ভেতরের
উঠোন
খাদিজা মাস্তুর
ভাষান্তর: জ্যোতির্ময় নন্দী
[খাদিজা
মাস্তুর (১৯২৭-১৯৮৩) লখনৌয়ের
এক শিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা মহিলা সাময়িকীগুলোতে
লেখালেখি করতেন,
এবং খাদিজা ও তাঁর ছোট বোন হাজিরান দুজনেই নিতান্ত অল্পবয়সেই উদীয়মান লেখিকা হিসেবে
প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। খাদিজার দশ বছর বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যু তাঁদের
পরিবারটাকে চরম আর্থিক দুর্গতির মধ্যে ঠেলে দেয়। তবে তাঁরা ধৈর্য ও সহনশীলতার
সঙ্গে সে-দুঃসময়ের মোকাবেলা করেন। খাদিজা মুসলিম লীগের হয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করতেন।
ভারত বিভাজনের পর তাঁদের পরিবার পাকিস্তানের লাহোরে অভিবাসিত হয়। খাদিজা আর হাজিরা
ছিলেন প্রগগতিশীল লেখকদের তরুণ গ্রুপের সদস্য। অগ্রণী প্রগতিবাদী লেখিকা ইসমত
চুগতাইয়ের অনুপ্রেরণায় খাদিজাও সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকামী নারীদের বিপন্ন, বেদনাপূর্ণ জীবন নিয়ে আবেগের সঙ্গে লিখতে শুরু করেন।
যাঁরা তাঁর লেখা পড়তেন, তাঁরা প্রথম দর্শনে তাঁকে
দেখে রীতিমতো অবাক হতেন-- হালকা-পাতলা, নিতান্ত
সাধারণ, লাজুক, বোরখা
পড়া পরা একটা মেয়ে, যাঁকে তাঁর গল্পের
অগ্নিকন্যা নায়িকাদের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের বলেই মনে হতো। খাদিজা মাস্তুরের গল্পের পাঁচটি সংকলন এবং দুটি উপন্যাস
'আঙ্গন' (আঙিনা
বা উঠোন) ও 'জমিন' (ভূমি
বা পৃথিবী) প্রকাশিত হয়েছে। 'আঙ্গন'-এর জন্যে তিনি সাহিত্যে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সম্মান
আদমজি পুরস্কার লাভ করেন।
'আঙ্গন'-এর কাহিনী রচিত হয়েছে ভারত বিভাজনের প্রেক্ষাপটে, কিন্তু এটা সর্বোপরি এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তরুণী আলিয়া’র গল্প, দুঃসময়ের ঝোড়ো হাওয়ার মুখে যে তার আত্মার আগুনকে কিছুতেই নিভে যেতে দেয় নি। মাস্তুরের বর্ণনাভঙ্গী সোজাসুজি, জটিলতাহীন, কিন্তু পাঠকের মনে প্রভাব বিস্তারে ভীষণ সক্ষম। এখানে আঙ্গন উপন্যাসের অংশবিশেষের অনুবাদ দেয়া হলো।
উর্দু বা হিন্দিতে ‘আঙ্গন’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘অঙ্গন’ থেকে। বাংলায় ‘উঠোন’ অর্থে তৎসম ‘অঙ্গন’ শব্দটি সরাসরি এবং তদ্ভব ‘আঙিনা’ ব্যবহার করা হয়। হিন্দ-উর্দুতে কিন্তু ‘আঙ্গন’ বলতে বোঝায় মূলত বাড়ির ভেতরের বা অন্দরমহলের উঠোন। তাই এখানে উপন্যাস বা তার অংবিশেষটির নাম হিসেবে শুধু ‘অঙ্গন’ বা ‘উঠোন’-এর বদলে ‘ভেতরের উঠোন’ শব্দদ্বয়ই ব্যবহার করা হলো। ]
'আঙ্গন'-এর কাহিনী রচিত হয়েছে ভারত বিভাজনের প্রেক্ষাপটে, কিন্তু এটা সর্বোপরি এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তরুণী আলিয়া’র গল্প, দুঃসময়ের ঝোড়ো হাওয়ার মুখে যে তার আত্মার আগুনকে কিছুতেই নিভে যেতে দেয় নি। মাস্তুরের বর্ণনাভঙ্গী সোজাসুজি, জটিলতাহীন, কিন্তু পাঠকের মনে প্রভাব বিস্তারে ভীষণ সক্ষম। এখানে আঙ্গন উপন্যাসের অংশবিশেষের অনুবাদ দেয়া হলো।
