রম্যরচনা
উদয় চরিত
আমি
এক সজ্জন ব্যাক্তিকে চিনি। তাঁর নাম উদয় নারায়ণ। বড় মজার লোক তিনি। অকৃতদার মানুষ,
পরিবার বলতে তিনি ও তার ভোজন বিলাসিতা । পেটুক বলব না, তবে
উদয় নারায়ণ মহাশয় একটু বেশী মাত্রায় ভোজনরসিক ছিলেন। আর এই ভোজনের সাথে সামঞ্জস্য
রেখে তাঁর ওজনও ছিল ছোটখাট এক হস্তীশাবকের সমান। পাড়ার চ্যাংড়া ছেলেপিলেরা উদয়
নারায়ণ কে আড়ালে আবডালে উদর পরায়ন বলত। এমন নামকরণের পিছনে ব্যাঙ্গ যত টা না ছিল তারচেয়ে কৌতুকময় এক যৌক্তিকতা
ছিল অনেক বেশী। উদয় বাবুর উদর খানা ছিল তাঁর
বিপুল বপুর মাঝে সত্যিই যেন এক দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব। বিশাল এই ভূগোলকের
অর্দ্ধেকটাই যেন তিনি নিজে বয়ে চলেছেন নিজের শরীরে – ঠিকই তো একা অ্যাটলাস্ আর
কতদিন বইবেন!
তাঁর
ভোজনবিলাসের কয়েকটা নমুনা দেওয়া যাক। খাওয়ার ব্যাপারে কোনও রকম সমঝোতা করার
পক্ষপাতি নন তিনি। যে জিনিস যেখানে সেরা, তিনি খোদ পৌঁছে যান সে জায়গায়, নিয়ে আসেন
ব্যাগ ভরে মনপসন্দ্ খানা। পরিমানেও একটু বেশী ক’রে, কারণ বহু দূর দূর যেতে হয় তাঁকে
সেরা খাদ্যসামগ্রীর সন্ধানে- তিনি মনে
করেন তা না করলে পরিশ্রমে পোষায় না। যেমন মাংস খাবেন তো রেওয়াজি পাঁঠার খোঁজে চলে
যান বৌবাজারে হাফিজের দোকান, সেরা বিরিয়ানি খাবেন তো কোলকাতার নামি দামি দোকানের
ওপর অতটা ভরসা না করে সটান গিয়ে হাজির হন হায়দ্রাবাদ শহরে – দিন কতক থেকে মনভরে
ভরপেট বিরিয়ানি খেয়ে আসেন। ডাঁটা চচ্চরি খাবেন তো কাটোয়া থেকে আনা চাই সে ডাঁটা। এছাড়া
নানাবিধ বাঙালী মিষ্টান্ন উপাদান তো আছেই – জিলিপি খেতে সাধ জাগল তো হাওড়া স্টেশন
থেকে উঠে বসলেন মেছেদা লোকালে। পান্তুয়া তো রানাঘাট, ল্যাংচা খেতে শক্তিগড়, মিহিদানা-
সীতাভোগ মনে পড়ল তো সোজা বর্ধমান গিয়ে হাজির। গাঙ্গুরাম, সুরভী এতসব থাকতেও উনি
মিষ্টি দই আনাতেন মোল্লার চক থেকে। ভোজন দুনিয়ায় তাঁর মত রসনার পাকা জহুরী আর একটা
খুঁজে পাওয়া শুধু মুশকিল্ ই নয় না মুমকিন্ ও বটে।
রসনাকে
তৃপ্ত করতে অর্থব্যায়ে তিনি কোনদিন ই কোনও কার্পণ্য করেন নি। লোকে বলে
বাপ-ঠাকুর্দার চালু লোহা-লক্করের কারবার তাঁর পরিবারে মা লক্ষ্মীর কৃপার
বাড়-বাড়ন্ত ঘটিয়েছিল। আরো একটা অসীম গুণ
আছে উদয় বাবুর – তা হল এই পঞ্চাশোর্ধ
বয়সেও তাঁর লোহা হজম করার ক্ষমতা। যতদুর জানা আছে রোগ-ব্যাধি তেমন নেই
বা থাকলেও তাঁর জানা নেই। শুধু একবার মাঝে দিন কতক রাতের ঘুম একদম গুম হয়ে গিয়েছিল।
