ওরা তিনজন
টুবু গরমের ছুটিতে তার ঠাকুমার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। এটা তার বড় প্রিয় জায়গা। এখানে এইসময় সে একাই আসে, কিছুদিন কাটিয়ে তারপর আবার বাবা মায়ের কাছে কোলকাতায় ফিরে যায়। ঠাকুমার আদরের সাথে সাথে গাছ গাছালির ভিতর দিয়ে ঘুরে বেড়ানো আর নদীর পথে ছুটে ছুটে আকাশ দেখার মজা টুবুকে ভরিয়ে রাখে। টুবুর আরও একজন প্রিয় মানুষ এখানে থাকে, যার জন্য সারা বছর তার মন কেমন করে। গোপালদাদা। মালিকাকুর ছেলে। গোপালদাদার সাথে সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়াতে তার বেশ লাগে! যদিও বাড়ির কেউই এটা পছন্দ করে না, সেই যে সেবার গোপালদাদার সঙ্গে গাছে উঠে আম পাড়তে গিয়েই তো তার হাতখানা ভাঙল।মা এখানে আসার সময় পইপই করে বলে দিয়েছে
-- টুবু এবার যদি ওই ছেলেটার সঙ্গে বেরিয়ে কোন বেয়াদপি করেছ তো তোমাকে আর ওখানে পাঠাব না।
তাই প্রতিবারের মত এবারেও টুবু লুকিয়েই গোপালদাদার সঙ্গে দুপুরের অভিযানে বের হবে বলে ঠিক করে।গোপালদাদার একটা পোষা কুকুর আছে, তার নাম পুচকি। দুপুরে ঠাকুমা ঘুমালে, টুবু চকোলেট আর বিস্কুটের প্যাকেট হাতে সোজা ছুটে যায় নদীর পাড়ে। গোপালদাদার ঘাঁটি সে জানে।
- এই নাও গোপালদাদা চকোলেট। তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেল নয়তো গলে যাবে।
- বাবা! কতবড় চকলেট রে টুবু! আমি তো শেষ করতেই পারব না।
- খুউব পারবে। দাঁড়া পুচকি তোর জন্যও আছে আর লেজ নাড়াতে হবে না বুঝলি! বিস্কুটের প্যাকেট থেকে দু-চারটে বিস্কুট ছুড়ে দেয় সে পুচকির দিকে।
- এই নে তুইও দুটো কাঁচা আম নে। সিধুমামার বাগানের, চুপিচুপি এনেছি।
- তুমি আবার না- বলে এনেছো? তোমায় না বারণ করেছি!
- চুপ কর তো! চল ওদিকে যাবি? কত্ত মাছ দেখবি ওদিকে!
টুবু যখন তার গোপালদাদার সঙ্গে মাছ শিকার করে বাড়ি ফেরে তখন তার সারা হাতে পায়ে কাদা ভর্তি। ঠাকুমা তো রেগে আগুন।
- দাঁড়া ছেলে আজ তোর হাত-পাই লাঠি মেরে ভাঙব। এই বলেই খোঁড়া পায়েই গোপালের পিছনে ছোটে, অথচ টুবুকে সামনে পেয়েও কিচ্ছুটি বলে না। টুবুর খুব রাগ হয়।
পরেরদিন ঠাকুমার কড়া পাহারা। টুবু কিছুতেই বেরতে পারে না। এভাবে কিছুদিন ঘরে বসেই কাটে তার।
- ও ঠাকুমা আমায় বেরতে দাও না গো একটুখানি।
- চুপ করে শুয়ে থাকো। দুপুর রোদে কেউ কি বেরোয়? বিকেলে বংশীকাকার সঙ্গে মেলা থেকে ঘুরে এস।
- না, আমি মেলায় যাব না, কোথাও যাব না।
- রাগ করে না দাদুভাই। এস আমার কাছে এসে চুপটি করে শুয়ে পড়।
এভাবেই নানা কথার মাঝে টুবুর চোখটা যখন লেগে যায়, ঠিক তখনি ঠাকুমার প্রচন্ড চিতকারে বিছানায় লাফ দিয়ে বসে। চোখ বড় বড় করে দেখে ঠাকুমার সাধের মিনির পিছনে গোপালদাদার পুচকি ছুটোছুটি করছে সারা ঘর জুড়ে। ঠিক টম আর জেরি শো এর মত। লন্ডভন্ড ঘরে ঠাকুমাও তখন দিশেহারা। পিছন থেকে হ্যাচকা টানে গোপালদাদা টুবুকে বের করে আনে। তারপর সে আর গোপালদাদা এক ছুটে যখন বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তায় ওঠে, পুচকিও তখন তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয়।
- দেখলি টুবু কেমন আমরা দুজন মিলে তোকে বাইরে আনলাম।
- গোপালদাদা তুমি পারোও বটে।
বলে হাসতে লাগলো টুবু। যদিও বাড়ি ফিরে তাকে বকা খেতে হবে, তাও সে আনন্দে মাঠের পথে ধুলো উড়িয়ে ছুটলো।
সেদিনও দুপুরে নদীর সাঁকোটা ধরে তিনজনে হাঁটছিল। হঠাত পুচকি একটা বেজির পিছনে খুব জোরে ছুটতে থাকে, টুবুও ছুটতে থাকে তার পিছনে। কখন যেন পা ফস্কে যায় কাঠের সাঁকোয়। কিছু বোঝার আগেই সোজা মাঝ নদীতে। সাঁতার না জানা টুবু আলোর থেকে ক্রমশ অন্ধকারের ঘুর্ণীতে পাঁক খেতে থাকে।যতই সে উপরে দুহাত তুলে আলোটা ছুঁতে চেষ্টা করে ততই কে যেন তাকে নীচে টানতে থাকে। তখন মায়ের জন্য কান্না পায় তার।ঠিক তখনই একটা হাত তাকে জোরে ঠেলে দেয়। সাঁকো থেকে নেমে আসা বাঁশে কেমন করে যেন আটকে যায় শরীর। টুবুর দুচোখ বন্ধ হয়ে আসে। তবু এক ঝলকে সে প্রাণের গোপালদাদাকে কাছে আসতে দেখে।যখন ঘুম ভাঙে তখন সে দেখে তার চারপাশে কত্ত লোক! মায়ের কাছে গিয়েই চোখটা আটকে যায় তার। একি মাও এসেছে এখানে! জরিয়ে ধরে সে মাকে।
একটু পরে বিছানা থেকে নেমে সে দেখে, গোপালদাদা তাদের বড় খাবার টেবিলে মজা করে বসে খাবার খাচ্ছে! উঠোনে পুচকিটা চুপ করে বসে আছে।
আজ সপ্তমী। পুজোর ছুটিতে এবার তারা আর কোলকাতার বাইরে বেড়াতে যায়নি। ঠাকুমা আসছে তাদের এই বাড়িতে। সঙ্গে গোপালদাদা। আজ গোপালদাদাকে নিয়ে সে বেরোবে কোলকাতার আলো ঝলমল রাস্তায়। ইস! পুচকিটার জন্য আজ ভারি মন খারাপ করছে টুবুর।