উর্দু বা হিন্দিতে ‘আঙ্গন’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘অঙ্গন’ থেকে। বাংলায় ‘উঠোন’ অর্থে তৎসম ‘অঙ্গন’ শব্দটি সরাসরি এবং তদ্ভব ‘আঙিনা’ ব্যবহার করা হয়। হিন্দ-উর্দুতে কিন্তু ‘আঙ্গন’ বলতে বোঝায় মূলত বাড়ির ভেতরের বা অন্দরমহলের উঠোন। তাই এখানে উপন্যাস বা তার অংবিশেষটির নাম হিসেবে শুধু ‘অঙ্গন’ বা ‘উঠোন’-এর বদলে ‘ভেতরের উঠোন’ শব্দদ্বয়ই ব্যবহার করা হলো। ]
রাতভর তুমুল বৃষ্টি হয়েছে, এবং যখন ভোরের আলো ফুটছে, তখনও আকাশ জলভরা কালো কালো ধাবমান মেঘে ঢাকা। বৃষ্টিজলে ধুয়ে গিয়ে
স্কুল প্রাঙ্গণের গাছপালাগুলো একটা স্নিগ্ধ তরতাজা চেহারা নিয়েছে । কিছু গাছের
ডালপালার আড়ালে লুকিয়ে একটা কোকিল ডেকে চলেছিলো পাগলের মতো। নিচে রাস্তায় ছড়িয়ে
থাকা আমের বোলের ঘ্রাণ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিলো; পত্রিকা
বিক্রেতা হকারটা দ্রুত পায়ে হেঁটে যেতে যেতে যত জোরে পারে চেঁচিয়ে বলছিলো--
“বোমা বিস্ফোরণ! হিরোশিমা ধ্বংস! জাপানের শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে! মিত্রশক্তির বিজয় আসন্ন! আজকের খবর! হিরোশিমা ---” তা হলে বোমা একটা পুরো শহরকে ধ্বংস করে দিলো ? এর পর কী হবে ? জামিল ফিরে আসবে। ব্রিটিশ প্রচারণার হাতিয়ারগুলো সরিয়ে রেখে সে ফিরবে খালি হাতে। কিন্তু যারা যুদ্ধের আগুনে পুড়ে মরেছে, তাদের কী হবে ? নিজের এসব জিজ্ঞাসার কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে সে খাট থেকে নেমে এলো। আজকের খবর পড়ার জন্যে সে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলো।
বড় চাচা ইতিমধ্যেই বৈঠকখানায় চলে গেছেন, এবং পত্রিকার পাতাগুলো তাঁর বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলো। সে অধৈর্যভাবে ওগুলো হাতে তুলে নিলো, “আগুনের দেয়ালের পেছনে হিরোশিমা অদৃশ্য ---”
“বোমা বিস্ফোরণ! হিরোশিমা ধ্বংস! জাপানের শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে! মিত্রশক্তির বিজয় আসন্ন! আজকের খবর! হিরোশিমা ---” তা হলে বোমা একটা পুরো শহরকে ধ্বংস করে দিলো ? এর পর কী হবে ? জামিল ফিরে আসবে। ব্রিটিশ প্রচারণার হাতিয়ারগুলো সরিয়ে রেখে সে ফিরবে খালি হাতে। কিন্তু যারা যুদ্ধের আগুনে পুড়ে মরেছে, তাদের কী হবে ? নিজের এসব জিজ্ঞাসার কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে সে খাট থেকে নেমে এলো। আজকের খবর পড়ার জন্যে সে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলো।
বড় চাচা ইতিমধ্যেই বৈঠকখানায় চলে গেছেন, এবং পত্রিকার পাতাগুলো তাঁর বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলো। সে অধৈর্যভাবে ওগুলো হাতে তুলে নিলো, “আগুনের দেয়ালের পেছনে হিরোশিমা অদৃশ্য ---”