শরীরের জুত ও তেমন ছিল না সে সময়, তবে এ নিয়ে তেমন খুঁতখুঁত করার পাত্র তিনি নন। সোজা
ডাক্তারের কাছে গিয়ে বললেন – “ডাক্তার শরীরটা আমার ঠিক যাচ্ছে না, খেয়ে সুখ পাচ্ছি
না আগের মত। আর সেই কারণেই রাতে ঘুম হচ্ছে না ঠিকঠাক।” ডাক্তার তো এই কথা শুনে
ধমকাবেন না চমকাবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। যাই হোক উদয় বাবুর রক্তচাপ পরীক্ষা করে
বললেন- “শরীর খারাপ হবে না! আপনার তো মশাই রক্তের চাপ বেড়েছে, এখন থেকে সাবধান
হোন। এমন নজীরবিহীন ওজন আপনাকে কমাতে হবে। মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া বন্ধ করতে হবে।” খুব স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তারের এই পরামর্শ তাঁর কাছে খুব একটা সুপরামর্শ বলে মনে হল না – বিশেষতঃ তাঁর উদর প্রীতি কে খোঁটা দেওয়া এবং এহেন সুন্দর
স্বাস্থ্য কে বেনজীর ওজন বলে নজর দেওয়া, কোনটাই একেবারে বরদাস্ত করতে পারলেন না।
বেরিয়ে বললেন – “আসলে সকলে তো এমন খাওয়া খেতে পারে না, তাই ওই নিখাকির মা ডাক্তার
এমন কটাক্ষ করলেন। আরে বারা শরীরে রক্ত বইলে তার চাপ তো থাকবেই।” বোঝা গেল খাওয়া সম্বন্ধে ডাক্তারের এই এমবারগো
তাঁকে অসন্তুষ্ট করেছে। যাই হোক
লৌহ কারবারি
উদয় বাবু লোহিতধারার বর্ধিত চাপ নিয়ে মনে বিন্দু মাত্র চাপ নিতে চাইলেন না। বরঞ্চ নিজের ব্লাড প্রেসারের কোনও তোয়াক্কা না করে,পাঁঠার
মাংস ভাল করে সুসিদ্ধ করার জন্য সাত লিটার মাপের একটা প্রেসার কুকার কিনে ঘরে ফিরলেন। এই বয়সে রেড মিট, মানে পাঁঠা খাওয়ার দুঃসাহস
দেখানো – মানতেই হবে সত্যিই ওনার বুকের পাটা আছে বটে। অতএব যথা পূর্বম তথা পরম, উদয়
বাবুর উদর স্ফীতি আগের মত বেড়েই চলল। ওজন বা ভোজন কোনটাই কমল না।
আর
একটা কথা না বলে পারছি না। উদয়বাবু ভোজনরসিক যেমন ছিলেন, খাওয়ার ব্যাপারে তেমন ই ছিলেন খুঁতখুঁতে। লোক-লৌকিকতার
খাতিরে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী বাড়ীর সব উৎসব অনুষ্ঠানে উদয় বাবুকে
নিমন্ত্রন করতেন, অথচ প্রচন্ড দুশ্চিন্তার মাঝে তাঁরা দিনও কাটাতেন। সব জায়গায়, সে
বিয়েবাড়িই হোক, অন্নপ্রাশণ ই হোক – ভোজের আসরে তিনি শুধু একজন ভোজনরসিক ই নন,
পরিবেশিত খাদ্যের গুনাগুন পরখ করতে বিচারকের (পড়ুন নিন্দুক বা সমালোচক) ভুমিকায়ও
সমান ভাবে পারদর্শী ছিলেন। চেনা লোকেরা পারতপক্ষে ওনার সাথে এক পঙতি তে খেতে বসতেন
না কারণ তাতে নিজেদের খাওয়া লাটে উঠত ওনার ওই অযাচিত খাদ্য পর্যালোচনা পূর্বক
