গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৯

ইন্দ্রনীল সুমন

অনিকেত

                                   ১

  মানিকতলার ঘিঞ্জি এলাকার তিনতলা বাড়িটার ওপরতলায় একটাই ঘর| ঘরে বেশ উঁচু খাটে শুয়ে আছে সুজন| জানলা ভেজানো থাকায় ভরদুপুরেও ঘর আবছায়া| মাথার উপরে ডিসি ফ্যানটা একঘেয়ে আওয়াজ করে ঘুরছে| দেয়ালে টাঙানো গুরুদেবের ছবির পেছন থেকে মোটা টিকটিকিটার লেজ বেরিয়ে আছে| পায়ের আওয়াজে বোজা চোখদুটো একটু ফাঁক করে সুজন, বৃন্দাকাকু ঢুকছে| দুহাত ছড়িয়ে কাঁধের বাঁকটার ভারসাম্য রাখছে, দুটো গনেশ মার্কা তেলের টিন ভর্তি জল নিয়ে ঘরে ঢুকে ডানদিকে সোজা চলে গেল| একটা দরজা| পেরোলেই ছাদ| ছাদের কোনায় বাথরুম, তার চৌবাচ্চাটা ভরতি করতে এখন বারচারেক তিনতলা ওঠানামা করবে বৃন্দাকাকু! আধো অন্ধকারেও সুমন বুঝতে পারে বৃন্দাকাকুর কপালে লাল তিলক কাটা, চোখদুটো লাল! ছোট্ট সুজন ঠিক জানে চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকালেই চোখদুটো বিরাট সুড়ঙ্গ হয়ে যাবে, আর সুজন তার মধ্যে পড়ে যাবে, প্রচন্ডগতিতে পড়তে পড়তে সুজন শুনতে পাবে কেউ গম্ভীর গলায় বলছে,”দুষ্টু করেনা খোকাবাবু! তাহলে কিন্তু আমি ধরে নিয়ে যাবো এই জলের টিনে করে, জলের দেশে, সেখানে গেলে কিন্তু কেউ ফেরেনা!” চোখদুটো দুহাত দিয়ে খুব জোর চেপে রাখে সুজন| তবু টের পায় ঘরের কোনায় ছোট্ট সেলফের উপরে রাখা কাঠের বাঘটা মাথা দোলাচ্ছে, আস্তে আস্তে ।


দুপায়ের বুড়ো আঙুলের উপর একটু উঁচু হয়ে দাঁড়ালো সুজন, হাতদুটো দিয়ে রেলিং ভর দিলো, অনেক নিচে অনেকগুলো টালির চাল| মাঝেমাঝে চিলতে রাস্তা| মানুষজনের যাতায়াত দেখা যাচ্ছে আর শোনা যাচ্ছে কাঠচেরাইয়ের আওয়াজ| একটানা, ঘ্যাষঘেষে, একঘেয়ে| ধোঁয়ার কুন্ডলী উঠছে টালির চালের পাশ দিয়ে| কারখানা থেকে ফিরেছে বাসিন্দারা, চেরা কাঠ দিয়ে ধরিয়েছে উনুন| রাতখাবারের ব্যবস্থা হবে| সূর্যটা খালপাড়ের ওপারে ডুববে বলে তোড়জোড় করছে| অনেক নিচে টালির জ্যামিতিক ছক আর খালপাড়ের ডিমকুসুম আকাশ মিলেমিশে আঁকার ক্লাসের ক্যানভাস তৈরি করেছে| সুজনের ভালো লাগছে| সুজন বোঝে বড় হচ্ছে| বৃন্দাকাকুকে আর ততটা ভয় পাচ্ছে না আজকাল| একঘেয়ে কাঠচেরাইয়ের আওয়াজটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে, একটা ছন্দ আছে আওয়াজটায়!


