গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৯

সুদীপ ঘোষাল

কাঁদরের কান্না


বেশি কৌতূহল ভালো নয়। তেনাদের নিয়ে আলোচনা করলে হয়তো তাদের ভালো লাগে। তাই তারা দল ভারি করার জন্য দলে টেনে নেয়। অপদেবতাদের বিচরণভূমি কাঁদরের ধারে,পোড়ো বাড়ির ভিতরেকিংবা জনকোলাহলহীন যে কোনো জায়গা হতে পারে।।অশুভ শক্তি এক জায়গায় জড় হয়ে নাচ করে ভূত চতুর্দশীর রাতজুড়ে। এইসব কথা দাদুর মুখে শোনা।
তিনি বলতেন,অপমৃত্যু হওয়া আত্মাগুলো সহজে মুক্তি পায় না। সেইসব আত্মা ঘুরে বেড়ায় অতৃপ্ত মনে। দাদু বলতেন,বামুন পাড়ার বিমানদাদু গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। তিনি রাজা উজিরের মত থাকতেন। বিরাট আলখাল্লার আড়ালে তার দারিদ্র্য ঢাকা থাকতো।মন তার তৃপ্ত ছিলো না। প্রতিরাতে নেশা করতেন।আরও অনেক দোষ ছিলো।
কাঁদরের ধারে একটা বেলগাছ ছিলো। দাদু বলতেন, এই বেলগাছের পাশে একটা শিমূলগাছ। বহু বছর ধরে আছে। সেখানে একদিন পথকুড়ো ফুল কুড়োতে কুড়োতে যাচ্ছিলো।পথকুড়ো দেখলো,সেই শিমূল ফুল তার হাতে এসে হয়ে গেলো শিশুর মাথা। ভয় পেয়ে ছুটে এসে পড়লো ঘাটে। সেই ঘাট থেকেই একেবারে গঙ্গার ঘাটে।
পথকুড়ো  মরার পরে আর কেউ ওদিকে তাকাতো না। প্রয়োজন হলেও ও পথে পা বাড়াতো না। সবাই বলতো,ওখানে অপদেবতাদের বাস। ওখানে গিয়ে ওস্তাদি করলেই সর্বনাশ হবে।
দাদু দেখেছেন একদিন সকালে ওই শিমূল গাছে বিমান পাঠক গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছিলো রাজার বেশে।
দাদু কাঁদরের এপাড় থেকে একরাতে দেখেছিলেন, যাত্রার আসরের মত জাঁকজমক। বিমান তার পোশাক পড়ে রাজার মেজাজে ঘুরতো। লাফিয়ে বেলগাছে উঠতো। দাদুর সঙ্গে আরও দুজন সাহসী লোক ছিলো। তারা দেখলো,জীবনে বিমান শখ আহ্লাদ পূরণ করতে না পারলেও অপদেবতাদের আসরে তার কোনো শখ অপূর্ণ থাকতো না।
ভূতের ভয় লাগে নি দাদুর।পালাগান শোনার মত অপদেবতাদের গান শুনেছেন। বললে,অনেকে বিশ্বাস করে না।
দাদু প্রায় প্রতি রাতে একবার করে কাঁদরের পাড়ে ঘুর ঘুর করতেন। এই দাদু পাড়ার সকলের প্রিয় ব্যাক্তি। গ্রামের লোকে বলতো,এত সাহস ভালো লয় গো। রাত বিরেতে কেনে ওখানে মরতে যাও। কোনোদিন দেখবা তোমার দশাও পথকুড়োর মত হবে।
দাদু শুনতো না। সাত কুলে তার কেউ নাই। তাই ভয়ও নাই। এর বাড়ি ওর বাড়ি খেয়ে দিন গুজরান হত দাদুর। কেউ বিপদে পড়লে জান দিয়ে তার সেবা করত।তাই তো গ্রামের সকলে তাকে মাথায় করে রাখতো। দাদু প্রায় চেঁচিয়ে  একটা কথা বলতেন,পালাবার পথ নাই, যম আছে পিছে। মরণকে তার ভয় ছিলো না। তিনি বলতেন, বেঁচে থাকার চেয়ে মরণের পরে বেশি সুখ। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন না বেশি কথা। তিনি বলতেন,অপদেবতাদের অনুভূতি অন্তরে হয়। প্রকাশ করা যায় না।
