গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী

আমার হিয়ার মাঝে 
  
কদিন ধরেই বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশে ঘন মেঘ। মাঝে মাঝেই বৃষ্টি ঝম ঝমিয়ে পড়ছে।  আজ ঈপ্সিতা কমলেশ এর এক বিশেষ দিন। আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী। কমলেশ অফিস থেকে ফেরার পথে একটা ফুলের তোড়া আর তার প্রাণের অধিক ঈপ্সিতার জন্য বিষ্ণুপুর সিল্কের শাড়ি নিয়ে কোনমতে নৈহাটি লোকালে উঠে পড়ে। বেলঘরিয়া ষ্টেশন আসতেই নেমে পড়ে। গাড়ি প্ল্যাটফর্মে নামতেই এক রাশ লোক ঝড়ের বেগে নেমে পড়ে।  
কমলেশ হাতের ব্যাগটা শক্ত হাতে চেপে ধরে কারন তাতে ঈপ্সিতার জন্য শাড়িটা যত্ন করে রাখা। ফুলের তোড়াটা কি করবে ভাবতে যাচ্ছিল হটাৎ পেছন থেকে কে ঠ্যালা দেয়। 
কমলেশ চিৎকার করে ওঠে। কি অসভ্য লোক রে বাবা। মানুষকে এরকম ভাবে কেউ ঠ্যালা দেয় !
- লোকাল ট্রেনে কি প্রথম উঠছেন দাদা ? পেছন থেকে বিদ্রূপের কণ্ঠস্বর শুনে ওর মাথা গরম হয়ে যায়. 
- না আমি রোজকার যাত্রী। তবে এত বাজে অসভ্য লোক দেখতে অভ্যস্ত নই। 
- কাকে অসভ্য বলছেন ? ভিড় ঠেলে মানুষ কোন মতে এগুচ্ছে তার মধ্যে আপনি ফুলের তোড়া নিয়ে ঢুকে মানুষকে অসভ্য বলছেন ! আপনি নিজেকে কি ভাবেন বলুন ত ! অতো ফুলের সখ থাকলে ট্যাক্সিতে চড়ে ফুলের তোড়া নিয়ে আসলেই পারতেন । 
- আমি কিসে যাবো কিসে না যাবো সেটা কি আপনি ঠিক করবেন ? এই বলে কমলেশ নেমে পড়ে। না সে হাতিবাগান থেকে ফুলের তোড়াটা না কিনলেই পারত। বেলঘরিয়া স্টেশন এর কাছে কোন ফ্লোরিষ্টের দোকান থেকে  কিনে নিয়ে গেলে কি হত না ! ভুলটা  তার ই হয়েছে। কথাগুলো মনে মনে ভাবতে ভাবতে কখন বাড়ি এসে গিয়েছে খেয়াল করেনি।
ঘরে ঢুকেই ঈপ্সিতাকে জড়িয়ে ধরে বলে বিবাহ বার্ষিকীর অনেক অনেক ভালোবাসা।    আমি সত্যি তোমাকে পেয়ে ধন্য। 
তুমি ছাড়া আমার নেই কোন পণ্য ।
তুমি আমার অরণ্য । 
তুমি করেছ মোরে বণ্য ।  
- ঈপ্সিতা নিজেকে কমলেশের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে , কি আমি পণ্য ? মানে কমোডিটি !  তোমার এই  ঢং ন্যাকামি আমার আর ভালো লাগেনা। চল হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ চা খাও। আমিও তোমার জন্য বসে আছি কখন আসবে বলে !   
- ট্রেনের ঘটনাটা বলল না কমলেশ। ফুল ঈপ্সিতা খুব ভালো বাসে তাই বাছাই করা কাট ফ্লাওয়ার এর তোড়াটা কিনেছিল। সেটা যে ট্রেনের যাত্রীদের পদপিষ্ট হয়ে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেটা বলা হয়নি। তাছাড়া সত্যি বলতে পকেটে আর টাকা ছিলনা নতুন ফুলের তোড়া কেনার। তাই শুধু বিষ্ণুপুর সিল্কের শাড়িটাই ঈপ্সিতাকে বিবাহ বার্ষিকীর উপহার হিসেবে প্রদান করে কিছুটা ধাতস্থ হল।  কেমন হয়েছে শাড়িটা পরে দেখত !
