গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৪

সাঈদা মিমি

পাঁচটি অনু গল্প

বুড়ীটা

সাতসকালে খালিপেটে পাঁচতলা বেয়ে নামাটা অসহ্যকর, প্রতিবারই এমন হয় আমার, রাগটা করলা মত তেতো হতে থাকে। তার ওপর গতরাত থেকেই বিদ্যুত ঝলসানো বৃষ্টি। পানি কাদা বাঁচিয়েও হাঁটার উপায় নেই, বর্গমূলের ফর্মূলায় ছপাৎ ছপাৎ করে কাদা লেগে যাচ্ছে শাড়ীতে।হাতে ধরা ছাতাটা আরেক বোঝা, এ্যাই.. কে যেন কাঁধ ছুঁয়ে গিয়েছে! অদ্ভুত চেহারার এক বুড়ী! চমকে উঠি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। বুড়িটার একটা হাত বিবশ, ঝুলছেসরু লিকলিকে, চিমসে কালোকোত্থেকে এলো ? এই দূর্যোগের মধ্যে কোন জনমানুষ নেই, একটা রিকসাও চোখে পড়ে না, কিন্তু এই বুড়ীটা! হাসলো সে, হাসলো ? ভালো হাতটা দিয়ে কি যেন গুজে দিলো আমার হাতে, “ বাতাসাডা খাইস, তারপর শিশি খুলবি, মাইছ্যা দেও চাইরডা সোনার মাছ দিবো…..” ঘোরাক্রান্ত দাঁড়িয়ে আছি, অল্পক্ষ নাকি অনেকক্ষণ ? বুড়ী নেই।

আলেয়ার মনস্তত্ব

ঘর পালিয়েছে বলে কোন আফসোস নেই আলেয়ার, হতচ্ছাড়া মরদ নয় বছরে চারটে সন্তান দিয়েছে তাকে, আর দুইটা সতিন। ভূখা পেট, সন্তানদের ঘ্যানঘান, স্বামীর পিটুনি, সতিনদের সঙ্গে বিবাদ এসব ভালো না লাগলেও প্রেমিক নেহাল মণ্ডলের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রেম করতে ভালো লাগতো তার।নেহাল তার মরদেরই দোস্ত, আলেয়ার সাথে লটরপটরের খবর চাউর হয়ে গেলে কি পিটুনিটাই দিয়েছিলো তাকে সোয়ামী, নেহালেরও ঘরের দেউড়িতে আসা নিষেধ হলো কিন্তু তাতে দেখাসাক্ষাত বন্ধ হলো না। কোমরে শাড়ী ব্লাউজে পোটলা নিয়ে বাড়ী বাড়ী বিক্রী করে আলেয়া, বাঁধা কাস্টোমার আছে তার বাহারী পোষাকের, আয় রোজগার মন্দ নয়। এই সবকিছু নিয়েই নেহালের হাত ধরে ঘর ছাড়লো সে, লুকিয়ে দেখা করাটা যন্ত্রনাদায়ক হয়ে দাড়িয়েছিলো। সবকিছু নিয়ে ঘর ছাড়লো? ভুল, সন্তানদের ফেলে রেখে গেলো যমের দাওয়ায়।

কেবল মা জানে

কেবল মা জানে সন্তানটা কার, যেমন নাসিমা বানু জানেন ছেলেটা তার ভাসুরের ঔরসজাত। লুকাতে জানতে হয়। কি করতে পারতো সে ? মমতাজ সওদাগর বানিজ্যের ধান্ধায় দুরে পড়ে থাকে, এই ভরা যৌবন তাকে পোড়ায়। তারপরও মালেক সওদাগরের সঙ্গে এহেন প্রণয়ঘটিত ব্যাপারটা তৈরী হতো না যদি না মালেকের বৌ চলে যেতো। মালেকের বৌ তাকে ছেড়ে চলে গেলো কার মালেক রোজগার বিমুখ। জজকোর্টের পেশকার সে, ঠিকমত কাজে যায় না, সারাদিন উদাস ভঙিতে পদ্য রচনা করে কিংবা বাগান নির্মা এমন বেহুদা নিমরদকে তালাক দিয়ে দিলো বৌটা। পাশাপাশি বাড়ীর নিঃসঙ্গ দুটি মানুষের কাছাকাছি আসাটা অস্বাভাবিক ছিলো না, কিন্তু দূর্বলতা আর বমিভাবটা প্রশ্ন তৈরী করে ফেললো। প্রশ্নটা গুজবে রূপ নিতে নিতে পাক্কা তেইশ দিন, মমতাজ সওদাগর ফিরলো ঘরে। সামলে নিলো নাসিমা খানম, সে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা, নশ্বর রুপ আর ধূর্ত বুদ্ধির মিশেল দেয়া রমণী। স্বামীর প্রেমে বাউরা হয়ে গেলো, তার সেবা পরিচর্যায়।পড়শীরা পড়লো ফ্যাসাদে, সত্যমিথ্যার প্যাঁচ লেগে গেলো। তবে নাসিমা সুক্ষ হিসেব ভালোই বোঝে, তার কাছে মালেকের প্রেমের চাইতে মমতাজের বিত্তের মূল্য নিঃসন্দেহে অধিক। সুতরাং মালেক সওদাগরকে পরিত্যাগ করলো সে।