বিচারের রায় গলাধঃকরণ করতে দিয়ে। কচুরীর ময়ান, লাচ্চা পরোটার লেচির প্যাচ-পয়জার,
ফিসফ্রাই এর ফিলেট, মাছ-মাংসের জাত – এমনই সব খাবারের মানগত ত্রুটি, প্রস্তুত
প্রণালীর খামতি নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত বিশদ ভাবে জাহির করতেন। উপস্থিত সহভোজীরা
বাধ্য শ্রোতা হয়ে শুনতেন একান্ত বাধ্য হয়েই - তাঁদের বুঝিয়ে ছাড়তেন তাঁর অকাঠ্য
যুক্তি। একবার তো কোন এক মেয়ের বাবাকে সামনে দাঁড় করিয়ে নিজে খেতে খেতে তাঁর
জাজমেন্ট শোনাতে শুরু করেছিলেন – কিসে কি কমতি আছে, রান্নায়, কাঁচা-মালে,
মশলা-পাতির উপাদানে, খুটিনাটি সব। মেয়ের বাবা আর কি করেন এমন সম্ভ্রান্ত অতিথির সব
কথা অভ্রান্ত বলে মেনে নিয়ে, সব ত্রুটি নিজের ঘাড়ে নিয়ে কোনমতে পালিয়ে বাঁচেন
তখনকার মত। এই কারণেই এখন আর উদয় বাবু খেতে বসলে, গৃহকর্তা বা তাঁর আত্মীয়-স্বজন
ওনার তদারকি করার জন্য ধারে কাছে ঘেঁষেন না। অবশ্য এজন্য উদয় বাবুর মান-সম্মানে কোনো
টান পড়ে না। উনি বলেন খাওয়ার সময় যে ব্যাক্তি লজ্জা করে খায়, ধরাধামে তার চেয়ে
মুখ্যু নাকি আর কেউ নেই।
২
এহেন
উদয় বাবুর একদিন বোধোদয় হল। আগের বার যে ব্যামো ধরেছিল, তা ছিল অনিদ্রা, ডাক্তার
বললেও তিনি খাওয়া দাওয়ায় কোনও কৃচ্ছসাধন করেন নি, আর রক্তচাপ থাকল, কি গেল তাকে
গুরুত্ব না দিয়ে মোটামুটি দিন কাটাচ্ছিলেন মহাভোজেই। ভোজেই আনন্দ, ভোজেই মোক্ষ,
ভোজেই সকল রোগের মুক্তি এই যুক্তিতে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় উদয় বাবু নিত্য নতুন
ভোজনস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতেন। কিন্তু মুশকিল টা বাঁধল এবার অন্যভাবে। দিনদুপুরে,
সময়ে অসময়ে, স্থানে অস্থানে প্রায়শই তাঁর চোখের পাতা ভার হয়ে আসত- মাঝে মাঝে বলা
নেই কওয়া নেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়তে লাগলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন বয়স হচ্ছে, ক্লান্তি
বাড়ছে। গদিতে যাওয়া একটু কমিয়ে দিলেন, কদিন ভালকরে বাড়িতে ঘুমিয়ে নিলেই আবার আগের
মতন তরতাজা হয়ে উঠবেন। কদিন না হয় ব্যাবসা টা কর্মচারীদের দিয়েই চালিয়ে দেবেন।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ, খাটনি কমিয়ে খাটে শুয়ে বসে তাঁর বিশ্রাম পর্ব শুরু হল। সিদ্ধান্ত
নিলেন বয়সটা বাড়ছে শ্রমটা একটু কম করে করবেন। বেশির ভাগ সময়ই তিনি এখন শুয়ে
থাকেন, ঘুমিয়ে পড়েন – স্বেচ্ছায় বা