- এখন নয়। তুমি এত দাম দিয়ে শাড়ি কিনলে কেন গো?
 - আহা আমার সোহাগি ! কি করে না কিনি। বছরে এই দিনটার জন্য বসে থাকো। কি  উপহার আমি দিলাম তা নিয়ে একটু কটু মন্তব্য করবে । তবে এবারে তোমার জন্য ফুল আনা হলনা। মনটা খারাপ । 
- তাতে কি হয়েছে , এত দামি শাড়িত এনেছ। এই যথেষ্ট । 
- বলছ ! তবে আমার পাওনাটা দাও।
- যাহ ! 
এখানে বলে রাখি কমলেশ ঈপ্সিতার পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে কিন্তু ঈপ্সিতা সন্তান দিতে পারেনি কমলেশ কে । এই নিয়ে কমলেশের মনে কোন কষ্ট নেই কিন্তু  ঈপ্সিতার মনে কষ্ট আছে। সে নিজেকে অপরাধী মনে করে । অনেক ডাক্তার দেখান হয়েছে কারুর কোন দোষ ত্রুটি নেই বিভিন্ন টেস্ট এর ফলাফল যা বলছে। কমলেশ  এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না । এইতো বেশ আছি । কোন বন্ধন নেই। এই ভাবেই কেটে যাক না দিন গুলো।
ঈপ্সিতার মা মাসি নানা টোটকা করেন ফল কিছুই হয় না। ঈপ্সিতার একটি সন্তান থাকলে তার সময় কেটে যেত। সারাদিন টুক টাক কাজ নিয়ে থাকে।গান করে, ছবি আঁকে , সেলাই করে। ঘরের সমস্ত কাজ গুছিয়ে করে। সারা ঘর ঝক ঝক করে। রান্নাও ভালো করে। 
আজ কমলেশের জন্য ইলিশ পাতুরী, কসা মাংস, ফ্রাএড রাইস, পনির টিক্কা, চাটনি, পায়েস, সংগে কমলেশ কাল যে মিষ্টি এনে রেখেছিল ফ্রিজে । সব সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়ে দেয়।  কমলেশ হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। ট্রেনের কথা বলেনা। তবে ফুলের  তোড়াটা ট্রেনে পড়ে যাত্রীদের পদপিষ্টে নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে হাঁফ ছাড়ে।  
ঈপ্সিতা কথাটা শুনে বিব্রত হয়। 
- তোমার কিছু হয়নি ত ! 
- না আমার আবার কি হবে?
ঈপ্সিতা কমলেশকে খুব যত্ন করে খেতে দেয়।  কমলেশ পরিতৃপ্ত নয়নে ঈপ্সিতাকে দেখে ভাবে সত্যি তার বউ ভাগ্যটা ভালো। আসলে পুরুষ মানুষের মন জয় করতে হলে ভালো  রান্না র প্রয়োজন। ঈপ্সিতা সে বিষয় পটু।  
সারাদিনের খাটুনিতে কমলেশ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।  
ঈপ্সিতা তার মাথায় বিলি কেটে বলে এতই ঘুম!
- হ্যাঁ। খুব ঘুম পাচ্ছে।  
কিছুক্ষণের মধ্যেই নাসিকা গর্জন। 
বেল্কনিতে ঈপ্সিতা বসে একটা রবীন্দ্র সংগীত গাইল. 