সব কাগজেই ছবি থাকে

গুলিস্তানের সস্তা হোটেলে রাজারানীর মতই আছে আলেয়া নেহাল, কেবল পুঁজি ভেঙ্গে চলছে এই যা। আলেয়া চিন্তিত হয়ে পড়ে, নেহালকে জানাতেই সে বললো, ‘কাম কইরাই তো খামু, দুইদিন এট্টু মৌজ কইরা লই এভাবেই চলছে আজ পাঁচদিন। খিদে পেলে বিলাই তকদীরের হোটেল থেকে খেয়ে আসে ওরা, বাকি সময় পলেস্তরা খসানো পেস্ট রঙের চারদেয়ালে। আহা, কি সোন্দর এই জীবন! আলেয়া ভাবে এবং অনাগত দূর্ভাবনা সিন্দুকে রেখে তারা নিজেদের আকাশে তারাবাতি জ্বালায়। ব্যাপারটা ঘটলো ষষ্ঠ রাতে, হোটেলে পুলিশি রেড। এরকম হোটেলে এসব হামেশাই হয়, হয়তো মালিক সেইমাসের বখরাটা সময়মত পৌঁছে দেয়নি।অনেক যুগলের সাথে ধরা পড়লো আলেয়া নেহাল। সাংবাদিকদের ক্যামেরা থেকে কিভাবে মুখ আড়াল করতে হয় জানা ছিলো না আলেয়ার, তার আলুথালু হতভম্ব চেহারার ছবিটা ছাপা হয়ে গেলো পত্রিকায়।ঘটনার রেশ বস্তিঘরগুলিতে রসের উপাদান নিয়ে এলো, এইসব অসভ্য হাওয়ার ফাঁদে পড়ে রইলো তিনটে অসহায় শিশু।

আরব্যরজনীর দৈত্য

 আজ খুব জরুরী একটা কাজ ছিলো, কি কাজ মনে পড়ছে না। হাতে একটা হোমিওপ্যাথির মুখবন্ধ শিশি, বাতাসা ভিজে গলে গেছে। ফেলে দিয়ে এসেছি পথেই। কি যেন বলেছিলো বুড়িটা? ঐরকম ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যে কোত্থেকে এলো সে! গায়েব হলো কিভাবে! এলোমেলো চিন্তায় বেহাল হয় বসে আছি। ঘরে ফিরেছি, কেন? কখন? ভেজা কাপড় ছেড়ে নিশ্চুপ বসে আছি, সামনে একটা শিশি। দিনটা কেমন ঘোরের মধ্যে চরকা কাটছে। নাওয়া কিম্বা খাওয়া অথবা বিশ্রাম! বাতাসাটা কিজন্যে দিয়েছিলো বুড়ি? দৈত্য বশের বর্ম! জানি না, কিন্তু আজ আমার ব্যাংকে টাকা ওঠাতে যাওয়ার কথা ছিলো। এই ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একারনেই বের হয়েছিলাম, মনে পড়েছে।
সন্ধ্যাবাতিগুলি ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে, আমার ঘরেও; প্রতিটি কামড়ায়। ভয় পাইনি কিংবা ভয় পাইনা বলে যে সাহসটা আজন্মকাল দেখিয়ে গেছি, সেই সাহসটাই সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। চৌষট্টি রকমের আসান মুশকিলগুলোকে কাবু করতে ব্যর্থ। কি হবে শিশির মুখটা খুললে? দৈত্য বেরুবে? খুলবো? না থাক। খুলেই দেখি না! আমি চলার আগেই আঙুল চলেছে, হা করে খুলে আছে স্বচ্ছ হোমিওপ্যাথির শিশি।