পত্রিকাটা নামিয়ে রেখে সে ওখানে বসে রইলো স্তম্ভিত নিঃশব্দতায়। “হায় আল্লাহ্, সরকারগুলো যুদ্ধের সময় শহরগুলোকে তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু কেন বানায়? এ-লোকগুলোর এমন কী অপরাধ ছিলো যে, ওদেরকে এভাবে মরতে হলো? কিন্তু এভাবেই তো ইতিহাস তৈরি হয়েছে। এ-ইতিহাস কেনোদিনও সাধারণ লোকের আশা-আকাঙ্খাকে পাত্তা দেয় নি। পত্রিকায় পড়া প্রতিটি শব্দ এক-এক ফোঁটা রক্তের মতোই। হিরোশিমায় জ্বলে ওঠা ওই আগুনে কি সবাই, সবকিছুই জ্বলে গেছে? বোমাটা যখন বিস্ফোরিত হলো তখন লোকজন কী করছিলো, কোন্ স্বপ্ন, কোন্ আকাঙ্খাকে তারা তখন বাস্তব রূপ দিতে চাইছিলো, কোন্ কাজগুলোকে তখন তারা শেষ করে আনার পথে ছিলো ? কোন্ পরিকল্পনা নিয়ে এদিন তারা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলো ? এমনকি সম্ভবত সে-মুহূর্তেও কোনো জাপানি শিশু একটা দোকানে ঢুকেছিলো পুতুল বা খেলনা কিনতে। আর ঠিক তখনই বোমাটা বিস্ফোরিত হলো --- এবং ---”
“জলদি করে নাস্তা খেয়ে নাও, আলিয়া বিটিয়া, এক্ষুণি
স্কুলের টাঙ্গা চলে আসবে। ওখানে বসে বসে ভাবছোটা কী?” করিমন বুয়া বকা দিয়ে ওঠার পর সে তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে চা
খেতে বসলো। জামাকাপড় বদলে স্কুলের জন্যে তৈরি হওয়ার কাজটা তার এখনো বাকি। “জাপান হেরে যাওয়ার মুখে। তাদের পুরো একটা শহর ধ্বংস করে
দেয়া হয়েছে।” আম্মা বাথরুম থেকে বেরিয়ে গভীর আত্মপ্রসাদের একটা
ভঙ্গীতে তাকে এ-সংবাদটা দিলেন । “হ্যাঁ,” নাস্তা
শেষ করে উঠোনে বেরিয়ে যেতে যেতে সে বললো। বড় চাচি কলতলায় বসে মুখ ধুচ্ছে। কেয়ারিতে
ফুলগাছের চারাগুলো মাটির কাছাকাছি নুয়ে পড়েছে। সে কাপড় বদলে স্কুলের জন্যে তৈরি
হয়ে মাথার চুল আঁচড়াচ্ছে, এমন সময় বাইরে থেকে ‘মাস্টার টাঙ্গা হাজির’ হাঁক শুনতে পেলো। বোরখা হাতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে দেখতে
পেলো, নাজমা ফুফি তার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়ে কিছুটা যেন
অনিশ্চিতভাবেই তাঁর উঁচু হিলের স্যান্ডেল দিয়ে সিঁড়িগুলোর সঙ্গে একটা সমঝোতার
চেষ্টা করছিলেন।
“মাস্টারজি, আপনার
টাঙ্গা চলে এসেছে!” মজা পাওয়ার হাসিতে তাঁর
ঠোঁট উপরের দিকে বেঁকে গেলো, তিনি
ফিরে তাকালেন আলিয়ার দিকে। “আমরা দুজন একই পেশায় আছি, একমাত্র তফাতটা হলো তোমাকে লেকচারার বলে, আর আমাকে বলে মাস্টার। এমনকি এ-তফাতটা যদি কোনোদিন নাও
ঘোচে, তাতে আকাশটা তো আর ভেঙে পড়বে না, নাজমা ফুফি,” ঝাঁঝালো
গলায় জবাব দিলো আলিয়া। “হ্যাঁ, ওটা
কোনোদিনও ঘুচবে না। তোমার তো আর ইংরেজিতে মাস্টারস ডিগ্রি নেই। ঘোড়া আর গাধার
মধ্যে যে একটা সুস্পষ্ট তফাত আছে, সেটা
তো তুমি অস্বীকার করতে পারো না।” নাজমা
ফুফি নিচে নেমে নাস্তা খেতে বসেছেন, এমন
সময় রাস্তা থেকে হাঁক শোনা গেলো, “মাস্টারজি, কলেজ টাঙ্গা হাজির!” আলিয়া হাসলো, “মনে
হচ্ছে, টাঙ্গাওয়ালাদের চোখে তোমার আর আমার কোনো তফাত নেই।
ওদেরকে তফাতটা বুঝিয়ে দাও না কেন?” সে
বেরিয়ে গিয়ে টাঙ্গায় গিয়ে উঠলো এবং নাজমা ফুফি কী জবাব দিলেন শুনতে পেলো না।
স্কুল থেকে ফিরে সে দেখতে পেলো, কে-একজন উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। যেহেতু সে শুধু মেয়েটার
পেছন দিকটাই দেখতে পাচ্ছিলো, তাই
সে সাথে-সাথেই তাকে চিনতে পারলো না; কিন্তু
সে মাত্র কয়েক পা এগিয়ে গেছে কি যায় নি, ছাম্মি
ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। “ছাম্মি!
তুই এসেছিস!”