অনিচ্ছায়। দেখে কে বলবে এই মানুষটাই কোন একদিন ডাক্তারের কাছে গেছিলেন অনিদ্রা
রোগের নিরাময়ের জন্যে। এখন তাঁর এই অতি নিদ্রাই এক ফ্যাসাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে, উদয়
বাবু খাওয়ার দিকে আরও একটু বেশী সজাগ হয়ে উঠলেন, কর্মস্থলের কাজের চাপ জনিত খাওয়া
দাওয়ার যে সব কিঞ্চিত অনিয়ম ঘটত, তা এবার থেকে বন্ধ হ’ল। নিয়ম করে খাওয়া ও শোয়া,
শোয়া ও ঘুমানো এবং ঘুমানো ও খাওয়া চলতে লাগল ঘড়ির কাঁটা ধরে। মনটাও বেশ ফুরফুরে
হয়ে গেল, যত্ন করে তাড়িয়ে তাড়িয়ে মনপসন্দ্ খাবারগুলো খেতে তাঁর বেশ লাগছিল।
দিনকতক
এমন যেতে আর এক নতুন ফ্যাসাদ লক্ষ্য করলেন তিনি। এত খাওয়া-দাওয়া, এত বিশ্রাম তথা বিনাশ্রমের
জীবন তা সত্বেও তার অমন বিশাল কলেবর শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। যেন আঙ্গুর শুকিয়ে
কিসমিস্। একটু ঘাবড়েই গেলেন তিনি। স্বাস্থ্যকর
খাওয়া, এত বিশ্রাম, পর্যাপ্ত ঘুম- সবই তো শরীর কে আরো সুস্থ করবে বলে! তাহলে এমন হিতে বিপরীত হচ্ছে কেন? যে দেখে সেই বলে – “কি ব্যাপার উদয় বাবু, অমন
সুন্দর শরীর, ভেঙ্গে যাচ্ছে কেন?” পাড়ার ছেলেপিলেদের আড্ডায় এই প্রসঙ্গটা বেশ
মুখরোচক হয়ে উঠেছে, তাদের উদর পরায়নের হল টা কি? শরীর এতই ভেঙ্গে গেছে যে গায়ে গতরে
শুখিয়ে গিয়ে ভুড়িটা যেন আরও বেশী প্রোজেক্টেড লাগে। চ্যাংড়া ছোড়ারা সব ছড়া কাটতে
শুরু করে – “উদয় বাবু যায়, জামা হ্যাঙ্গারে ঝুলায়, বিকট ওই উদরখানা আগে ভাগে ধায়।”
সে
যাই হোক, বোঝা গেল তাঁর জীবনে কোন মহা সংকটের উদয় হয়েছে। একদিন মুখোমুখি রাস্তায়
দেখা হতে বলেই ফেললাম –“কি ব্যাপার উদয়বাবু আপনি ভীষণ রকম শুকিয়ে যাচ্ছেন যে, চোখে
লাগছে বড়, একবার রক্তটা পরীক্ষা করিয়ে নেবেন।”
শুষ্ক হাসি হেসে বললেন – “ডাক্তার ও
সেকথাই বলেছেন। এবার করিয়ে নেব।” দু-দুবার এমন রক্ত নিয়ে গন্ডগোলের ব্যাপার দেখে
উদয় বাবুর শুধু শরীর ভাঙ্গাই নয়, মনে হল যেন তিনি ভিতরে ভিতরেও ভাঙ্গতে শুরু
করেছেন। ডাক্তার সেই একই ব্যাক্তি যিনি প্রথমবার উদয়বাবুকে রক্তচাপের হুঁশিয়ারি
দিয়েছিলেন। এবার তিনি তাঁর রক্তে সুগারের মাপ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তফাৎ
শুধু এই রোগী তখন পুরোমাত্রায় ডাক্তারের পরামর্শ উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু এবার
সুগারের কথা শুনে রোগী যেন একটু ঘাবড়ে গিয়েছেন। বয়স বেড়েছে না, রক্তের জোড় কমে
আসছে যে! ঊদয়বাবু ভাবেন ওঃ আবার সেই রক্ত!
