গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৮ জুলাই, ২০১৯

সপ্তর্ষি সান্যাল

ফেরা


দীঘিকে দেখে হাসি পাচ্ছিল মেঘের। শুধু একটা ঢোলা সাদা নাইটি পড়ে আছে। মাঝেমাঝে শেষরাত্তিরের দিকে চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে এরকম দৃশ্য দেখেছে সে। ঈষৎ পৃথুলা, প্রায় যৌবন পেরোতে শুরু করা আশির দশকের বি-গ্রেড সিনেমার ক্যাবারে ডান্সার বা নায়ককে সিডিউস করতে চাওয়া ভ্যাম্প। তার সাথে দীঘির দূরত্ব এক ফুটের। এক পা। একমুহূর্ত। খুব ছুঁতে ইচ্ছে করছিল। তবু এই দূরত্ব মহাসমুদ্রের। শতাব্দীর। পেরোন যাবে না। পেরোন যায় না।
নারীর দিকে পেছন ফিরল মেঘ। এই জানালা দিয়ে যতটুকু দেখা যায়, গোটা পৃথিবী জুড়ে সন্ধ্যে পড়ছে। মাঠ, শস্যক্ষেত, একটা গরুর বসে থাকা, মাঝেমধ্যে আলো জ্বলতে শুরু করা দু একটা বাড়ি, কুঁড়ে, আলপথ, আলপথ মিশে যাওয়ার রেললাইন। সন্ধ্যের শব্দ। দিগন্তে লাল। দূরে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। মেঘ এখান থেকে দেখতে পাচ্ছে না, শুধু জানে আছে। একটা ফুলও নেই গাছটায়। ম্লান হাসল মেঘ। গোটা আকাশ জুড়ে লাল, শুধু যেখানে থাকার- নেই।
জানো, এখানে ওই সামনের রাস্তাটা দিয়ে যদি হেঁটে যাও, একটা পুকুর পড়বে। একটা গাছ আছে। কৃষ্ণচূড়া। আমি কখনো গাছটায় ফুল হতে দেখিনি আসার পর। মাঝেমাঝে ফেরার সময় আমি ওই গাছটার নীচে বসে পড়ি। সন্ধ্যে হয়, রাত্রি আসে। চারিপাশে পিঁপড়েরা জমা হয়। জোনাকি ওড়ে। পুকুরের পাশ দিয়ে হাওয়া ভেসে আসে। মাছের গন্ধ। ঘুম পায়। যখন দূরে মেয়েরা সন্ধ্যে দেয়, শাঁখ বাজায়, তাদের স্বামীরা, বাবারা ঘরে ফেরে, সবজির, বাজারের শব্দ, ঝুমঝুমির শব্দ, লজেন্স খোলার শব্দ, তখন আমার ভীষণ ঘুম পায়। পুকুরটা পেরিয়ে গেলে আরেকটু দূরে জঙ্গল। একটা পাগল আছে। আমি শুধু দুপুর বেলা দেখেছি, বিভৎস দেখতে। বউ আর বাচ্চা মরে গেছে ওর, ওই পুকুরের জলে ডুবে। দিনে গ্রামে থাকে, আর রাত্তিরবেলা হলেই জঙ্গলে চলে যায়। গুমরে গুমরে কাঁদে পুকুরের ধারে। যারা চলে গেছে, খোঁজে তাদের। আর আমি চমকে উঠিউঠে চলে আসি, বুঝতে পারি, গাছগুলোর মূল মাটির গভীরে ঢুকে যাচ্ছে। আরো গভীরে। তখন ভয় করে। খুব ভয় করে। যদি হারিয়ে যাই? যদি ফিরতে না পারি আর? যদি ওরকমভাবে একা একা জঙ্গলে বসে থাকতে হয়?
জানালা থেকে ফিরে এল সে।

তুমি কেন এসেছ দীঘি?
দীঘি মাথা নামাল। আস্তে আস্তে বিছানায় বসল। বাইরের সন্ধ্যে এখন ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। গোটা ঘরে আলোর ওপর অন্ধকারের দাগ।

শীর্ষেন্দুকে ছেড়ে আসার পর, আমি ট্রেনে কেন উঠে পড়েছিলাম জানি না। মনে হয়েছিল, এখানে, এই স্টেশনটাতে নামা খুব দরকার। হয়ত তোমার সাথে দেখা হবে না, হয়ত তুমি এখান থেকে চলে গেছ অনেকদিন। তবু এখানে নামতে হবে। একবার। কতকিছু পেরিয়ে এলাম। পাশে যারা বসেছিল, পালটে গেল তারা। মুখ, পোষাক। বাইরের দৃশ্য। স্টেশনে ঢোকার আগে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল হঠাৎ। আর ট্রেনটা দাঁড়িয়ে রইল ঘন্টার পর ঘন্টা। আমি নেমে দাঁড়ালাম। তুমি বৃষ্টিতে কখনো একলা একটা ট্রেনকে ভিজতে দেখেছ কখনো? আমি নামতেই ছেড়ে দিল, যেন আমি নামবার অপেক্ষাতেই ছিল। দেখলাম একটু একটু করে চাকাগুলো নড়ছে। লাইনের মাঝখানে ঘাস সরে যাচ্ছে জায়গা করে দিতে। সরে যাচ্ছে ট্রেন। খুব আস্তে আস্তে, আমার থেকে দূরে। 
তোমার বলা ওই পুকুরটার পাশ দিয়ে হেঁটে এসেছি কাল। রাত্রি হয়ে গেছিল। চুপচাপ বৃষ্টি পড়ছিল, আর আমি ভিজে যাচ্ছিলাম। তখনও আস্তে আস্তে সেই ট্রেনটা চলে যাচ্ছে। চারিদিকে রাত আর পুকুরের পাশ দিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে ট্রেনটা চলে যাচ্ছে। একটা গোটা ট্রেন শুধু আলো দিয়ে তৈরী। 

আস্তে আস্তে মেঘের অনেকদিনের পরিচিত কাঁধে আঙ্গুল ঠেকাল দীঘি। 

অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি এখানে। একহাজার মাইল। একটা সমুদ্র। এক শতাব্দী। নিজেকে। ফিরিয়ে দিতে চাও, দিও। কিন্তু আমি বাড়িতে ফিরতে চাই। সকলের ফেরার একটা বাড়ি চাই, কোথাও। আমাকে আরেকবার বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না মেঘ?