আলিয়া তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো, “আর ওটা কে? ওখানে
বারান্দায় খাটের ওপর শুয়ে আছে ?” “জানি না,” আদুরে
গলায় ছাম্মি বললো।” “কে আবার? ছাম্মির
ছোট মেয়েটা আর কি,” বড়
চাচি খুশির সঙ্গে জবাব দিলেন । বোরকা
খোলার কথা ভুলে গিয়ে আয়েশা ছুট দিলো বাচ্চাটার দিকে । “ওহ্, কী যে
সুন্দর হয়েচে এটা ! একদম তোর মতো, ছাম্মি।” সে ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে তুলে একটু চটকাতে চাইছিলো । হঠাৎ
তার মনে এলো যে,
তেহমিনা আপা বেঁচে থাকলে সেও
এতদিনে একটা বা দুটো বাচ্চার মা হতো। যে-ওড়নাটা দিয়ে বাচ্চাটার মুখ ঢাকা দেয়া ছিলো, সেটা সরে গিয়েছিলো এবং একটা মাছি উড়ে এসে বসলো
বাচ্চাটার গালে। হাতের ঝাপটায় মাছিটাকে সরিয়ে সে বাচ্চাটার মুখ ফের ওড়নায় ঢেকে
দিলো। “স্কুল থেকে ফেরার পথে আমি ওর জন্যে ছোট্ট একটা মশারি
নিয়ে আসবো,”
সে বললো, “তা হলে সে মশা-মাছি থেকে নিরাপদ থাকবে।” “আচ্ছা, মশা-মাছির উপদ্রব থেকে কে রেহাই পায় বলো তো? আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানে ওগুলো হলো মৌসুমি প্রজাপতি,” ছাম্মি হেসে বললো, “আমাদের
গাঁয়ে কেউ তোমার মতো কথা বললে, সবাই
তাকে নিয়ে তামাসা করবে। সত্যিই তো, মশা-মাছির
উপদ্রব থেকে কেই-বা রেহাই পায়?” সে
আবার হাসলো,
কিন্তু সে-হাসির মধ্যে লুকিয়ে ছিলো
বেদনা। সে রোগাও হয়ে গেছে। এতে তাকে আগের চেয়েও সুন্দর দেখাচ্ছিলো। বোরকা খুলতে খুলতে
আলিয়ার মনে এলো,
ছাম্মিকে হারিয়ে জামিল একটা বড় ভুল
করেছে।
“বড় চাচার সঙ্গে দেখা করেছিস?” বোরকা ভাঁজ করতে করতে সে জিজ্ঞেস করলো।
“কী করে করবো? আমি এসেছি পর্যন্ত তো উনি বাড়িতেই নেই,” তারপর বড় চাচির দিকে ফিরে শ্রদ্ধেয় মাতাজির ভঙ্গীতে তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, “বড় চাচা তো ভালোই আছেন, তাই না?”
“যথেষ্ট ভালো আছেন। তবে কিনা খানিকটা দুর্বল হয়ে গেছেন,” জবাব দিলেন বড় চাচি।
“তুই কিছু খেয়েছিস, ছাম্মি?” সে জিজ্ঞেস করলো। “না বুজি, আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।” বাচ্চাটা জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করলো। বড় চাচি তাকে তুলে নিলেন এবং তাঁর কাঁধের ওপর ওর মাথাটা রেখে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে তার গায়ে আদর করে আলতো চাপড় দিতে লাগলেন। আম্মা তক্তপোশে বসে জাঁতি দিয়ে সুপোরি কুচোচ্ছিলেন। তিনি একবারও ছাম্মির দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না। যখন থেকে আলিয়া একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে, তার চারপাশের আর সবার প্রতি আম্মার চোখে নতুন করে একটা ঘৃণা জেগে উঠেছে। আর ছাম্মির কথা বলতে গেলে, তাকে তো তিনি সবসময়েই অপছন্দ করেছেন।
“বড় চাচার সঙ্গে দেখা করেছিস?” বোরকা ভাঁজ করতে করতে সে জিজ্ঞেস করলো।
“কী করে করবো? আমি এসেছি পর্যন্ত তো উনি বাড়িতেই নেই,” তারপর বড় চাচির দিকে ফিরে শ্রদ্ধেয় মাতাজির ভঙ্গীতে তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, “বড় চাচা তো ভালোই আছেন, তাই না?”
“যথেষ্ট ভালো আছেন। তবে কিনা খানিকটা দুর্বল হয়ে গেছেন,” জবাব দিলেন বড় চাচি।
“তুই কিছু খেয়েছিস, ছাম্মি?” সে জিজ্ঞেস করলো। “না বুজি, আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।” বাচ্চাটা জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করলো। বড় চাচি তাকে তুলে নিলেন এবং তাঁর কাঁধের ওপর ওর মাথাটা রেখে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে তার গায়ে আদর করে আলতো চাপড় দিতে লাগলেন। আম্মা তক্তপোশে বসে জাঁতি দিয়ে সুপোরি কুচোচ্ছিলেন। তিনি একবারও ছাম্মির দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না। যখন থেকে আলিয়া একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে, তার চারপাশের আর সবার প্রতি আম্মার চোখে নতুন করে একটা ঘৃণা জেগে উঠেছে। আর ছাম্মির কথা বলতে গেলে, তাকে তো তিনি সবসময়েই অপছন্দ করেছেন।
“তোর বর আসে নি, ছাম্মি?” “না
বুজি। সে সময় করে উঠতে পারলো না, তার
মোষের অসুখ হয়েছে। সে আমাকে কোনোমতে ট্রেনে মেয়েদের কামরায় তুলে দিয়ে এক বুড়িকে
বলে দিয়েছিলো আমার দিকে একটু নজর রাখতে,” খিলখিলিয়ে
হেসে উঠলো সে। “আমি
তোকে খুব মিস করেছি, ছাম্মি।” স্নেহভরা চোখে তাকে দেখতে দেখতে আলিয়া বুঝতে পারলো, ছাম্মি তার বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট নয়। চিন্তাটা ছিলো
খুবই বেদনাদায়ক। “আমি বিশেষ করে তোমার জন্যেই এসেছি, বুজি।” “হুঁ!
