৭ নাম্বার রোড ১১৭ নাম্বার বাড়ি
সম্পর্কের রসায়ন বড় জটিল। মাঝে মাঝে এমন এমন সব সম্পর্ক
গড়ে ওঠে নিজে থেকেই, চমকে যেতে হয়। নেই কোন রক্তের সংযোগ, নেই কোন দীর্ঘ পরিচয়
সুত্রিতা কিন্তু আশ্চর্য রকমভাবে সে সম্পর্কগুলোমিশে যায় অস্তিত্বের সাথে।
৭
নাম্বার রোডের ১১৭, ৪০৭ এবং ৪২০ নাম্বার বাড়ি, সেন্ট্রাল পার্ক, কল্যাণী। প্রথমটা
থেকেএকটু দূরে পরপর দুটো মোট তিনটি ছাত্রাবাস। নাম সোনারতরী,আশ্রয় এবং লোকনাথধাম।সুঠাম
দেহের অধিকারী পঞ্চাশোর্ধ নাইট গার্ড মণ্ডল কাকাকে প্রথম দেখি আশ্রয়ে । রাতের দ্বিপ্রহরে
রেগিং-এর চুরান্ত পর্বে যখন আমরা, ঠিক তখন ভাইপো’দার রুমে মণ্ডল কাকার আগমন । চারদিকে
বিড়ি-গাঁজার ধুঁয়ায় মনে হচ্ছে পৌষের কুয়াশার ঢল নামছে, তামাকেরকড়া গন্ধ, বাংলা মদ
আর হুইস্কির ঝাঁজেমাথা বনবনকরছে কিন্তু বের হবার কোন জো নেই । সিনিয়রদের মুখের উপর
কড়া কথাযে বলব, সেই সাহস তখনো হয় নি আমাদের । এই সংকটময় পরিস্থিতিতে মণ্ডল কাকা
যেন সাহসের দূত হয়ে আসে ।
“কি রে
ভাইপো ? কি করছিস তোরা ? অনেক রাত হল । ছেড়ে দে তো ছেলেদের ? ওদের কি ফিরতে হবে না
হোস্টেলে ?”
একসাথে এত্তগুলো প্রশ্ন ।
মণ্ডল
কাকাও ভাইপো’দাকে ভাইপো ডাকছে ? কষ্টের মাঝেওআমার এক চিলতে হাসি, সেটাখেয়াল করে
পাশ থেকে চিকেন নামে যাকে এতক্ষন ডেকেছে সবাই, ঐ বেটা টেরা চোখে তাকায়, যেন কি মহা
অন্যায় করে ফেললাম হাসি দিয়ে । সাথে সাথে হাসি বেচারা উধাও আমার মুখ থেকে ।
“কাকা,
এই তো আর একটু।”
ভাইপো’দার আকুতিমাখা উত্তর ।
“না না । অনেক হল । এই, তোরা চল আমার সাথে ।”
ধরে
প্রান আসে । এই প্রথম একটুসাহস নিয়ে ভাইপো’দাদের রক্তাভ চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে
মণ্ডল কাকার পেছন পেছন রুম থেকে বের হয়ে আসি আমরা । ভাইপো’দারাও আর কোন কথা বলে না
।
“এত রাতে যেতে পারবি হোস্টেলে, নাকি আমি আসবো এগিয়ে
দিতে ?”
“না না কাকা, আমরা ঠিক যেতে পারবো ।”
“ঠিক আছে । সাবধানে যাস ।”
“ওকে কাকা ।”
সিনিয়রদের
চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে আমরা পৌঁছি সোনারতরীতে । এখনভাইপো’দার উপর থেকে রাগ
খানিকটা সরে গিয়ে পড়লো বাপ্পির উপর । বেটা সখ্যতা জমাতে গিয়েই আমাদের এই অবস্থা ।
আজ সন্ধ্যায় নাকি আশ্রয়ের সামনে ভাইপো’দাদের সাথে বাপ্পির দেখা । একত্রে বসে বিড়ি
খেয়েছে । ব্যস, এতেই নাকি খাতির জমে গেল !তারপর ওকে পাঠিয়েছে আমাদের নিয়ে যাবার
জন্য । আমাদের সাথে পরিচিত হতে চায় ওরা । রেগিং করবেনা বলে কথাও দিয়েছে বাপ্পিকে। আমরাও
বিশ্বাস করে সিনিয়রদের চালাকির ফাঁদে পা দিতে গিয়ে এই হাল । শেষে কিনা এক এক জন
বলির পাঁঠা হয়ে?
