গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

পারমিতা কর বিশ্বাস

প্রবাহ ও প্রাণ

একটা পুরোনো কাপড় ছিঁড়ে বাঁ হাতের কব্জিতে ভালো করে পেঁচিয়ে নিলো প্রমা। রক্তটা বন্ধ করতে হবে তো। একটু পরেই সংস্কৃত স্যারের কাছে পড়তে যাওয়া। সামনেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা প্রমার, একটা কোচিং ক্লাসও বাদ দেবার উপায় নেই। কেমন করে হাত কাটলো? সে নিজে কেটেছে, ব্লেড দিয়ে। প্রমার প্রেমের প্রথম পাঠ শুরু হয়েছিলো সবে। পড়ার ঘরে বসে সে মন দিয়ে প্রেমপত্র লিখছিলো। কিন্তু বিধি বাম। নিঃশব্দে মা কখন যে ঘরে ঢুকেছিলেন প্রমা টের পায়নি। প্রমার চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে চিঠির কাগজটা টেনে নিয়ে বললো, " এত মন দিয়ে কি লেখা হচ্ছে দেখি!" প্রমা পাথরের মত বসে রইলো রইলো চেয়ারে। প্রচণ্ড শাসন নিয়ম শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখা মেয়ের এহেন দুর্মতি দেখে প্রমার মা রাগ সম্বরন করতে পারলেন না। নানান কটুক্তি করলেন, বললেন, " এত বড় সাহস! সামনে পরীক্ষা, পড়াশোনার নাম নেই, প্রেমপত্র লেখা হচ্ছে ! পাজি মেয়ে, শয়তান মেয়ে, একটুও শান্তি দেবে না আমাকে। এইসব বলে চিঠিটা টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। প্রমার মত কোমলমনা কিশোরীর পক্ষে এইসব বাক্যবাণ সহ্য করা বড় কঠিন। তা বলে হাত কাটবে! কী সাংঘাতিক মেয়ে বাবা ! মুখে কোনো কথা নেই, কোনো বায়না নেই, তর্ক নেই, শুধু এক প্রচণ্ড অন্তঃসলিলা জেদ। ওকে কেউ বোঝে না। মন খুলে কথা বলতে পারেনা কখনো। সেরকম পরিবেশ নেই, মানুষও নেই তার চারিধারে। এই তো বছর দুই আগের কথা। প্রমার বাবার সেসময় পাখি পোষার খুব খুব শখ হল। খুব সুন্দর খাঁচায় বন্দি একজোড়া চন্দনা পাখি এলো প্রমাদের বাড়িতে। খুব অশান্তিতে দিন কাটতে লাগলো প্রমার। পাখি নিয়ে প্রমার বাবার আহ্লাদ যত বাড়ছে প্রমার অশান্তি অস্বস্তির পারদ তত চড়ছে। তার বাবাকে বলা যাবে না কিছু, বোঝানোও যাবে না, সে তার নিজের ভালোলাগার সিদ্ধান্তে অনড়। কিন্তু কিছু তো একটা করতে হয়