তুমি চলে যাওয়ার পর বাড়িতে শেষ পর্যন্ত একটু শান্তি এসেছে তো, তাই তুমি না-থাকায় সে এত কষ্ট পাচ্ছে,” আম্মা ছাম্মিকে ব্যঙ্গ করে বললেন। “সত্যি?” ছাম্মি
হাসিমুখেই বিদ্রুপটা সহ্য করলো। কী? ছাম্মি কি সত্যি-সত্যিই তার সব আগুন হারিয়ে ফেললো? আলিয়া তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তার
চেহারায় এমন ভারভারিক্কি গম্ভীর একটা ভাব!
“ছাম্মি, তোমার
ছোট্ট মেয়েটাকে আমাকে দাও। আমি তাকে বড় করবো। আমার জীবনের আর যে-কটা দিন বাকি আছে, এটার দেখাশোনা করে কাটিয়ে দেবো,” বাচ্চাটাকে চুমু খেতে খেতে আর চটকাতে চটকাতে বড় চাচি
বার বার কথাটা বলছিলেন। “আপনি ওকে রেখে দিন, বড়
চাচি।” ছাম্মি প্রতিবারই ভদ্রতা রক্ষার্থে জবাবটা দিচ্ছিলো বটে, কিন্তু কথাটা উচ্চারণের সময় প্রতিবার তার চেহারা
ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছিলো। সম্ভবত তখন তার নিজের শৈশব এবং কেমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে
সে বড় হয়ে উঠেছে, সেসব কথা তার মনে পড়ে
যাচ্ছিলো। তাকেও তো লালন-পালনের জন্যে এখানেই রেখে যাওয়া হয়েছিলো। বাচ্চাটা এবার জোরেশোরে কাঁদতে লাগলো। আধখাওয়া খাবার
ফেলে রেখে হাত ধুয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো ছাম্মি। বড় চাচি ভেতরে গেলেন।
আম্মা ইতিমধ্যেই তাঁর পানের বাটা নিয়ে ছাম্মির কামরায়
চলে গেছেন। বোধহয় উনি ভয় পাচ্ছিলেন, তাঁর
দেবর-কন্যা আবারো ওখানে ঘাঁটি গাড়ে কিনা। একে তো ভ্যাপসা, দম
বন্ধ করা গরম,
তার ওপর একফোঁটা হাওয়াও বইছিলো
না। বাঁচার পক্ষে অসম্ভব রকমের এক অন্তহীন বিকেল গড়িয়ে চলছিলো সিসার মতো ভারী
পায়ে। “করিমন বুয়া, বাড়ির
ছোট্ট মেয়েটার জন্যে এই
খেলনাগুলো নাও আর ছাম্মি বিটিয়াকে আমার দোয়া জানিয়ে দিয়ো। সবার খাওয়া-দাওয়া যদি
হয়ে যায়, তা হলে ---” আধখোলা
দরজাটার ওপাশ থেকে ইসরার মিয়া তার আর্জি জানালো, এবং করিমন বুয়া সবার উচ্ছিষ্ট ভুক্তাবশেষগুলো একটা বাটিতে নিয়ে
ইসরারের কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার পথটি সুপ্রশস্ত করার প্রস্তুতি নিলো।
ইসরার মিয়ার কাছ থেকে খেলনাগুলো নেয়ার জন্যে আলিয়া হাত বাড়াতেই
করিমন বুয়া রাগে ফেটে পড়লো-- “হায় রে কপাল! ছাম্মি বিটিয়ার মেয়ের জন্যে খেলনা আনছে
ইসরার মিয়াা। কালে কালে আরো কত কী দেখবো!” মিয়ার
বাড়িয়ে দেয়া হাতের ওপর খাবারে বাটি আর রুটি আছড়ে রাখলো বুয়া। “এভাবে
তুমি জাতে উঠতে পারবে না, ইসরার মিয়া! বুক ফুলিয়ে
এধার-ওধার ঘুরছো আর হোমড়া চোমড়া ভাব নিচ্ছো। আসলে তুমি ক’পয়সার মানুষ, তা
তোমার জানা নেই?” করিমন বুয়া বারান্দায় উঠে গেলো, কিন্তু তখনও তার বকবকানি চলছেই অপ্রতিহতভাবে। করিমন বুয়া, মালেকুল
মওত ইসরার মিয়ার জান কবজ করুক এবং তোমাকে খোদা বোবা করে দিক-- আলিয়া মনে মনে
প্রার্থনা করলো,
বড় চাচির পাশে বসে পড়তে পড়তে। উনি
তখন বাচ্চাটার জন্যে একটা কোর্তা আর টুপি সেলাইয়ের জন্যে রেশমি কাপড়ের কাটা টুকরো
আর জরির বান্ডিলের মধ্যে থেকে পছন্দসইগুলো বাছাই করছিলেন।
কাজ করতে করতে অবিরাম কথা বলে চলেছিলেন তিনি: “তোমার শাশুড়ি মানুষটা কেমন, ছাম্মি? তোমার
সঙ্গে ঝগড়া করে?
