গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৯

আফরোজা অদিতি

কমল-সরোবর


    আরামপ্রিয় চড়ুই-পাখিরা কখনও পুরানো ছাদের চিলেকোঠার ফাঁকফোকরে কিংবা জনচলাচলহীন নির্মণাধীন দালানবাড়ির কোন কোণাতে বাসা বাঁধে। কিংবা কোন পাখি-প্রেমিক পাখির জন্য খাবার এবং বাসা বাঁধার সরঞ্জাম রেখে দিলে সেখানেও পরম নিশ্চিন্তে বাসা বাঁধে কখনও-সখনও! মগবাজারের একটি বাসায় একটি নতুন ফুলের টব অনেকদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে; পাখির বাসা বানানোর জন্য ছিল না টবটি। এই বাড়ির গিন্নী-মায়ের নানা রকম ব্যস্ততার কারণে টবে মাটি ভরা হয়নি; গাছ লাগানো হয়নি! এটি খালি দেখে আর পছন্দসই জায়গা না পেয়ে ঐ ফুল গাছ লাগানোর জন্য ঝুলিয়ে রাখা  টবে বাসা বেঁধেছে চড়ুই-দম্পতি! আর এই বাড়ির গিন্নী-মায়ের বিশ্বাস যে বাড়িতে পাখি বাসা বাঁধা সে বাড়িতে  শান্তি বিরাজ করে! তাই ফুলের টবে চড়ুই-দম্পতি বাসা বাঁধার পরে ওদের উড়িয়ে না দিয়ে টবের সম্মুখে একটি ছোট্ট কাঠের টুকরা বেঁধে দিয়েছেন; সেখানে রোজ ওদের জন্য পানি আর খাবার রেখে দেন।  

     ফুলের টবের ঐ পাখির বাসাটিতে চারটি ছানা হয়েছে। বাবা-মা দুজনেই পালা করে ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়েছে; এখন দেখভাল করছে। পাখি-মায়ের খুব ইচ্ছা বাচ্চারা সব সময় তাদের কাছেই থাকবে; শক্তপোক্ত হলেই যেন উড়াল দিয়ে চলে না যায়। পাখি-সমাজের রীতি যে চোখ ফুটলে, ডানা গজিয়ে ওড়ার মতো হলে, আর খাবার জোগাড় করে খুঁটে খেতে পারে এমন শক্তপোক্ত হলেই বাচ্চারা উড়ে চলে যায়; বাবা-মাও আর কাছে রাখে না তাদের। বিদেশে এমনি হয় শুনেছে পাখি-মা; শিশুবয়স অতিক্রান্ত হওয়ার পরে কোন সন্তান যদি বাবা-মায়ের কাছে থাকতে না চায় তবে তারা আর সন্তানের কোন কাজে বাধা দিতে চান না! অবশ্য ছোটবেলা থেকে সেভাবেই বড় হয়ে ওঠে সে দেশের বাবা-মায়ের সন্তানেরা। কিন' পাখি-মা থাকে বাংলাদেশে; এদেশের  সমাজ সেরকম নয়; এখানে পারিবারিক বন্ধন খুব দৃঢ়। পাখি-মায়ের ইচ্ছা এদেশের পারিবারে যেমন সকলে একত্রে থাকে তেমনি ওরাও সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে জড়িয়ে- পেঁচিয়ে একত্রে থাকবে সারা জীবন।

     মা-পাখি সেই ভাবনায় কখনও গাছের ডালে বসে কখনও বারান্দার গ্রীলে বসে ঘরের ভেতরে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে দেখেছে বাড়ির গিন্নি-মাকে, কেমন করে তিনি তার বাচ্চাকে আদর করেন, খাওয়ান, চুল আঁচড়িয়ে কাপড়-জামা পরিয়ে দেন! তাই দেখে পাখি-মায়ের ইচ্ছা তেমনি সে-ও আদর করে কাছে রাখবে তাদের বাচ্চাদের; পাখি-মা তার মনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে কখনও তার চিকন ঠোঁটে বাচ্চাদের অগোছালো পালক পরিস্কার করে গুছিয়ে দেয়; কখনও বা ডানা সাপটিয়ে বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে আদরের পরশ দেয়। এভাবেই দিন যায়; বাচ্চারা একটু একটু করে বড় হতে থাকে।  