এটা সুজনের মাসির বাড়ি| মা সুজনকে নিয়ে বছরে কয়েকবার এখানে এসে কিছুদিন করে থাকে| ওর বাবা ওইসময় কোথাও চলে যায়, কিছুদিনের জন্য| সুজন শুনেছে ওর বাবা রাজনীতি করে, তাইআন্ডারগ্রাউন্ড যেতে হয়| মা খুব ভয় পায় এই একলা সময়গুলোতে| এই বাড়ির তিনতলাটা যেন শহরের মধ্যে হলেও বিচ্ছিন্ন! শহরের গন্ধ ট্রামের ঘন্টি দোতলা বাসের ধোঁয়া মিছিল শ্লোগান কোনোকিছুই এই ঘরে ঢুকতে পারেনা| মা- ভয়টা শুধু ঢুকে আসে মা- সঙ্গে, সুজন দেখে| প্রতিরাতে ঘুমোনোর আগে মা জামাকাপড়ের ব্যাগের চেনটা খোলে, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ব্যাগের ভিতরে, দেখতে থাকে ভিতরটা...অন্যমনস্ক| সুজন জানে মা ব্যাগের ভিতরে নিজের বাড়িটা খুঁজছে| গড়িয়ার একঘরের বাড়িটা, ছোট্ট বারান্দা, সন্ধ্যামালতী ফোটা উঠোন| মা- মুখটায় ভয় আঁকা হচ্ছে, তীব্র নীল রঙের ভয়ের একটা মশারী মা- মুখটাকে আড়াল করছে| সুজন আর মা- মুখটা দেখতে পায় না| সুজন ঘুম হয়ে যায়, সুজন স্বপ্ন হয়ে যায়! সুজন দেখতে পায় মেসোমশাই সন্ধ্যাবেলায় তেলেভাজা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন, মেজমাসী চা বসিয়ে তেলমুড়ি মাখছে, মা মেসোমশাইকে জিজ্ঞাসা করছে শহরের কথা, বাবার কথা, বাবা না কি মেসোমশাই এর কারখানায় কখনোসখনো আসে, খবরাখবর নেয় ওদের, চা খেয়ে চলে যায়| মেসোমশাই এর এই কথাগুলো মা যখন শোনে তখন মা- মুখে একটা আলো পরে, ভোরের আলো| সে সময়টুকু মা- মুখটা ভয়হীন হয়ে যায় ।


মাসির জ্বর এসেছে কাল রাত থেকে| মাঝেমধ্যেই আসে, খুব ভোগে মাসি| শুয়ে থাকে| মা রান্না করে সেইদিনগুলোয়| আজ মাসির জন্য শিঙমাছের ঝোল আর ভাত নিয়ে আসতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে মাসি| খাবে না| সুজন দেখেছে আজকাল মাসি মা- সঙ্গে ঠিক করে কথা বলে না| সবসময় মেজাজ দেখায়| দফায় প্রায় মাসছয়েক হল ওরা এখানে আছে| জরুরী অবস্থা বলে কিছু একটা শুরু হয়েছে দেশে| বাবার গড়িয়ায় ফেরা সম্ভব হচ্ছে না| এতদিন এখানে থাকাটা যে মাসির ভাল লাগছে না সুজন সেটা বোঝে| মেসো কিন্তু সেরকম ভাবেন না, খুব ভাল করেই কথা বলেন মায়ের সঙ্গে| তাতে আরও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে মাসি| একদিন মা- গান শুনে মেসো বলেছিলেন, “তুমি গান শেখাটা ছাড়লে কেন নীতা? বড় ভালো তোমার গলাটা|” মাসির মুখটা দেখেছিল সুজন, মুহূর্তে পালটে গেছিল, “থাক! আর গান শিখে কাজ নেই, আগে নিজের সংসারটা করুক গুছিয়ে|” চুপ করে গেছিল মা| অথচ সুজন দেখেছে গড়িয়ায় বাড়িতে মা স্নান সেরে শীতের রোদ পিঠে নিয়ে উঠোনে বসে খালি গলায় গাইছে একটার পর একটা গান, মা- থেকেই শুনেছে এই সমস্ত গান যিনি লিখেছেন তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ, তিনি না কি মস্ত মানুষ! বিরাট এক আশ্রম বানিয়েছেন, সেখানে সুজনের মায়ের মতো অনেক ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখেছে, নাচগান শিখেছে, মানুষ হয়েছে| সুজনের মনে পড়ে মা যখন গাইতো, “মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো রে, দোলে মন অকারণ হরষে”--- তখন মায়ের সঙ্গে নেচে উঠত উঠোনের কোনার টগর গাছের নতুন পাতাগুলো! মা বলতো, “দেখ সুজন দেখ, পাতাগুলো খুশিতে কেমন হাসছে দেখ!” সুজন মুগ্ধচোখে দেখত মা আস্তে আস্তে টগর গাছ হয়ে যাচ্ছে, মা- ছড়ানো হাতের উপর এসে বসছে ছোট্ট ছোট্ট পাখি, তিরতির কাঁপা লেজগুলো নিয়ে তারা উড়ে বেড়াচ্ছে ডাল সে ডাল! খুশিটাকে ধরে রাখতে চোখ বোজে সুজন| চমকে তাকায়, মাসি বিশ্রীভাবে চিৎকার করে বলছে মাছ খাবে না| সুজন দেখে মাসির রোগে ভোগা শুকনো মুখটায় ভয়ের ছায়া| মাসি মায়ের দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে| মাসিও যেন দেখতে পাচ্ছে মায়ের টগর গাছ হয়ে যাওয়াটা! মাসির রুগ্ন শরীরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে! সুজনের অস্বস্তি হয়| মনে হয়ে ঘরে হাওয়া কমে আসছে| এখুনি একবার ছাদে যেতে পারলে ভালো হত| আকাশ দেখতে ইচ্ছে করছে ওর| বড় একটা আকাশ!