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি।

হটাৎ ওর পিঠে কার হাতের স্পর্শ পেল। 
পেছন ফিরে তাকাতেই কমলেশদেখে বলে.... ও তুমি!  
কমলেশ ঈপ্সিতার গানে মুগ্ধ। 

                     

কমলেশ ঈপ্সিতার দিনগুলো ভালোই কাটছিল । এরমধ্যে ঈপ্সিতার পীড়াপীড়িতে কমলেশ এক কন্যা সন্তানকে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । ঘটনাটা এইরকম ঈপ্সিতার বাড়ির পরিচারিকা (লক্ষ্মীর) তৃতীয় কন্যা সন্তান হওয়াতে তার মাতাল স্বামী নাকি সেই শিশু কন্যা সন্তানটিকে বাড়ির দোতালার ছাদ থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার সময় লক্ষ্মী মাতাল স্বামীর হাত থেকে তার কন্যাটিকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঈপ্সিতার বাড়ি চলে আসে। ঈপ্সিতার পায়ে পড়ে সকল ঘটনার বৃত্তান্ত দেয়। ঈপ্সিতা শুনে তৎক্ষণাৎ থানাতে যাওয়ার হুমকি দেয় কিন্তু লক্ষ্মীর অনুরোধে ব্যাপারটা ধামা চাপা পড়ে যায়। সেইসময় ঈপ্সিতা লক্ষ্মীকে  দিয়ে সর্ত করিয়ে নেয় যে, সে কন্যা সন্তানটিকে লালন পালন করবে কিন্তু লক্ষ্মী যেন তার এই মেয়েটিকে পরে দাবি না করে। আইনত দত্তক নিলে সেই ব্যবস্থাই থাকে যাতে পালিত পিতা মাতার কোন আইনগত সমস্যা পরে না হয়। যেমন বলা সেইরকম কাজ । লক্ষ্মীর স্বামী , লক্ষ্মী এবং ঈপ্সিতা , কমলেশ সকলে কোর্টে কন্যা সন্তানটিকে দত্তক নেয় । কোর্ট কমলেশ ঈপ্সিতার হাতে কন্যাটিকে প্রদান করে নানা আইনি কাগজ পত্র সই সবুদের পর । এখন আর কোন সমস্যা নেই । ঈপ্সিতা কন্যাটি পেয়ে খুব খুশি । তার মা হওয়ার সাধ লক্ষ্মীর মেয়ে পূর্ণ করে । সে এখন মা ।  
লক্ষ্মী ওই বাড়িতেই সারা দিন কাজ করে। তার মেয়েটির মাতৃ স্নেহের অভাব হয়না ।  যেন দেবকী , যশোদা  দুই মাতার সান্নিধ্যে মেয়েটি ক্রমে বড় হতে লাগে। খুব আহ্লাদী তাই তার নাম আহ্লাদীদেয় ঈপ্সিতা। লক্ষ্মীও খুশি ওই নামে । আহ্লাদীর ছয় মাসে অন্নপ্রাশন হয় ঘটা করে। সত্য নারায়ণ পুজো হোম ইত্যাদি হয়। আত্মীয় স্বজন সকলেই আসে । কিন্তু ঈপ্সিতার মা এই পরের মেয়ের তাও পরিচারিকার মেয়ের ঘটা করে অন্নপ্রাশন একদম ই পছন্দ করেন না। ঈপ্সিতা ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় সামাল দেয়। 
কমলেশ , ঈপ্সিতার খুশীতেই খুশী তাই সে এসব বিষয় মাথা ঘামায় না।  
আহ্লাদীর তিন বছর  স্কুলে ভর্তি হয় । স্কুলের ড্রেসে তাকে বেশ ফুট ফুটে দেখায়। লক্ষ্মীর চক্ষে আনন্দাশ্রু । সে পরিতৃপ্ত নয়নে আহ্লাদীকে দেখে দুহাত ভরে আশীর্বাদ করে। আহ্লাদী লক্ষ্মীর চেয়ে ঈপ্সিতাকে বেশি পছন্দ করেকিন্তু লক্মী যে মা , সে তার জননী তার স্নেহ উপচে পড়ে আহ্লাদীর ওপর। স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা সব লক্ষ্মী করে। তার টিফিন বাক্স গোছান , জামা কাপড় কাচা , ইস্ত্রী করা ইত্যাদি সব কাজ । সে জানে এখানে তার কন্যাটি সযত্নে আছে এবং থাকবে ।  
আহ্লাদীর চার বছর পূর্ণ হয়ে গেল এর মধ্যে। পাঁচে পা দেওয়াতে তার ঘটা করে জন্মদিন পালন করা হল। লক্ষ্মী সব দেখে শান্তির নিঃশ্বাস নেয় । মনে মনে ভাবে সে নিশ্চিন্ত তার মেয়ের ব্যাপারে । ভালো ঘরে মেয়েটি মানুষ হচ্ছে পড়াশুনো করছে এর চেয়ে আর কি বেশি চায় । ভগবান ওকে সুস্থ সবল রাখুক সেটাই তার এক মাত্র ভগবানের কাছে প্রার্থনা ।