     একদিন বাসার অপর পাশে একটি বাড়ির ছাদের কার্নিশে ভোরের আলো গায়ে মাখতে মাখতে চড়--বাবার সঙ্গে কথা বলছিল চড়ুই-মা। দেখ আমাদের বাচ্চাদের কোথাও যেতে দিব না আমি।পাখি-মায়ের কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে চড়ুই-বাবা বলে, ‘তা কী করে হয় বউ, আমরা তো সে ভাবে বাঁচতে-থাকতে শিখিনি।বাবার কথায় অভিমানী মা বলে, ‘তাতে কি! এতোদিন থাকিনি বলে এখন থাকা যাবে না তা তো নয়!
     চড়--বাবা তার স্ত্রীর অভিমান এতোটুকুও সহ্য করতে পারে না। একটু কাছে সরে এসে স্ত্রীর ডানায় ডানা লাগিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলে, ‘শোন বললেই তো হবে না, একটু চিন্তা করে দেখি; সমাজ পরিবর্তনের ভাবনা ভালো কিন্তু পরিস্থিতি পরিবেশ বুঝতে হয়, হুট করে সব কিছু করা যায় না।স্বামীর কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পাখি-মা বলে, ‘তুমিও জান,আমিও জানি কোন কিছু পরিবর্তন চাইলে প্রথমে শুরু করতে হয়; শুরু করার পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়; আমরাও তাই করবো। আগের থেকে যদি ভয় পেয়ে শুরুই না করি তবে কীভাবে পাখি-সমাজের পরিবর্তন করতে পারবো আমরা!একটু থেমে পাখি-মা আবার বলে, ‘তুমি যাই বলো আমরা থাকি বাংলাদেশে; এই দেশের পারিবারিক নিয়ম-কানুন, রীতিনীতি মেনে চলাই তো আমাদের উচিত, আমরা এতো সুন্দর পারিবারিক বন্ধন কেন বিসর্জন দিবো বলো!এই কথাতে বিপদে পড়লো পাখি-বাবা। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘সোনাবউ, আমরা তো মানুষ নই, আমরা পাখি। পাখি-সমাজের রীতি-নিয়ম কী করে বিসর্জন দেই বলো। তাছাড় বয়স বাড়ছে; কতোদিন শরীরের শক্তি থাকবে তুমিই বলো, ওদের যে কাছে রাখবো কী খাওয়াবো, কীভাবে খাওয়াবো?’ এই কথা শুনে উত্তেজিত স্বরে বলে পাখি-মা, ‘কেন আমরা খাবার সংগ্রহ করবো, খাবার সংগ্রহ করবে ওরাও। পরিবারের সকলে মিলে খাবার সংগ্রহ করবো; সকলে মিলে খাবো।
সেটা ঠিক আছে কিন্তু কয়দিন! যখন ওদের সঙ্গী জুটবে তখন।পাখি-বাবার এই কথাতে পাখি-মায়ের চোখে জল এলো। এরপর পাখি-মা চোখ মুছে চুপ করে থাকে। চোখে জল এলে পাখি-মা আর কোন কথা গুছিয়ে বলতে পারে না!

    একদিন পাখি-মা আর পাখি-বাবার কিচিরমিচির খুব ঝগড়া হয়ে গেল! কারণ পাখি-বাবা তার সন্তানদের চলে যেতে বলেছে আর পাখি-মা বাধা দিয়েছে। কিন' পাখি-মা শেষ রক্ষা করতে পারেনি; সন্তানেরা বাবার কথামতো মায়ের জলচোখ উপেক্ষা করে উড়াল দিয়ে চলে গেল।        


     বেশ কিছুদিন পরে এক শীতের সকালে অনেকগুলো ছোট ছোট চড়--এর সঙ্গে এলো পাখি-মায়ের ছোট্ট ছেলেটি। বাবা-চড়ুই বাসাতে  নেই; বাতাসে ডানা ভাসিয়ে আকাশ আর গাছের ফুল-পাতার রঙ দেখতে গিয়েছে, গিয়েছে শীত-ভোরের ঘ্রাণ নিতে। যাবার সময় মা-চড়ুইকে অনেক সাধ্য-সাধনা করেছে কিন্তু চড়ুই-মা ছেলেদের চলে যাওয়ার নীলকষ্ট থেকে বের হতে পারেনি তাই বাসাতেই থাকে সবসময়! আজও ছিল।