তিনি তার ছাত্রজীবনের কথা আমাদের বলেছিলেন।
একবার তার বন্ধু বিশু আর কয়েকজন রাতে কাঁদরের ধারে গেছিলো।বিশু ডুব সাঁতারে ওপাড়ে চলে গেলো। দাদু ছিলো এপাড়ে।তারপর অপদেবতা তাকে তুলে নিয়ে গেলো বোধহয়।বাড়ি থেকে পুলিশে খবর দিলো। 
সবাই আমরা উৎকন্ঠা নিয়ে বসে আছি। কখন আসবে বিশু। ঠিক সকাল দশটায় পুলিশের গাড়ি চলে এলো গ্রামে। আমাকে সবাই অবাক হয়ে দেখলো পুলিশের গাড়ি থেকে নামছি আমি।
এর মধ্যে বিশুও হন্ত দন্ত হয়ে আমাদের কাছে এসে বললো,যাক কাকু, অলক এসে গেছে। মেজবাবু আমার বাবাকে বললেন,এটাই আপনার ছেলে অলক তো?
---- হ্যাঁ স্যার।
----আমাদের থানার আশেপাশে ঘুরতে দেখে ওকে নিয়ে এলাম। আমাদের স্থির বিশ্বাস ছিলো এটা অলক। ওর মুখে সব কিছু শুনলে বুঝতে পারবেন ওর সমস্যা। যাই হোক, আমরা আসি।
পুলিশের গাড়ি চলে গেলো। প্রায় দুঘন্টা হলো দাদু ঘুমিয়ে আছে। দুপুর একটায় ওর ঘুম ভাঙ্গলো।বিশু জিজ্ঞাসা করলো,তোর কি হয়েছিলো বল তো অলক?
দাদু বলতে শুরু করলো তার অলৌকিক কাহিনী।
সে বললো,আমরা সবাই যখন কাঙরা  কাঁদর পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই আমাকে খনা গলায় নিশি ভূতটা বললো,কি রে তোর বাড়ি গিয়ে ডাকলাম। সাড়া পেলুম না। তাই গন্ধ পেয়ে এখানে এলাম। চল আমার সঙ্গে তোকে হাওড়া ব্রীজ দেখিয়ে আনি। আমি বললাম,এই রাতে বন্ধুদের ছেড়ে আমি হাওড়া যাবো না। নিশিটা বললো,যা বলবো শুনবি।তা না হলে উঁচু থেকে ফেলে দেবো।আমি আর ভয়ে কথা বলিনি। নিশি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো হাওড়া ব্রীজে। আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। তারপর যখন নিশিটা আমাকে নিচে নামালো তখন জ্ঞান এলো। নিশি বললো,কেমন লাগছে। কি খাবি বল। তারপর আবার বললো,গঙ্গার জলে সাঁতা কাটবি নাকি?
আমি বললাম,আমি সাঁতার জানি না।
নিশি বললো,আমি থাকলে ওসব কিছু দরকার হয় না। এই বলে আমাকে ওপর থেকে গঙ্গার বুকে ঝুপ করে ফেলে দিলো।তারপর জামাটা মুঠো করে পুতুলের মত তুলে নিয়ে ওপরে এলো।আমি ভাবলাম, আমার জীবনের শেষ দিন আজকে। নিশি মনের কথা জানতে পেরে বললো,আমরা প্রাণে মারি না কাউকে। শুধু ঘুরে বেড়াই।কাজ করি। তারপর দিনের আলো ফুটতেই নিশিটা পালিয়ে গেলো।
এতদিন দাদু বেঁচে ছিলো অপদেবতাদের গবেষকের মত। সবসময় তাদের নিয়েই ছিলো ভাবনা চিন্তা। আমাদেরও সময় কাটতো ভালোভাবে। এবার তার অপদেবতাদের দলে নাম লেখাবার শখ হলো। আমরা সকলে বললাম,দাদু এত ভয় দেখালে আমরা আর আসবো না তোমার কাছে।দাদু সত্যি কারের গবেষক ছিলেন। কারও কথা শোনেন নি। একরাতে তিনিও শিমূলগাছে ঝুলে পড়লেন।
এই প্রিয় দাদু সেইরাতে আমাদের ছেড়ে একদম পুরোপুরি আশ্রয় নিলেন তাদের ডেরায়...