করে না তো? আর তোমার বর? সে
নিশ্চয় তোমাকে খুব ভালোবাসে?” ছাম্মি
হেসে হেসে সবগুলো প্রশ্নের হ্যাঁ-বোধক জবাব দিচ্ছিলো, কিন্তু আলিয়া লক্ষ্য করলো সে তাদের কারো চোখে চোখে
তাকাচ্ছে না। “আমি
এটাকে এত ভালোবাসি কেন, বুজি?” এতসব প্রশ্ন থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় ছাম্মি
বিষয়ান্তরে গেলো। “কারণ, সে তোমার মেয়ে।” “যখন থেকে সে আমার চোখের
সামনে এসেছে,
বাকি দুনিয়াটা ছোট হতে হতে
কিছুই-না হয়ে গেছে।” সে
গভীরভাবে শ্বাস নিলো, তারপর বাচ্চাটাকে বুকে
জড়িয়ে ধরে তার সঙ্গে শুয়ে পড়লো। “তার
বাবা এবং দাদি তার জন্যে কোনো পরোয়াই করে না। ওরা তো ছেলে চেয়েছিলো।” অল্পক্ষণের মধ্যেই ছাম্মি ঘুমিয়ে পড়লো এবং ক্রমাগত
দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলো ঘুমের মধ্যে। আলিয়া সারাটা বিকেল বড় চাচির পাশে বসে বসে
কোর্তা আর টুপি সেলাই করলো।
সেই সন্ধ্যায় সবাই যখন চা খাচ্ছে, বড় চাচা ঘরে এলেন। ছাম্মি তাঁকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। “বড় চাচা এসেছেন, ছাম্মি,” আলিয়া ধমক দিয়ে বললো। “ও, এটা বড় চাচা নাকি? আমি
তাঁকে চিনতেই পারি নি,” সে
হাসলো মুখ বেঁকিয়ে। “সালাম, বড় চাচা। তা বলুন, আপনার
কংগ্রেস পার্টি কেমন চলছে? আল্লাহর রহমতে, গান্ধি মিয়ার আয়ু তো অনির্দিষ্ট কালের জন্যে লম্বা হয়েই
চললো।” হায় রে খোদা, এ তো
সেই আগেকার ছাম্মিই! শুধু একমাত্র তফাতটা হলো, এখন
তার কোলে একটা ছোট্ট খুকি আছে! আলিয়া তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। “তোমার শরীর-স্বাস্থ্য আর তোমাদের বাড়ির সবাই আশা করি
ভালো আছে?”
কিছুটা বিভ্রান্তভাবে বড় চাচা
বৈঠককানার দিকে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালেন, “করিমন
বুয়া, আমার চা’টা
বাইরে পাঠিয়ে দিয়ো।” “তাঁর
একটা লম্বা আয়ু দরকার, তাই না? বেচারা! উনি নেংটি পরে ভারত শাসনের স্বপ্ন দেখেন!” ছাম্মির কথার ধারে-ভারে খুশি হয়ে আম্মা তার সঙ্গে কথা
বলা শুরু করলেন। এসব ব্যাপারে তিনি তাঁর ভাইঝির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। ওদিকে আবার
তিনি ইংরেজ শাসকদের জন্যে তাঁর জীবন উৎসর্গ করে দিতেও প্রস্তুত। এর পেছনকার আসল
কারণ হলো, আলিয়া চাকরি পাওযার পর থেকে তাকে ভালোবাসায় ভরপুর লম্বা
লম্বা চিঠি লিখতে শুরু করেছেন আম্মার ইংরেজ মেমসায়েব ভাবি। এসব চিঠিতে উনি অনেক
বিষয় নিয়েই লেখেন। যেমন, তিনি লিখেছেন যে, ভারতের সব নারী যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে উঠতে
পারতো, তবে এ-দেশটিও ইংল্যান্ডের মতো একটা ভালো দেশ হয়ে উঠতো।
“তুমি এখন আর ছোট্ট মেয়েটি নও, ছাম্মি, পুরোদস্তুর
একজন মহিলা। তুমি এখন মা হয়েছো। বড় চাচার সাথে তোমার নিশ্চয় আরো একটু ভদ্র ব্যবহার
করা উচিত ছিলো।” কিছু না-বলার চেষ্টা করা সত্ত্বেও, শেষপর্যন্ত তার এই চাচাতো বোনটাকে না বকে আলিয়া থাকতে
পারলো না। “আমাকে-যে কোন্ ভূতে পেয়েছিলো জানি না। আমি তাঁর কাছে
মাফ চেয়ে নেবো।
মাথা হেঁট করে কী-যেন ভাবতে লাগলো ছাম্মি। “আমি কাল চলে যাবো, করিমন
বুয়া, ইসরার মিয়াকে বোলো কাল সকালে আমার জন্যে একটা টাঙ্গা
নিয়ে আসতে আর আমাকে বাড়ি যাওয়ার ট্রেনে তুলে দিতে।”
“কী? এতো
তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিস! তুই কি আমার ওপর রেগে গেছিস, ছাম্মি?