     ছেলেকে দেখেই চিনতে পেরে বাসা থেকে বেরিয়ে উড়ে গিয়ে বসলো গ্রীলে। ডানা ঝাপটিয়ে ডাকলো ছেলেকে; ছেলে কাছে এলে তাকে ডানায় ঢেকে বলল, ‘কোথায় ছিলে বাবা এতোদিন? মায়ের কথা মনে পড়েনি সোনা বাবা!মায়ের কথা শুনে ছেলে সঙ্গীদের দেখিয়ে বলল,‘আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম মা। আমার জন্য চিন্তা করো না, আমি এখন খাবার-দাবার নিজেই জোগাড় করতে পারি।
তা পারো! আমি জানি তুমি পারবে; তবুও কী সোনা, মায়ের চিন্তা কমে; কমে না বাবা। তাছাড়া তোমাদের জন্য আমার মন কেমন করে! কিছুতেই মনকে সামাল দিতে পারি না সোনা!মায়ের এই কথা শুনে ছেলে তার চিকন ঠোঁট মায়ের ডানাতে রেখে বলে, ‘কেন এতো চিন্তা করো মা? ওদের মা তো চিন্তা করে না। ওদের ডাকেও না। তুমি ডেকেছিলে বলেই আমি এসেছি।
ছেলের কথা শুনে একটু হেসে মা বলে, ‘বোকা ছেলে, আমি ডেকেছি তাই এসেছ, আমার জন্য মন কেমন করে না তোমার সোনা?’ মায়ের এই কথাতে লজ্জা পায় ছেলে। কি বলবে ভেবে না পেয়ে হড়বড় করে বলে, ‘মন কেমন করেছে, তুমি ডেকেছো আর আমি এসেছি।
ছেলের লজ্জাবনত অবস্থা দেখে হাসে মা। বলে, ‘থাক আর সাফাই দিতে হবে না! তোমার আর ভাইয়েরা কোথায়?’ মায়ের ভেজা কণ্ঠে ছেলের মনটা ভিজে যায়। বলে, ‘মাগো, ওরা আমাকে ফেলে অনেক আগেই চলে গেছে। আমি এখন বন্ধুদের সঙ্গে থাকি।ছেলের জবাবে চোখের জলে ভিজে যেতে থাকে মায়ের বুক; কিন' পাষাণে বুক বেঁধে মা  বলে,‘তোমার ভাইয়েরা এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারলো তোমার সঙ্গে। তুমি ওদের সবার ছোট, আর তোমার সাথে এই আচরণ!
মা এই তো নিয়ম। আমাদের পাখি-সমাজের এই তো নিয়ম। তুমি কি মা এতোদিনকার এই নিয়ম ভাঙতে পারবে, বদলাতে পারবে? বহুদিন ধরে চলে আসা সমাজের রীতিনীতি তো একদিনে বদলানো যায় না মা! আর একা একা কোন নিয়ম ভাঙাও যায় না মা। যে কোন নিয়ম-রীতি-প্রথা ভাঙতে হলে লড়াই করতে হয়; সংঘবদ্ধ লড়াই!ছেলের কথা শুনে একটু হেসে বলে মা, ‘অনেক বড় হয়ে গেছে আমার সোনা। ছেলেকে আদর করলো একটু তারপর বলল, ‘ঠিকই বলেছ তুমি বাবা; আমি তো একলা একা এই  নিয়ম ভাঙতে পারবো না। যতো দুঃখই বুকে বাজুক, যতাই জল ঝরুক চোখে, যতোই কষ্ট-ক্ষরণ হোক হৃদয় গভীরে আমার বাচ্চাদের তো ছেড়ে দিতেই হবে!একটু চুপ করে কান্না দমন করে পাখি-মা বলে, ‘তুমি যাও সোনা বাবা, যাও। আমি আর তোমাদের ডাকবো না। তোমরা যখন নিয়ম ভাঙতে রাজী নও তখন তোমাদের মতো করে জীবন ধারণে খুশি হও তোমরা।

     ছেলে আরও কিছুক্ষণ মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে উড়াল দিলো বন্ধুদের সঙ্গে; দলছুট হলে তো চলবে না। ছেলের উড়াল পথে চেয়ে থাকলো মা। যতোক্ষণ দেখা গেল ছেলেকে ততোক্ষণ চেয়ে রইলো। চোখের আড়াল হতেই কমল-সরোবর হলো মায়ের চোখ।