গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৯

চন্দ্রাণী গোস্বামী

পরাণ যাহা চায়


সাতমহলা মেঘের বাড়িতে দক্ষিণদিকের একখানা ঘর আজকাল বন্ধই থাকে। বৃষ্টিরা বলাবলি করে, ঘরখানা নাকি বন্ধ্যা। দুয়ারের কড়ায় বহুদিন কারুর হাত পড়ে না, কেমন একাকী আনমনা উদাস কড়াটা। আলগোছে তোলা শিকলে দীর্ঘদিনের অভিমান জমতে জমতে মরচে পড়ে গেছে ইদানিং। দিনের বেলার রোদ্দুরের আড়ি চলে ঘরটার সাথে, আর রাতে নিশীথ আরো ঘন হয়ে লেগে থাকে ঘরের সর্বাঙ্গ জুড়ে। ঘরটার সামনের দুয়ারে কে কবে একটা লাল টিপ দিয়ে গিয়েছিল। আজকাল ফ্যাকাসে পানা হয়ে ঘরের দুয়ার জানালা ছাপিয়ে ঘরখানাকে কেমন যেন বিধবা দেখায়। ভালো-মানুষ মেঘরা বলে ঘরটা নাকি অলক্ষ্মী।
একদিন কোত্থেকে একটা কুটকুটে কালোপানা ঝুপপুস জল ভর্তি মেঘ ক্লান্ত হয়ে এসে দাঁড়ালো ঘরখানার দুয়ারে। জানা নেই শোনা নেই, আগাম আভাসও নেই তবু অলক্ষ্মী দুয়ারটা কেঁপে উঠলো ভীষণ। অনভ্যস্ত নিজের হাতে গুছিয়ে নিতে চাইলো ভেতর ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে লেপ তোষক। বহুদিন হলো আর ঘাতক রোদ জিরোয় না ঘরের বুকে। অলক্ষ্মী ঘর প্রাণপণ চাইলো পলাতক হতে। দুয়ার আগলে কে বসে! সে কি দুঃখ না কি অলক্ষ্মীর প্রণয়ী --- যে ডাকার পূর্বেই চলে আসে! যে সেই কালো মেঘ।
ভেসে যাচ্ছে অলক্ষ্মী ঘরটা। এমন ঘন কালো মেঘ সে কখনো দেখেনি। দেখেনি কালো বুকের এমন দিল-কেতাবি নুরানী সুরত আলো। এমন আলোর গর্জন শুনেই বুঝতে পারে সেই বিরহী প্রেমিক। কি করবে এখন বন্ধ্যা ঘরটা? কালো মেঘে গর্ভিনী হবে? ঝুপপুস সেই জলে ভিজতে ভিজতে আবার কাজল আঁকবে তার স্বপ্ন সম্ভব চোখের পাতায়! আশ্লেষে ভেসে যেতে যেতে, বহুদিন বাদে একটা গাঢ় লাল টিপ পড়ে বন্ধ্যা অলক্ষ্মী ঘরটা। শরীরে বিছিয়ে দেয় ডিমের কুসুমরঙা আলো, চন্দনগন্ধী আতরে করে কালো মেঘের বুক। ধূপছায়া রঙ ছাপিয়ে আজ অলক্ষ্মী ঘরটা টুপ করে খসে পড়ে মেঘের অতল ঘন জলের ভেতর।
"সখি কি পুছসি অনুভব মোয়।
সোই পিরীতি অনুখন বাখানিতে
তিলে তিলে নূতন হোয়।"
এমন স্বপ্নের পাণ্ডুলিপিই তো লিখতে ইচ্ছে করে বড়ো আমার। ইচ্ছে করে এমন একটা বন্ধ্যা ঘরের বুকে প্রবল ভাবে আছড়ে পড়ুক বৃষ্টির জলকণা।কেউ না হয় না জানুক, অলক্ষ্মী ঘরটা অনন্ত একবার জানুক কালোমেঘের বুকে আকুল ভিজতে পারে তার বহু জন্মের জন্মান্ধ চোখ।