যার চাপ বাড়লে অসুখ, সুগারের মাপ বাড়লেও অসুখ, এমন আপদ শরীরে আর দুটি আছে কিনা সন্দেহ। সাতপাঁচ ভাবতে
ভাবতে খালি পেটে গিয়ে পাড়ার প্যাথলজিকাল ল্যাবে রক্তদান করে এলেন- সন্ধ্যেবেলা
প্রতিদানে কি পেলেন রিপোর্ট? এতদিন দাপিয়ে
খেয়ে বেড়াবার স্কোর কার্ড। একেবারে ট্রিপল সেঞ্চুরী – রক্তে শর্করার পরিমাণ তিনশতের
ও অধিক। এখন বোঝা গেল তাঁর অমন নধরকান্তি দেহের সমস্ত কান্তি শুষে নিয়ে মাড়াই করা
আখের মত চেহারা কে করল। হাল-আমলে বাঙালীঘরের মহামারী ব্যাধি ডায়াবেটিস্ তথা
মধুমেহ।
ঊদয়বাবুর
সমস্ত সুখ খেয়ে নিল ব্যাধি। খেয়ে বাঁচার সুখ ভুলতে হল তাঁকে। সকাল-বিকাল নিয়ম করে হাঁটা,
দুবেলা কমপক্ষে একঘণ্টা করে হাঁটা তাঁর বরাদ্দ। বাঁচতে গেলে হাঁটতে হবে – এই ছোট্ট
স্লোগানটা যেন জীবনের ব্রত করে নিলেন বিনা বাক্যব্যায়ে। এখন তার হাঁটার পথে কত
খাবারের দোকান, কত মিষ্টির দোকান –কিন্তু দাঁতে কাটা তো দূরস্থান, চোখেও তোলেন না
সে দৃশ্যাবলী। শুধু হাঁটেন আর হাঁটেন। বিখ্যাত গানটা মনে পড়ে যায় – পথের ক্লান্তি
ভুলে স্নেহভরা কোলে তব মা গো...। এই ব্যাধি ধরার পর থেকে ওনার হিল্লি দিল্লী করা
প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। পান্তুয়া বারণ, জিলিপী বারণ, মিহিদানা- সীতাভোগ সে তো এখন
বিষতুল্য তাঁর কাছে। তাই বর্ধমান,রাণাঘাট, শক্তিগড়, মেছেদা এসব এখন আর উদয় বাবুর
যাওয়ার দরকার পড়ে না।
এরই
মাঝে একদিন সকালবেলা হঠাৎ দেখি খন্ডহার চেহারা নিয়ে উদয়বাবু হাওড়ার মিনিতে উঠে
বসেছেন। আমিও ছিলাম একই বাসে। “কোথায় চললেন এত সকালে?” জিজ্ঞাসা করতে ছোট্ট করে বললেন – “মেছেদা।”
আমার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এল – “আবার মেছেদা!” তাঁর লাজুক হাসিমাখা জবাব –“
জিলিপি নয়, কবরেজের ওষুধ আনতে সুগারের”।
আমার সব কথা সেদিন ওখানেই শেষ হয়ে গেল।
মনে মনে ভাবলাম সব খানেতেই রেশন, সব কিছুতেই কোটা, পরম বিধাতা পুরুষ ও এই
নির্মম বিধির বাইরে রাখলেন না কাউকে। এই মানুষটা এত খেতে ভালবাসতেন কিন্তু
বেহিসাবী খেয়ে নিজের কোটাটা আগেই ফুরিয়ে ফেললেন। মিষ্টি খাওয়া তার বন্ধ হয়ে গেল
চিরতরে – শরীরের নোনা রক্ত দুষিত হয়ে গেল এক মিষ্ট দূষণে।
৩
উদয়াস্ত
চলতে লাগল এমনই ছকে ঢালা নিয়মবাঁধা জীবন তাঁর। দেখা হলে সৌজন্যমুলক কুশল জিজ্ঞাসা
করি –“আজকাল কেমন আছেন?” কেমন যেন একটা দমিত, প্রশমিত জবাব দেন – “একটু ভাল।” হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখি উদয়বাবুর সাথে বছর
তিরিশেকের একটি ছোকরা। তিনি আমায় কাছে ডাকলেন – “আলাপ করিয়ে দিই। এটি গোপাল- আমার
ভাইপো; দেশ থেকে আনিয়ে নিলাম। আমি তো আর পারি না। আমার কারবার টাও এবার থেকে দেখবে
ও, কর্মচারীদের দিয়ে কি চলে?” আমি বললাম – “বাহ! ভালই করেছেন।” এমন এক ঢিলে
