গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৯

রত্না ঘোষ

দুই বোন

সৌজন্যার সাথে আমার সম্বন্ধ করে বিয়ে। অষ্টমঙ্গলায় শ্বশুর বাড়ি এসে ঘুরে ঘুরে সব দেখছিলাম।পুরনো দিনের বাড়িটা দেখার মতই । যেমন এর গঠনশৈলি তেমনি পরিবেশ। এতবড় বাড়িটাতে চাকর বাকর নিয়ে মাত্র গোটা পাঁচেক লোকের বাস।গা ছমছমে একটা পরিবেশ রয়েছে সবসময়। পরপর দুরাত দেখেছি দোতালার পশ্চিম দিকের একটি ঘরে সারা রাত আলো জ্বলছে। ওই ঘরটির প্রতি আমারও আগ্রহ বেড়ে গেল বেশ কয়েকগুণ। সত্যজিৎ, শরদিন্দু পড়া ছেলে আমি তাই কেমন যেন এক রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছি। নতুন বিয়ে তাছাড়া রহস্যের গন্ধ সব মিলিয়ে রাতের ঘুম উধাও।পরের দিন ঘুমই ভাঙ্গল দুপুরবেলা। বিকালবেলা সকলে যখন দিবানিদ্রা দিচ্ছে তখন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম পশ্চিমের রহস্যময় ঘরের সামনে। হঠাৎ ঘরের ভেজানো দরজায় হাত লাগতেই দরজা খুলে গেল। দরজা দিয়ে ঢুকলাম বিশাল এক হলঘরে যেখানে বিভিন্ন পোট্রেট দিয়ে ঘর সাজানো। ঘরের যেদিকে ব্যালকনি তার দরজার কাছেই আঁকার স্ট্যাণ্ড সেট করা। মনে হল কিছুক্ষণ আগে কেউ আঁকছিল এখানেই। কিন্তু কে? সৌজন্যার যে অত গুণ নেই তা এ কদিনে বেশ বুঝতে পেরেছি। আস্তে আস্তে ব্যালকনিতে গেলাম। 

এদিকটাতে কিছুদূর দিয়ে গঙ্গা বয়ে চলেছে সমাজ জীবন ও শহরের অনেক গোপন কথা বুকে চেপে । বাগানটা ছাড়ালেই ঘাট ।জাহাজের ভো ডাক আর ব্যস্ত কলকাতার কিছু স্বাভাবিক আওয়াজ ছাড়া এ দিকটা বেশ শান্ত। এই বাড়িতে কেমন যেন একটা শিল্প সত্তা রয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে । এই ঘরে এসে তা চাক্ষুস করে মনটা এক অজানা আনন্দে ভরে গেল।এই পরিবেশটাই আমার পছন্দ। ঝুল বারান্দার রেলিং ধরে বাগানের গাছ গাছালি কে যে কতক্ষণ ধরে পরখ করছিলাম তার খেয়াল ছিলনা। হঠাৎই -----"হ্যাঁগো" ডাক টা শুনে পেছনে ফিরে ঘরের কাছে এসে দেখি বর্ণালীদি এক মনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেন্সিল দিয়ে স্ট্যাণ্ডে সেট করা ড্রইং পেপারে একমনে এঁকে যাচ্ছেন। এতক্ষণ বুঝলাম শিল্পী কে? বেশি কালক্ষয় না করে হ্যাগো ডাক অনুসরন করে সোজা এসে সৌজন্যার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। 

বর্ণালী আমার স্ত্রী সৌজন্যার মামাতো দিদি। সৌজন্যা মামা বাড়িতেই মানুষ। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর মামা ওকে আর ওর মাকে এখানে নিয়ে আসেন। মামা -মামী গত হওয়ার পর আমার শ্বাশুড়ি মা ই এখন এখানকার কর্ত্রী । বর্ণালী দির একটা নিজস্ব জগত আছে। নিজের পড়াশোনা আর বিশ্ববিদ্যালয় শুধু এই নিয়ে যে তিনি থাকেন তা নয় ।ওর সবচেয়ে ভালোবাসা ও ভালোলাগার এনগেজমেন্ট হলো চিত্রাঙ্কন। উনি ওনার তুলির টানে চিত্রে যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। টিয়া পাখির মত ছোট্ট একটুখানি মুখে গোল গোল দুটি চোখ । টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো নাকের জন্য মুখগহ্বর দেখাই যায় না একদম । সাড়ে তিন ফুট লম্বা ছোট্ট চেহারার বর্নালী যখন গটগট করে হেঁটে যায় ,যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শ্রদ্ধায় মাথানত অবস্থায়--- "সুপ্রভাত ম্যাম " বলে শুভেচ্ছা জানায় তখন কে বলবে শারীরিক গঠন বা অবয়ব কোন বাঁধা জীবনে চলার পথে ! যে কয়েকদিন ওখানে ছিলাম আমি দরজার সামনে দেয়ালে হেলান দিয়ে একদৃষ্টে শিল্পীর শিল্পকর্মটি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম । শিল্পীর এদিকে নজরই ছিল না। কিন্তু নজর যার ছিল তার কু-নজর থেকে নিরীহ শিল্পী ও চুরি করে শিল্পকর্ম দর্শণকারী কেউ নিস্তার পেল না। 

ঈশ্বর সৌজন্যাকে রূপ যৌবন এতটাই দিয়েছে যে আমি কেন, দেবরাজ ইন্দ্র পর্যন্ত অপ্সরা দের কাছে যেতে ভুলে যাবেন। তাও কেন মনে হলো জানিনা আমি শিল্পীর প্রেমে পড়েছি । তাই আমি নতুন বর হওয়ায় শুধু জোর করে ওখান থেকে টেনে এনেই আমাকে নিস্তার দিল । পরের দিন বিকেল বেলা আমি আবার চুপি চুপি গেলাম শিল্প মহলে। দরজা ঠেলে ঢুকেই অবাক হলাম। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় দেখলাম কালবৈশাখী ঝড় সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। সমস্ত আঁকা গুলো টুকরো টুকরো ঘরময় ছড়ানো। দেওয়াল চিত্র -বিচিত্র । সমস্ত সরঞ্জাম চারদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি শিল্পী আমার দিকে করুন ভাবে তাকিয়ে আছে । আমায় আস্তে আস্তে বললেন , ----"ওর ভীষণ রাগ। ভাই ওকে ক্ষমা ঘেন্না করে মানিয়ে নিও ।এই আমার অনুরোধ।" ওনার মুখের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম উনি কি মানুষ ? নাকি মানুষ নয় ? না চেহারা না মনে। মানুষের এত ধৈর্য্য থাকে না ।