যাইহোক,
মণ্ডল কাকার উপর একটা শ্রদ্ধাবোধ আসলো মনের অগোচরে । হোস্টেলে ফিরে রাতের খাবার না
খেয়েই ঘুমিয়ে পরি । সকালে মণ্ডল কাকার ডাকে জেগে দেখি চারদিক ফকফকা লাল-ফরসা আলো
খেলা করছে ।
“কেমন আছিস তোরা ? আমি আগে বুঝতে পারি নি ওরা তোদের
এতক্ষণ ধরে রেগিং করছে । জানতে পারলে আগেই নিয়ে আসতাম বের করে ।”
“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কাকা । তুমি না থাকলে কাল রাতে যে
কি হত ?”
“ঠিক আছে । আমি সন্ধ্যায় এসে গল্প করবো । আজকে তোদের
হোস্টেলে নাইট ডিউটি আছে আমার । বলেই মণ্ডল কাকা বিদায় নিলো ।”
আমরাও
গত রাতের কথা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দেই । তবে বাপ্পির উপর রাগটা রয়ে যায় । শুধু রয়ে গেল বললে ভুল হবে,
স্থায়ীভাবে পোক্ত হয় এবং একটু পরপর দপদপ করে জ্বলতে থাকে। সুযোগেপাই কোন একদিন বেটাকেএমন শিক্ষা দেব, ওর মাথার দিব্যি
দিয়ে পন করলাম ।এরই মাঝে বাইরে ভাইপো’দার কথা শুনতে পেলাম । কাকে যেন বলছে,
“এই, বাইকটা ভেতরে ঢুকা তো ? ছানা, চল ।”
বুকটা ধড়ফড় করতে লাগলো । এই বুঝি আবার শুরু হয় । কিন্তু
না কালকের ভাইপো আর আজকের ভাইপো সম্পূর্ণ বিপরীত । রুমে ঢুকে যেভাবে কথা বলা শুরু
করল, মিনিট দশের পরে পুরাই ভাইপদা’র ফ্যান হয়ে গেলাম, এক রকম গলে গেলাম গদগদ হয়ে ।
কথায় কথায় জানলাম আমাদের তিন বছরের সিনিয়র ভাইপো’দার ভাল নাম রাজর্ষি চক্রবর্তী ।
আরও জানলাম এই ভাইপো নামের রহস্য ।
ভাইপো’দা তখন প্রথম বর্ষে । একদিনকলেজ চত্বরে বসে আড্ডা দিচ্ছে ।
রোগামত একজন মধ্য বয়স্ক লোক এসে জিজ্ঞেস করলো প্রিন্সিপ্যাল স্যারের রুমটা কোনদিকে
। ভাইপো’দা তাকে নাকি বলেছিলো,
“কাকু, ঐ যে দেখা যাচ্ছে কাঁচ ঘেরা রূমটা, ওটাই ।”কাকুও
কথায় কম যান নি সেদিন ।
“ওকে ভাইপো । ধন্যবাদ তোমাকে ।”
পরের
দিন মেথস এর ক্লাস, গত কালের কাকুচক ডাস্টার হাতে নিয়ে ক্লাস রুমে ঢুকলেন । ছোট
খাট রাজর্ষি চক্রবর্তী বসে আছে ঘাপটি মেরে এক কোনে । কাকুস্যার বের হয়ে যাবার সময়
বন্ধুরা পেছন থেকে ভাইপো ভাইপো বলে সুর তুললে স্যারও মুখ ঘুরিয়ে হাসলেন একটু ।
ব্যাস হয়ে গেলো, সেই থেকে রাজর্ষি চক্রবর্তী নামটা চলে গিয়ে ভাইপো দখল করল । ভাইপো
নামের রহস্য যখন ছানা’দা পাশে বসে খোলাসা করলো আমাদের সামনে, ছানা নামের রহস্যওকি আর
গোপন থাকে !