সুজন ছাদের কোনায় রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে| সামনে দুই পা করে বসে বৃন্দাকাকু, বাঁ হাতের তালুতে দোক্তাপাতা আর চুন, ছাদের মেঝের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে| সুজনের মাথায় ঘুরছে বৃন্দাকাকুর কথাগুলো| কাকুর বাবা যুবক বয়সে এসেছিল সেই সুধন্যখালির গ্রাম থেকে, হালদারদের রঙকলে কাজ করতে, কারখানার পাশের ময়লাফেলার জমিটা তৈরি করে বেড়ার ঘর, টালির চাল, সব হালদারমশাইয়ের ব্যবস্থায়| এরপর একে একে বৌ সংসার বাচ্চাকাচ্চা| বৃন্দাবন সরদার বাপমায়ের তৃতীয় সন্তান, চার ক্লাস অব্দি পড়েই কারখানাগেটের চা-দোকানে কাজে লেগে যায়, তারপর রঙকলের লেবার, বছর তিনেক আগে হালদারমশাই মার্ডার হন কারখানার সামনেই, হালদারদের বড়ছেলে ভেটেরিনারি ডাক্তার, ব্যবসায় মন নেই কোনোকালেই, বাবার অপঘাতে মৃত্যুর পরে সব বেচে দিয়ে ভদ্রেশ্বরের ওদিকে গঙ্গার পাড়ে বাড়ি কিনে উঠে গেছে, ওদিকেই পসার বেশি| কারখানা বন্ধের পরে এই জলের কাজ করেই সংসার চালায় বৃন্দাবন| অনেকদিন ধরেই কানাঘুষো শুনছে নতুন মালিক না কি গয়া জেলার লোক, বড়বাজারে গদি আছে তিনপুরুষের, সেই মালিক এসে কারখানা খুলবে নতুন করে, লোহার পার্টসের কারখানা| বৃন্দাবনের মতো পুরনো লোকেরা ভয়েই ছিল নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে, তারই মধ্যে গেল হপ্তায় গৌরীবাড়ির এক মস্তানের ছেলেরা এসে বলে গেছে সব ঘর খালি করে দিতে, নতুন মালিক পান্ডেজি নতুন লেবার আনবে দেশ থেকে| তারাই কাজ করবে কারখানায়, কাজেই এই ঘরগুলোও তাদের হবে| হালদারদের থেকে কেনার সময় সেরকমই না কি বন্দোবস্ত হয়েছে| একমাস সময় দিয়ে গেছে ওরা ।
সুজন একদৃষ্টে দেখছিল বৃন্দাকাকুকে| সমর্থ লোকটা কেমন ভেঙে গেছে কদিনেই, অসংখ্য ভাঁজ পড়া মুখে ছাইরঙা ছায়া, ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া শরীরটাকে দেখে মায়া হচ্ছে সুজনের| অস্ফুটে বলে, “তুমি বরং সুধন্যখালিতে ফিরে যাও কাকু|” মুখ তোলে বৃন্দাবন, বিড়বিড় করে বলে, “সুধন্যখালি! জলের দেশ! সে তো অনেকদূর!” সুজনের মনে পড়ে যায় গড়িয়ার বাড়ির উঠোনটার কথা| গলার কাছটায় দলা পাকিয়ে ওঠে| বৃন্দাকাকুর চোখের থেকে আড়াল পেতে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সুজন, আকাশের দিকে ।