গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৮ জুলাই, ২০১৯

পার্থ রায়

ছাতা


অনেকদিনের সরকারী আবাস ছেড়ে নুতন ফ্ল্যাটে কি কি যাবে আর কি কি বাতিল হবে এই নিয়ে কয়েক দিন ধরেই শুভেন্দু আর ওর স্ত্রী সুমনার মধ্যে আলোচনা চলছে। ওদের ছেলে রাহুল একটা নামী ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। মাঝে মাঝে পড়া ছেড়ে এসে অযাচিত ভাবে ওর মতামত দিয়ে যায়। ইদানিং ছেলের মধ্যে একটা দুর্বিনীত ও অহং ভাব লক্ষ্য করেছে শুভেন্দু। কিন্তু বাবা হিসেবে ছেলেকে শাসন করতে গেলেই সুমনার অন্ধ মাতৃস্নেহ পথ আগলে দাঁড়ায়। ঝগড়া বিবাদ এড়ানোর জন্য  শুভেন্দু চুপ করে থাকে। #
আজকে রবিবার ছুটির দিনে কাঠের সিন্দুকটা খুলেছে শুভেন্দু। সিন্দুক মানে একটা বেশ বড় পুরু কাঠের বাক্স, যাতে শুভেন্দুর অনেক পুরনো জিনিষ রাখা আছে। বাক্সটা শুভেন্দুর বাবার অথবা তারও আগের আমলের হতে পারে। খুব ভালো কাঠের ভারী শক্তপোক্ত বাক্স। সুমনা অনেকবারই এই সিন্দুকটা বিক্রি করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু শুভেন্দুর ঠাণ্ডা চাউনি দেখে সংযত থেকেছে। মালপত্রগুলো বের করতে করতে একটা রং চটা কাঠের ডাঁটি লাগানো কালো ছাতা নজরে পড়ল। ছাতাটা দেখেই অনেক পুরনো কথা শুভেন্দুর স্মৃতিপটে ভেসে উঠল। ওর অঙ্কের স্যার সুবোধবাবুর ফেলে যাওয়া ছাতা। স্কুল থেকে অবসরের পরে ওর বাবার অনুরোধে ওকে প্রাইভেটে অঙ্ক শেখাতে আসতেন। অঙ্কের প্রতি একটা ভীতি ছিল শুভেন্দুর। সুবোধবাবু অনায়াস দক্ষতায় ছাত্রের অঙ্কভীতি দূর করে দিয়েছিলেন। শুধু একদিন একই অঙ্ক বার দুয়েক ভুল করার পরে অপ্রত্যাশিতভাবে পাশে রাখা ওই ছাতা দিয়ে সজোরে প্রহার করেছিলেন ছাত্রকে। হঠাৎ মেজাজ হারিয়ে স্নেহের ছাত্রের বাড়িতে তার গায়ে হাত তুলে নিজেই বিব্রত ও অনুতপ্ত হয়েছিলেন। গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদরও করেছিলেন। ভাঙ্গা মন নিয়ে সেদিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেলেন।

পাশের ঘর থেকে শুভেন্দুর মা টের পেয়েছিলেন। মাস্টারমশাই চলে যেতে, গুম মেরে বসে থাকা ছেলের পিঠে হাত রাখতেই, মাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল ক্লাস সেভেনে পড়া শুভেন্দু। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলেছিল, “মা, আমি তো ইচ্ছে করে অঙ্ক ভুল করি নি। আমি বুঝতে পারছিলাম নামা ছেলেকে আদর করতে করতে বলেছিলেন,ধুর! বোকা ছেলে। মাষ্টারমশাইরা অমন শাসন করেন। উনারা বাবা মায়ের থেকেও ওপরে। আমরাও ছোট বেলায় কতো শাস্তি পেয়েছি। মন খারাপ করিস না। উনি কতো যত্ন করে, ভালবেসে তোকে অঙ্ক শেখানপরে খাবার টেবিলে মা আর বাবার কথোপকথন থেকে জানতে পেরেছিল স্যার সাংসারিক কারণে খুব মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন।

একটা ম্যাসিভ স্ট্রোকে পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছিলেন সুবোধ স্যার। সেই থেকে ছাতাটা রয়ে গেছে। শুভেন্দুর মা বার দুয়েক ছেলেকে ফেরত দিয়ে আসতে বলেছিলেন। স্যারের এভাবে হঠাৎ চলে যাওয়াতে শুভেন্দু খুব কষ্ট পেয়েছিল। মাকে বলেছিল, “স্যারের স্মৃতি হিসেবে ছাতাটা আমার কাছে থাক না, মামা আর আপত্তি করেন নি। মাধ্যমিকে অঙ্কে ৯৫ পেয়ে স্যারকে যোগ্য গুরুদক্ষিনা দিয়েছিল শুভেন্দু।
পাপা, আর উ গোয়িং টু টেক দিস রট্যন থিং টু আওয়ার নিউ ফ্ল্যাট? আম্ব্রেলা অব দ্যাট ওল্ড ম্যান। হা হা হা, মাম্মি এদিকে এসো  

ছাতাটা হাতে নিয়ে আনমনা হয়ে গেছিল শুভেন্দু। চুপিসারে আসা ছেলের এমন বিচ্ছিরি তাচ্ছিল্য মেশানো মন্তব্যে চমকে পেছনে তাকাল। তারপরে কোনদিন যা করেনি, নিজের স্বভাবের বিপরীতে গিয়ে ওই ছাতা দিয়ে সজোরে বার কয়েক ঘা দিয়ে চিৎকার করে উঠল, “হাউ ডেয়ার ইউ আটার দিস? ইউ স্যুড বি রেসপেক্টফুল টু সিনিয়র এলডারলি পিপল। হি ওয়াজ মাই টিচার, ইউ স্টুপিড। হোয়াট ইজ দ্য ইউজ অব সেনডিং ইউ টু আ গুড স্কুল? গেট আউট অফ মাই সাইটশান্ত বাবার এমন রুদ্র মূর্তি দেখে ভীত সন্ত্রস্ত রাহুল হতবাক হয়ে চোখে জল নিয়ে কয়েক মুহূর্ত বাবাকে দেখল, তারপরে চুপসে যাওয়া ভেজা বেড়ালের মতো স্থান ত্যাগ করল। স্বামীর চিৎকার শুনে ছুটে আসা সুমনা এই প্রথম অপত্য স্নেহের লাগাম টেনে নীরব থাকল। 

সেদিন বিকেল বেলা গুটিসুটি পায়ে শুভেন্দুর কাছে এসে মাথা নিচু করে বলেছিল, “পাপা, ভেরি সরি। প্লীজ ফরগিভ মি। আর কখনো এমন হবে না। আই উইল নেভার বি ডিজ-রেসপেক্টফুল টু সিনিয়রস। প্রমিস
ঠিক আছে। সব সময় মনে রেখো গুরুজনদের সম্মান করতে এবং অন্যের আবেগকে মর্যাদা দিতে হয়। অলওয়েজ বি পোলাইট”- ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করতে করতে শুভেন্দু আর একবার সশ্রদ্ধ চিত্তে সুবোধ স্যারকে স্মরণ করল।