গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মুকুন্দ চক্রবর্তী

কোদাল মেরে স্মৃতি থেকে এক টুকরো

তিন দিন বিছানায়, বাইরে বেরনো মানা। কাশির চা এর দোকানে যেতে খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু উপায় নেই। নন্দার মা বাইরে ঘুর-ঘুর করে, বেরোলেই মেয়ের কাছে ফোন। মোবাইল ঘাঁটতে পারছিনা, মাথাব্যথা করে। চোখ বন্ধ করলেই ছোটবেলার বর্ষাকালের টুকরো টুকরো ছবি উঁকি দেয়।
 
আমাদের গোয়াল ঘরের পরেই ছিল ঢেকিঘর। দুটো ঢেকি ছিল, একটা চাল আর একটা ধান কোটার জন্য। ঠিক তার পরেই ছিল বিমলা পিসির ঘর। দাসপাড়ার নকুল দাদুর মেয়ে। বরকে বাঘে খেয়েছে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে, সে অনেক কাল আগে। সেই থেকেই নাকি আমাদের বাড়ি। মাঠে গরুকে জল খাওয়াতে গেলে বা জেলেপাড়ায় মাছ আনতে গেলে পিসির সাথে আমিও যেতাম। পিসি আমাকে কচ্ছপের ডিম খুঁজে দিত। বাইনা করলে গর্তের ভেতর থেকে পাখির ডিম দেখাত। একদিন জেলেপাড়ায় যাওয়ার পথে দেখি একটা পগারে অনেক মাছ।দুজনে মিলে দুদিকে মাটি দিয়ে বেঁধে জল ছেঁচে ফেলে অনেক মাছ ধরেছিলাম, সেদিন আর স্কুলে যেতে পারিনি। মা খুব মেরেছিল আমাকে। মাছ ছুড়ে ফেলেছিল বাইরে। পিসির মুখটা কালো হয়ে গেছিল, হয়তো অপমানে অথবা আমার প্রতি মমতায়। 

পিসির ঘরের পরেই ছিল বাঁশ বাগান আর বাগানের ভেতর দিয়ে একটা পায়েচলা পথ,সেটি মিসেছে বসন্ত মাস্টারের পুকুরে। টানা বৃষ্টি হলে পুকুর থেকে কৈ মাছের ঝাঁক বাঁশ বাগানে উঠে আসতো আর বৃষ্টি থামলে আমরা ধরতাম। ঝমঝম বৃষ্টি হতো আর পিসি আমাকে ঢেকির ওপর বসে রূপকথার গল্প শোনাত। বাঁশ বাগানের ভেতর থেকে ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে, পাখিরা জলের ঝাপটা সামলাতে ডানা গায়ের সাথে লেপ্টে বসে আছে, হুট করে একটা ইঁদুর জলের স্রোত টপকে ওপারে চলে যাচ্ছে পিছনেই একটা সাপ, একটা গরু সেই থেকে ডেকেই চলেছে। গল্প বলতে বলতে পিসির মনটা কোথায় যেন হারিয়ে যেত আর আমার চোখের সাথে মনটা চলে যেত সেই মুহূর্তের ঘটে চলা প্রকৃতির আসল রূপ,রস,গন্ধ,শব্দের দিকে,এখানে মানুষের মতো কোনো কৃত্রিমতা নেই। মাঝে মাঝে ঐ বৃষ্টির মধ্যে চুপি চুপি এসে হাজির হতো ঝন্টু কাকা। ঝন্টু কাকার বাড়ি ছিল পূব পাড়া। গ্রামের অনেকের মতো ঝন্টু কাকাও চলে গেছিল দণ্ডকারণ্যে। ভারত সরকার সেখানে জমি, গরু বাড়ি দিয়েছিল কিন্তু রুক্ষ ভূমিতে টিকতে পারেনি। কয়েক বছরের মধ্যেই বৌ, ছেলেকে হারিয়ে ফিরে এসেছে নিজের গ্রামে। সুযোগ পেলেই চুপি চুপি পিসির সাথে দেখা করে,- জেলেপাড়ার পথে, মাঠের ধারে, বসন্ত মাস্টারের পুকুর পাড়ে আর টানা বৃষ্টির দিনে আমাদের ঢেকিঘর।ঝন্টু কাকা এসেই আমাকে নৌকা বানিয়ে দিত আর একটা লাঠি ধরিয়ে দিয়ে বলত 'এই লাঠি দিয়ে কটা মাছ মারতে পারিস দেখব, দশটা হলেই বড়ো খালে নৌকা চড়িয়ে আনব তোকে আর তোর পিসিকে।' আমি সেই আনন্দে লাঠি হাতে জলের স্রোতের দিকে মুখ করে বসে যেতাম। মাঝে মাঝে ওদের টুকরো কথা কানে আসত।