ছানাদার
ভাল নাম অরুপ ঘোষ । চৌদ্দ পুরুষের মিষ্টির দোকান । বিশেষ করে ছানা মিষ্টির জন্য
বিখ্যাত । মিষ্টির কথা বন্ধুরা একদিন জানতে পেরে হানা দেয় দোকানে । ছানামিষ্টি
খেয়ে তো মহাখুশি সবাই । ফেরার পথে অরুপ ঘোষ হয়ে যায় ছানা । আর আমাদের কাছে ছানা’দা
।আড্ডা দিতে দিতেই সকালের নাস্তার ডাক পড়ে । ভাইপো’দারা আমাদের সাথে নাস্তা খেয়ে
বিদায় নেয় । আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচি । দুপুর সন্ধ্যা গড়িয়ে বিকেল হয় । মণ্ডল কাকা আসে
রাতে ।
এরপর
থেকে সিনিয়রদের সাথে বেশ আড্ডা গল্পে দিন কাটতে লাগলো । আমরাও প্রথম বর্ষ শেষ করে
দ্বিতীয় বর্ষে । আশ্রয়ে ডিউটিথাকলেও মণ্ডল কাকা প্রায়ই আসে এখানে । বাড়ি থেকে পিঠা,
সেমাই আরো অনেক কিছু নিয়ে আসে আমাদের জন্য । কখনো কচুরি-আলুর দম, আবার কখনো ভাঁজা
শিমের বিচি । এরই মাঝে একদিন মণ্ডল কাকা করুন মুখে হাজির হয় আমাদের হোস্টেলে ।
“এখানে
আমাদের কোম্পানির কন্টাক্ট শেষ । অন্য কোথাও হয়তো আবার নতুন কন্টাক্ট পাবে । চাকরিটা
মনে হয় আর থাকলো না এখানে । এদিকেতোদের ছেড়ে যেতে ভালও লাগছে না ।”
মণ্ডল কাকার চোখে জল দেখে আমরা কি বলব বুঝতে পারছি না ।
মণ্ডল কাকা চোখ নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছে নীরবে আর মাটি খুঁটছে
।
“যদি
এখানে রি-কন্টাক্ট হয় তাইলে তো এখানেই থাকবে । আর যদি অন্য কোথাও চলে যাও, তাইলে
যখন তোমার মন চাবে, তখনই চলে আসবে । প্রতিদিন না পার অন্তত সপ্তাহে একদিন হলেও এসো
। আর তোমার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে যাও । আমরা একদিন বেড়াতে যাব তোমার বাড়িতে ।”
মণ্ডল কাকাকে বিদায় দিয়ে যার যার অশ্রু লোকাই বেশ কায়দা
করে । কেউ ঢুকে যায় রুমে কেউবা বাথরুমে গিয়ে জলের কল চাপে ।
এরপর
থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় মণ্ডল কাকা একবার আসে আমাদের হোস্টেলে । সহজে যেতে চায় না
। আমরা যখনরুমে বসে পড়ি, মণ্ডল কাকা বাইরে বসে থাকে যতক্ষণ না পড়া শেষ হয় । রাত
অনেক হয়ে গেলে আমরা তাড়া দিয়ে বাড়িপাঠাই ।মাঝে মাঝে এটাকে বাড়তি উপদ্রব মনে হয়
আমাদের কাছে ।বেশ বিরক্ত হয়ে যাই কখনো সখনো । তার এই প্রতিদিন আসার কারন জেনেছিলাম
অনেক পরে, যেদিন থেকে তার বাইরে চলাফেরা একরকম বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো ।
শুরু
থেকেই প্রতিদিন এক ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে মণ্ডল কাকা আসে আমাদের হোস্টেলে । শেষ দিকে
অন্য জায়গাতে চাকরি হওয়াতে আমাদের হোস্টেল পরে গেল বিপরীত দিকে এবং আধা ঘণ্টা বেড়ে
গেল সময় । এই দীর্ঘ পথ সাইকেলে চড়ে আসা যাওয়া করায় আস্তে আস্তে মণ্ডল কাকা দুর্বল
হয়ে যেতে লাগলো শারীরিকভাবে । একটা অদ্ভুত ব্যপার লক্ষ্য করি আমরা, এত কিছুর পরও
তার সপ্তাহে একদিন কি দু’দিন এখানে আসা চা-ই চাই । আগের মত রেগুলার না আসাবিষয়টা
নিয়ে আমরা খুব একটা গা লাগাই না। একবার যখন দীর্ঘ এক মাস মণ্ডল কাকার কোন দেখা পাচ্ছি
না, তখন আমাদের কাছেই ব্যপারটা কেমন যেন অনভ্যস্ত লাগতে শুরু করে । প্রতিদিন আমরা
