছে বাস করে।

         দু-একজন  বেশ মিষ্টি দেখতে মেয়েও আছে এদের মধ্যে। একটি মেয়ে তো ঐ ভদ্রলোকের খুব কাছের বলেই মনে হল, অন্তত মেয়েটিকে দেখে তাই মনে হয়। মজার ঘটনা হল, মেয়েটি যখন একাকীত্বে পুরুষটির প্রতি একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চায় তখন উনি আমার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে পড়েন এবং মেয়েটিকে এড়িয়ে যেতে চান, সেটা বেশ বোঝা যায়। কিন্তু কেন? আমি সামনে আছি বলে; নাকি আমার প্রতি ধীরে ধীরে উনি আকৃষ্ট হচ্ছেন বলে?

         মেয়েটি আজ বিরক্ত হয়ে চলে গেছে, বুঝতে পারলাম। উনি বাইরে বেড়িয়ে গেলেন আস্তে করে দরজা বন্ধ করে। কিছুক্ষণ পরে ঘরে ঢুকে আমার টেবিলের সামনে চেয়ারটা টেনে বসলেন। আমার বেশ কাছে। সারাদিনের ক্লান্তির রেশ রয়ে গেছে শার্টের খোলা প্রথম দুটি বোতামে, উস্ক হওয়া চুলে, শুকণো ঠোঁটে আর হালকা ভেসে আসা সিগারেটের গন্ধে।  

         আমি তাকিয়ে আছি শান্ত চোখে, অপেক্ষায় – কিসের তা জানি না। উনিই প্রথম বলে উঠলেন, কিছু কথা, যার অর্থ, আপনি এভাবে এখানে কি করে পৌঁছলেন? এখন ৬০১২ সাল। আমরা এই যুগের মানুষ। আপনি ঠিক কত সালের তা আমরা আন্দাজ করার জন্যই আপনাকে এখানে রেখেছি পরীক্ষাগারে। কিছু কি মনে পড়ছে আপনার? আমি আমার ভাষায় যতটা সম্ভব ওনার কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করলাম। ওনার মুখ দেখে মনে হল, আমার মধ্যেই বহু পুরনো জ্যন্ত একটা ইতিহাস বই পেয়েছেন উনি। এভাবেই আস্তে আস্তে কয়েক দিনের মধ্যে বেশ সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল আমাদের মধ্যে। ক্রমশ অন্যদের এ ঘরে আসা কমতে লাগল, আর উনি সারাদিনই প্রায় আমার রহস্যভেদে জর্জরিত হয়ে পড়লেন। এভবেই বন্ধুত্ব, তাঁর থেকে মন, আর মন থেকে শরীরে ...... ছড়িয়ে পড়তে লাগল আমাদের নতুন দুটি প্রজন্মের মানুষের বিশ্বাস আর ভালোলাগা।
                                        ৭

         অনেক কিছু, আরও অনেক কিছু জানতে গিয়েই আমার সাথে যখন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলেন; ঠিক সেই অসতর্ক মুহুর্তে ওনার হারিয়ে যাওয়া বান্ধবী হঠাৎই ঢুকে পড়েন ঘরের ভিতরে। আমাদের এই অবস্তায় দেখে, প্রথমে বুঝতে পারেন নি বা বিশ্বাস করতে পারেন নি, তার পর মুহুর্তেই রাগে – দুঃখে – অভিমানে সমস্ত জিনিষ পত্র ছুঁড়ে তছনছ করে, শেষে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার উপর। সমস্ত বিষ মন থকে উগরে দেয় আমার শরীরে। ধারালো অস্ত্র যা ছিল আমার শরীরের ভিতরের যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করার জন্য, তা দিয়েই ক্রমশ আঘাত করতে লাগল আমার মুখে,বুকে এবং শরীরের প্রতিটি অংশে। উনি বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেও পারছেন না মেয়েটিকে শান্ত করতে। আমি থরথর করে কাঁপতে থাকি আর চিৎকার করার চেষ্টা করতে থাকি।
                                       ৮

         কি হল? ওঠো, উঠবে না? অনেক বেলা হয়ে গেছে। নতুন বছরের শুরুটা কেউ এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমায়? ওঠো, ওঠো ......, আমি চোখ খুলে তাকালাম। আমার ২০১২র লাইফপার্টনার আমাকে দুহাতের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ঝাঁকাচ্ছে আর বলছে, এখনো ৩১ এর পার্টিটা ভুলতে পার নি? বিছানায় নাচছ কেন থরথর করে? আমি একটু ধাতস্ত হয়ে বললাম – এটা ২০১৩ ? আমার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে ও বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, এটা ১/১/২০১৩, পৃথিবী ধ্বংস হয় নি।
“হ্যাপি নিউ ইয়ার”।

         আমি তা হলে বেঁচে আছি; এই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম “ উইস ইউ এ হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০১৩” ।।