দু-পাখি মারা উত্তরে দেখি কাকা- ভাইপো দুজনেই খুশি, দুজনেই পরম হৃষ্টচিত্তে মাথা
নাড়লেন। ভাইপো গোপাল যে কেন আমার কথায় এত খুশি হয়ে উঠল তা বুঝতে কোনও অসুবিধা হল
না। ভাইপোর নাম গোপাল শুনেই বাহ! কথাটা মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এল- বাহ! একেই বলে কপালের
নাম গোপাল। নইলে যতদূর জানতাম উদয়বাবুর তিন কুলে দাদা, ভাই, বোন কেউ কোত্থাও নেই। দূর
দেশগাঁয়ে তাঁর বাড়ির লাগোয়া বাড়িতে নাকি এই গোপালের বাস, কচিৎ-কদাচিৎ দেশে গেলে এই
ছোকরা উদয়বাবুর সাথে ছিনে জোঁকের মত লেগে থাকত। আর তাঁরও গোপালের মুখে কাকু ডাক
শোনার জন্য মন আঁকুপাঁকু করত। এইভাবেই ধীরে ধীরে সে নাকি উদয়বাবুর আত্মার
পরমাত্মীয় হয়ে গেছে। অতএব দূর দেশ-গাঁয়ে থাকা রক্তের সম্পর্কহীন গোপাল আক্ষরিক অর্থে উদয়বাবুর দূর-সম্পর্কের ভাইপো।
এটা তাঁর শুভবুদ্ধির উদয় কিনা বলতে পারব না তবে নবদিগন্তে যে ভাগ্যসূর্য্যের উদয়
হতে যাচ্ছে তার জীবনে, সেটুকু বোঝার মত বুদ্ধি গোপালের আছে বলেই আমার বিশ্বাস। গোপালের
জীবনে ক্রমেই তাতঃপ্রেম গাঢ় হয়ে উঠতে লাগল। সাধের ভাইপোটিকে একদম নিজের মত করে গড়ে
তুলতে লাগলেন উদয়বাবু। খবরে প্রকাশ তাঁর অতীতের যত খাদ্যবিলাস সবই গোপালের মধ্যে
চালান করে দিচ্ছিলেন তিনি। আর গোপাল? সে তো পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা জ্ঞানে কাকুর
বিলাসবহুল সাম্রাজ্যের চোহুদ্দির হিসাব মনে মনে কষে চলেছে। চব্য চোষ্য খাচ্ছে,
যেমন টি উদয়বাবু চান ঠিক তেমন ভাবে। আবার বাড়িতে সব সেরা খাদ্যের সমারোহ শুরু হয়ে
গেছে মহা উৎসাহে। পার্থক্য শুধু এই, গোপাল আপন রসনার পরম তৃপ্তিতে চেখে দেখে আর তার
কাকু চরম দর্শণসুখে সে দৃশ্য সামনে বসে দেখে। নিজের ব্যাবসার কাজও গোপালকে ধীরে
ধীরে শিখিয়ে দিতে শুরু করলেন তিনি। চোখের সামনে অতি অল্পদিনেই গোপাল একজন যোগ্য
উত্তরসুরী হয়ে উঠল। তার ভিতর উদয়বাবু আবার তাঁর জলজ্যান্ত ভোজনসম্বৃদ্ধ যৌবনের
প্রতিবিম্বকে খুঁজে পেলেন যেন। জীবনের সনাতন নিয়মে উদয়বাবু হয়ত মঞ্চ ছেড়ে একদিন চলে
যাবেন ঠিকই, কিন্তু হাবেভাবে, স্বভাবে দিনে দিনে তাঁর এই উত্তরসুরীটি আমাদের চোখের
সামনে প্রতি মুহুর্তে উদয়বাবুর ক্লোন্ড প্রতিমুর্তি হয়ে বিরাজ করবে – তার
ভোজনবিলাস, গতরের প্রকাশ, মায় ভুড়ি টা পর্য্যন্ত উত্তরাধিকার সূত্রে গোপাল বাগিয়ে
নিয়েছে ইতিমধ্যেই, বাকি অর্থ-সম্পদের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
এই
দীর্ঘ জীবনচরিত রচনা শেষে মনে হয় আমার তরফে একটা ছোট্ট কৈফিয়ত দিয়ে রাখা ভাল – তা
হল এই বিশিষ্ট ব্যাক্তিটি আমার নিকট প্রতিবেশী বলে তাঁর নাড়ী-নক্ষত্র সব জানতে
কোনও অসুবিধা হয় নি আমার। নিছক কৌতুহল বশত এত তথ্য সংগ্রহ করেছি। তাঁর বিশাল
সম্পদের প্রতি ঈর্ষা বা লোভ কোনটাই ছিল না আমার ।