'কুষ্টিয়ার পদ্মার পাড়ে একটা কুঠিবাড়িতে কাজ করতে যাব, মালিক থাকে কোলকাতা, তোমাকে নিয়ে যাব। 
আমি যাব না
কেন যাবে না?
তুমি বুঝবে না। 
কেন বুঝব না?
এখন ওকথা থাক.................'
কোনো বড় একটা মাছ দেখে সেটা ধরার জন্য নিচে নেমেছি হঠাত্ কানে এলো পিসির গলা-
"
কি হচ্ছে!! ছাড়ো বলছি।"
আমি ফিরতেই কাকা বললো, " কটা হলো?"

কিছুদিন হলো দণ্ডকারণ্য থেকে পরিমল দাদু এসেছে, বাড়িছিল নমশূদ্র পাড়া। শুনেছি পরিমল দাদুর সাথে লাঠি খেলাতে কেও এটে উঠতে পারতো না সারা জেলায়। কত গল্প শোনালেন আমাদের। দণ্ডকারণ্যে বাঘ আছে, সেই বাঘে মানুষ খায় না, লক্ষ্যনের্ অভিশাপ আছে। কত বড় জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে তারা কাঠ আনে, অনেক গল্প। পরের সপ্তাহে চলে যাবে তাই ঠাকুরদাদা পরিমল দাদু কে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, " বলাই, তোমারা আছো নদীর বুকে আর আমারা আছি ঝলসে যাওয়া কঠিন মাটির বুকে, নদীকে ছেড়োনা। এ জীবনে এটাই শেষ দেখা "
দুজনের চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে, আমারও চোখটা ঝাপসা হয়ে এসেছিল ।
পরের দিন জেলেপাড়ার পথে ঝন্টু কাকা ছুটতে ছুটতে এসে পিসি কে বললো -
"
পরিমল জ্যাঠা দণ্ডকারণ্য ফিরে যেতে বলছে, গ্রামের সবাই বলছে, না গেলে জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে কিন্তু আমি আর ঐ পোড়া মাটির দেশে ফিরবনা। গুছিয়ে থাকবে, কাল ভোরে বেরিয়ে পড়ব ।
আমি যেতে পারব না।
কেন পারবে না ?
ছোট বৌদির বাচ্চা হবে।( আমার কাকি)"
আমার সামনেই পিসির হাতটা ধরে এক ঝটকায় নিজের দিকে টেনে নিল, পিসি ঠান্ডা চোখে কাকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আমার হাতটা ধরে হাঁটতে লাগল। আমি পিসির হাতটা ছাড়িয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি ঝন্টু কাকা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরে ঠিক যে ভাবে ছুটতে ছুটতে এসেছিল সেই ভাবে ছুটে চলেছে। একদিকে ঝন্টু কাকা অন্য দিকে পিসি। দুরত্ব বেড়ে যায় নদীর কিনার থেকে। 
পরের দিন থেকে ঝন্টু কাকাকে আর দেখা যায়নি। কাল পরিমল দাদু চলে যাবে,আমাদের সব ছোটোদের বাদাম খাওয়ালো ,আদর করল। 

পরের দিন ভোরে নেপাল এসে খবর দিল দাদুর নৌকা ছাড়বে, ছুটে গেলাম, নৌকা তখন অনেকটা দূরে চলে গেছে কিন্তু সাথে ওটা কে? পিসি না!!! চিতকার করে ডাকতে গেলাম আওয়াজ বেরোল না । গলার ভেতর কি যেন একটা দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঠাকুরদা দূর নৌকার দিকে তাকিয়ে বললো " নদীটা একদিন শুকিয়ে যাবে।"