অপেক্ষা করি মণ্ডল কাকার জন্য । তাকে দীর্ঘদিন না দেখে কিছুটা মন খারাপ হয় । ক্রমে
ক্রমে মনোকষ্টের কারণটা যখন বিশাল আকার ধারন করেতখন একদিন ঠিক করি খোঁজ নিতে মণ্ডল
কাকার বাড়িতে যাব ।
কল্যাণীর
সেন্ট্রাল পার্ক মোড় থেকে ঘোষপাড়া হয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সতীমায়ের মেলামাঠ
ঘেঁষে, ওটা ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলে দু’পাশে ফসলি জমি নজরে পরে । মরশুমেরকাঁচা-পাকা
ধানকিংবা হলুদ সরিষা খেতের মাঝ দিয়ে মুল রাস্তা থেকে ডান হাতি মোড় নিয়েই একটা
ছোট্ট গ্রাম ।চারদিকে হালকা কুয়াশা, শীত আসছে আসছে করছে ওদিকটায় । কুয়াশা মাথায়
নিয়ে দেড়হাতি আইল ধরে আমরা যখন মণ্ডল কাকার গ্রামে পৌঁছলাম তখনও সকালের হালকা
শিশির খেলছে দুব্বা ঘাসের মাথায় ।ঘাস শিশিরে মেশামেশি হয়ে পরনের প্যান্ট বিঘতখানেক
ভিজে যায় পায়ের গোড়ালির দিকে । লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে এ বাড়ি ও বাড়ি হয়ে অবশেষে
হাজির হই মণ্ডল কাকার উঠোনে । পুবমুখী বারান্দায় একটা পুরনো ইজি চেয়ারে হেলান দেয়া
মণ্ডল কাকাকে দেখে চট করে চিনতে কষ্ট হয় । আমি, বোবাই আর ছোটন কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই
ঘরের ভেতর থেকে একজন ভদ্র মহিলা কপালের উপর ঘোমটা টেনে পরিচয় বিত্তান্ত জানতে চায়
।
আমাদের
ফিসফিস কথায় মণ্ডল কাকা জেগে উঠেছে ততক্ষণে । অস্পষ্ট স্বরে আমাদের পরিচয় নিজেই
বলে দেয় পেছনে দাঁড়ানো মহিলাকেএবং আমাদের সাথে কাকিকে পরিচয় করিয়ে দেয় । কাকিরচোখে
মুখে খুশির ঝিলিক, বেতিব্যস্ত হয়ে উঠে মণ্ডল কাকাও । এরপর কতদিনের জমানোকথা-গল্প !
সব একে একে বলা হয় । দুপুরে খেয়ে তবেই বিদায় ।
ঠিক
মত হোস্টেলে পৌঁছতে পারবো কিনা সে জন্য তার এক ভাতিজাকে আমাদের সাথে দিয়ে দেয়।
বিদায় নিয়ে ফিরছি আমরা বিকেলের রোদে ফসলি মাঠের বুক চিরে আরচারদিকে হলুদের আঁচর দেখতে
দেখতে । এরই মাঝে হঠাৎ,
“জানেন,
কাকা শুধু সারাদিন আপানাদের কথাই বলেন । কত গল্প যে করেন আপনাদের নিয়ে ! আসলে
কাকার একটা ছেলে ছিল আপনাদের বয়সি । আমার থেকে কিছু দিনের বড় ।ওই যে সামনে মেইন
রাস্তাটা দেখছেন, ওইখানেই এক্সিডেন্টটাহয়েছিলো । এক ঈদের দিন সকালে খেলতে যেয়ে
ট্রাকের নিচে চাপা খায় । স্পট ডেথ । সেই থেকে কাকা একটু কেমন যেন হয়ে গেছেন ।শুনেছি
এরপর অনেকদিন পর্যন্ত নাকি কাকা পাগলের মত আচরণ করতেন । দীর্ঘচিকিৎসারপর একসময়
স্বাভাবিক হন । আপনাদের বয়সি কাউকে দেখলে কাকা এভাবেই মায়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন ।বাড়িতে
নিয়ে আসেন, হয়ত নিজের ছেলেকে খুঁজে ফেরেন এখনো ।”
কথাটা
শোনার পর নিজেকে কেমন যেন অপরাধী অপরাধী মনে হয় । কতবারই তো বিরক্ত হয়েছি, হয়তো
মনে মনে পাগল-উন্মাদ বলে গালিও দিয়েছি মণ্ডল কাকাকে । সারা রাস্তা আর একটি কথাও
বেরহয় না আমাদের কারো মুখ থেকে । হোস্টেলে ফিরে চুপচাপ শুয়ে পরে ।
আধো
জাগরণ আধো ঘুমেদেখতেপাই, এক পঞ্চাশোর্ধ্ব নাইট গার্ড বসে আছে মুল গেইট আগলে । চোখ
উপচে ঝরছে মায়ার জোছনা কিংবা ছেলে হারানো শোক । আর হোস্টেলের নেইমপ্লেটে লেখা ঃ "সোনার তরী, ৭
নাম্বার রোড ১১৭ নাম্বার বাড়ি ।"