আলিয়া তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। “ওই দ্যাখো! কী-সব বাজে কথা বলছো, বুজি! তোমার ওপর আমি রাগ করতে পারি? কত কষ্টে যে একদিনের জন্যে অনুমতি নিয়ে বাড়ি থেকে
বেরিয়েছি, তা তো তুমি জানো না! তুমি জানো না , আলিয়া বুজি, তুমি
জানো না---,”
তার চোখ জলে ভরে গেলো, “আমি চিরকালের জন্যেই থেকে যেতে পারতাম, কিন্তু এখন আমার এই ছোট্ট মেয়েটা রয়েছে যে। ওর একটা
সুন্দর দেখে নাম দাও তো, বুজি। ওর দাদি নাতনির নাম
রেখেছেন তমিজন!”
খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে উপুড় হয়ে পড়লো সে। “থাকতে
পারবি না কেন?
অন্তত আট-দশটা দিন তো থাকবি! তুই
আসাতে কী যে ভালো লাগছে, যেন তোর সঙ্গে করে তুই এক
বাসন্তী হাওয়া নিয়ে এসেছিস!” রীতিমতো
আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লো আলিয়া। তুই চলে যাওয়ার পর বাড়িটাতে এমন এক স্থবিরতা নেমে
এলো। চারপাশে এতো চুপচাপ হয়ে গেলো যে,শেষপর্যন্ত
আমার গলার আওয়াজটাই চড়ে গেলো, ছাম্মি।” “আমি আবার আসবো, বুজি,” গভীর মনোযোগের সঙ্গে বাচ্চাটাকে আলতো চাপড় দিতে দিতে সে
জবাব দিলো।
বাড়ির সদর দরজায় একটা টাঙ্গা এসে থামলো, এবং শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে ঘরে এসে ঢুকলো নাজমা
ফুফি। “আরে! ছাম্মি যে! কেমন আছো তুমি? আর এটা তোমার ছোট্ট মেয়ে? খুব সুন্দর বাচ্চাটা। ভাগ্যি ভালো যে, দেখতে বাপের মতো একেবারেই হয় নি।” তিনি বাচ্চাটার গাল টিপে দিলেন, “ওকে ভালো করে লেখাপড়া শিখিও, ছাম্মি, নয় তো
সেও বাকিদের মতো একটা অশিক্ষিত তৈরি হবে।”
“আমি
ওকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো, নাজমা
ফুফি, তুমি ওকে পড়াবে।” ছাম্মির ছুঁড়ে দেয়া তিরটা নাজমা ফুপির কপালে কয়েকটা ভাঁজের সৃষ্টি
করলো। “ঠিক আছে, এ
নিয়ে আমরা পরে কথা বলবো। এখন আমি ক্লান্ত,” তারপর
তিনি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির দিকে। “শাকিলের কোনো খবর পেয়েছো?” “না ছাম্মি,” মৃদু
স্বরে জবাব দিলো আলিয়া। “আর
আমার বাবার কাছ থেকে কিছু শুনেছো?” আলিয়া
চুপ করে রইলো। সে আস্তে আস্তে হাত বুলোচ্ছিলো বাচ্চাটার গালে। কোনো জবাব না-পেয়ে
ছাম্মি তার দিকে অস্থির চোখে তাকাতে লাগলো। সে সবার কথাই জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু ভুলে গেলো জামিলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাটা। এ-প্রেমটার
মধ্যে কোনো বাস্তবতাই ছিলো না, আলিয়া
ভাবলো। তার খুব অবাক লাগছিলো।
স্বচ্ছ রাতের আকাশ ধুয়ে যাচ্ছিলো নরোম সাদা জোছনায়।
উঠোনে পাতা খাটিয়াগুলোর সারিতে একটা ছোট্ট খাটিয়াও যোগ করা হয়েছে। এমনিতেই সুন্দর
রাতটাতে বাড়তি একটা সৌন্দর্য যোগ করেছে বাচ্চাটার মুখ দিয়ে বেরুনো নানা অর্থহীন
শব্দ। গতকালকের বৃষ্টি তাপমাত্রাটাকে নামিয়ে এনেছে, এবং আবহাওয়া এখন চমৎকার ঠা-া। ছাদে না-ঘুমিয়ে আলিয়া আজ বিছানা
পেতেছে উঠোনে ছাম্মির পাশে। আজ রাতে তার কাছের কেউ থাকার এক সংজ্ঞাতীত অনুভবে তার
অন্তর ছেয়ে গেলো। সবাই মিলে আজ একসঙ্গে বসেছে আর ছাম্মির বাচ্চাটা মনের আনন্দে
নানা অবোধ্য শব্দ করছে। শুধু নাজমা ফুফিই সেখানে নেই। মূর্খদের সঙ্গ পরিহার করে
তিনি একাই ছাদে ঘুমোন। ভাইঝির
মুখোমুখি একবার হওয়ার পর বড় চাচা আর বাড়ির ভেতরে পা দেন নি। বৈঠকখানাতে বসেই তিনি
রাতের খাওয়া সেরেছেন, এবং তাঁর বিছানা পাতা হয়েছে
বাইরের চাতালে। তিন এখন ওখানে শুয়ে শুয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন।
হাতের কাজ শেষ করে করিমন বুয়াও চলে
এলো, এবং আম্মার পাশে মাটিতে বসে বাচ্চাটাকে ঘুমপাড়ানি গান
শোনাতে লাগলো-- আ যা রে নিন্দিয়া, তু আ
কিঁউ না যা (আয় রে ঘুম, তুই
আসিস না কেন) “করিমন বুয়া, একটা
গল্প শোনাও,”
ছাম্মি আবদার করলো। তাকে নিজেকেও
তখন দেখাচ্ছিলো ছোট্ট একটা মেয়ের মতো। “আমি এখন সব গল্প ভুলে গেছি, ছাম্মি
বিটিয়া,” ভাবতে ভাবতে করিমন বুয়া বললো। “যেকোনো গল্প, করিমন
বুয়া! তোমার বলা গল্পগুলো শুনতে আমার খুব ভালো লাগে।” ছাম্মির সঙ্গে আলিয়াও যোগ দিলো করিমন বুয়াকে তোল্লাই
দেয়া কাজে।
বইয়ের জটিল জগৎ নিয়ে ক্লান্ত সে এখন চাইছিলো একটা সরল, সাধারণ গল্পের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে। “বলো-না, করিমন
বুয়া। তোমার ওই গল্পটা বলো, ওই যে এক বাদশার ছিলো সাতটা
মেয়ে। একদিন বাদশা তাদের সবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘বলো তো দেখি, কার
ভাগ্যে তোমরা বেঁচে আছো?’ মেয়েদের
মধ্যে থেকে ছজনই জবাব দিলো-- ‘তোমার
ভাগ্যে, আব্বাা। কিন্তু সপ্তম তথা সবার ছোট মেয়েটি বললো, ‘আমি আমার নিজের ভাগ্যেই বাঁচি।’ তখন বাদশা তাকে বললো, ‘তা হলে যাও তোমার নিজের ভাগ্যেই বাঁচো,’ এবং তারপর তাকে বনের মধ্যে ফেলে রেখে এলো। আর তারপর, মেয়েটি যখন একা একা বনের মধ্যে বসে কাঁদছে, একটা জিন এসে তাকে একটা প্রাসাদ বানিয়ে দিলো! এই তো, এরকম গল্পই আমাদেরকে শোনাবে তুমি, করিমন বুয়া। আমি তোমাকে কত গল্প মনে করিয়ে দিলাম বলো তো?” শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে ছাম্মি বললো। “তা হলে ঠিক আছে, শোনো।
একসময়ে এক বাদশা ছিলো-- তবে আল্লাই যে আসল বাদশা সে-কথা তোমরা আর আমি অবশ্যই
জানি-- তো হ্যাঁ, যা বলছিলাম, এই বাদশার সাতটা মেয়ে ছিলো। একদিন বাদশা তাদের সবাইকে
তার কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলো---”
করিমন বুয়ার গল্পের কাহিনী ক্রমোন্মোচিত হচ্ছিলো, কিন্তু আলিয়া তার একটি বর্ণও শুনতে পেলো না। কারণ সে
তখন ভাবছিলো,
কেন ছাম্মি বিশেষ করে এ-গল্পটাই
শুনতে চাইলো। সেটা কি এ-কারণে যে, এখনো
সে মনে করে কোনো ঘটনা বা ব্যক্তি এসে তার ভাগ্য পাল্টে দেবে? সে হারিয়ে গেছে এবং কতদিন ধরে একটা বনের মধ্যে ঘুরে
বেড়াচ্ছে! কিন্তু কোনো জিনই তাকে বাঁচাতে আসে নি। ছাম্মি, তুই বুঝতে পারছিস না কেন, যারা জীবনে সবকিছু হারিয়েছে, তারাই
এসব ছেলে ভোলানো গল্পে আনন্দ খুঁজে পায়। এগুলোতে কোনো সত্য বাস্তবতা নেই। গল্পটা শেষ হওয়ার অনেক আগেই ঘুমপরী তাকে কে জানে কোন্
আনন্দভুবনে কোন্ সুন্দর রাজকুমারের পাশে উড়িয়ে নিয়ে গেলো।
পরদিন ভোরেই ছাম্মি চলে গেলো। স্কুলে যাওয়ার পথে আলিয়ার
মনটা অদ্ভুতভাবে খারাপ হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারলো, সে আজ ঠিকমতো পড়াতে পারবে না। ছাম্মি আর কটা দিন থেকে গেলে তো কোনো
ক্ষতি হতো না!