চোখের সামনে দুটি নিরীহ জীবের এহেন বন্দিত্বের গ্লানি আর কাহাতক সহ্য করবে প্রমা! একদিন দুপুর বেলা সবাই যখন দিবা নিদ্রায় মগ্ন, তখন খুব সন্তর্পনে খাঁচা খুলে পাখিদুটোকে উড়িয়ে দিলো প্রমা। পাখিরা যখন ডানার ঝাপটে তাদের বুক ভরা আনন্দের প্রকাশে আকাশ মতিয়ে তুললো, তখন মেয়ের আনন্দ দেখে কে! আকাশে স্বাধীনতার ঝড় উঠলো কিন্তু বাড়ির কেউ বিন্দুবিসর্গও টের পেলো না। ঘুম থেকে উঠে শূন্য খাঁচা দেখে প্রমার বাবার কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সে প্রসঙ্গ এখানে থাক। এখানে প্রসঙ্গ হল প্রাণ, এখানে প্রসঙ্গ হল প্রবাহ। এখানে প্রসঙ্গ হল প্রমা। প্রমার মন জুড়ে সেদিন বেজে উঠেছিলো তার একটি প্রিয় গান, রবি ঠাকুরের গান, - ".. নদী আপন বেগে পাগল পারা" বাঁধন ছাড়া পাখির মত একটা চিন্তা, একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি বুঝি ভাষা পেলো। একটা ভাবনা বাঁধ ভাঙা নদীর মত তার মনের একটা আধখোলা জানলাকে এক ধাক্কায় পুরোপুরি খুলে দিলো। ' আমি সদা অচল থাকি গভীর চলা গোপন রাখি।' সেদিন থেকে গভীর চলা গোপন রাখতে পারার একটা আকাশ ছোঁয়া আনন্দ প্রমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সেখানে, যেখানে হৃদয়ের ভাষার দৃঢ়তায় মিথ্যে কে পরাজিত করা যায়। প্রমা এই রকমই। বড় চাপা স্বভাবের, কিন্তু বড় জেদী। প্রমার প্রসঙ্গ উঠলে সবাই একটা কথাই বলে " তো কোনো কথাই বলে না, বড় শান্ত স্বভাবের মেয়ে।" প্রমা এখন সংস্কৃত স্যারের বাড়িতে। স্যারের কাছে নোট নেবার সময় স্যারের খুব স্বাভাবিক ভাবেই চোখ পড়ে গেলো প্রমার ব্যান্ডেজ বাঁধা বা হাতের দিকে। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, " প্রমা, হতে কি হলো?" প্রমা, " কেটে গেছে।" স্যার," কি করে কাটলো? " অপ্রস্তুত প্রমা মুখ ফসকে বলে ফেললো, " বঁটিতে।" মাষ্টার মশাই একটু অনুসন্ধানী চোখে প্রমার দিকে তাকিয়ে বললেন, " বঁটিতে কব্জি কাটলো! ভয়ঙ্কর কান্ড !" প্রমা আরষ্ট হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। মাষ্টার মশাই একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, প্রমা, জীবন বড় বিচিত্র। কখনো বিক্ষুব্ধ সমুদ্র। কখনো আবার শান্ত, সুন্দর। তোমার কাজ শুধু নির্ভয়ে এগিয়ে চলা। তুমি যদি জীবনের কাছে হেরে যাও , তুমি নিজের কাছেও হেরে যাবে। তোমার মত বুদ্ধিমতি মেয়ের ক্ষেত্রে সেটা কাম্য না।" তারপর মাষ্টারমশাই সস্নেহে প্রমার মাথায় হাত রেখে বললেন, " সামনে পরীক্ষা, এখন মন দিয়ে পড়াশোনা করো। মনে রেখো, তোমার অর্জিত বিদ্যা তোমার সবচেয়ে বড় বড় বন্ধু। " এই স্নেহের স্পর্শ টুকুর বড় প্রয়োজন ছিলো প্রমার। 

প্রচণ্ড অন্তর্মুখী, নিঃসঙ্গ, আবেগপ্রবন মেয়েটির দু চোখের জলোচ্ছ্বাসে অভিমানের কালো মেঘ ধীরে ধীরে সরে গেলো। কোচিং ক্লাস থেকে ফিরতে প্রমার সেদিন একটু দেরি হলো। রাত আটটা বাজে প্রায়। বাড়িতে ঢুকেই প্রমা টের পেল কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। ছোটো কাকুর ঘরে ঢুকেই দেখতে পেলো ছোটো কাকু খাটে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে। প্রমা ছুটে ওর ঠাম্মার ঘরে ঢুকলো। ঠাম্মার চোখেও জল। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো যে ওদের বাড়িতে রান্না করেন যে মহিলা, তার বাচ্চা মেয়ের কথায় অন্যায় ভাবে প্রমার বাবা তার কাকুকে বকেছে। রান্নার মহিলা তার ছোটো মেয়েটিকে নিয়ে প্রমাদের বাড়িতেই থাকতো। ছোট মেয়েটি মাঝে মাঝেই বাড়ির অন্য সকলের নামে এটা সেটা বলে প্রমার বাবার কান ভারী করতো। মেয়েটি প্রমার বাবাকে বলেছিলো যে কাকু নাকি বাজার করে পয়সা ফেরত দেয় না, একটা কৌটোতে জমিয়ে রাখে। বাচ্চা মেয়েটির কথায় বিশ্বাস করে প্রমার বাবা কাকুকে কিছু অপ্রিয় কথা বলেছিলো। প্রমার এই ছোটো কাকু প্রসঙ্গে কিছু কথা এখানে উল্লেখ করতেই হবে। প্রমার ছোটো কাকু অর্থনীতি নিয়ে আই. . পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেছিলো। তারপর তার জীবনে এক ভীষণ দুর্যোগ আসে, সে মানসিক ভারসাম্য হারায়। সেই থেকে ওষুধের জোরে সে স্বাভাবিক থাকে, -- বাড়ির সবার ফাই ফরমাস খাটে, দোকান বাজার করে ইত্যাদি ইত্যাদি। 

বাড়ির মধ্যে প্রমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিলো এই ছোটকাকু। এমন নরম মনের মানুষ প্রমা জীবনে কখনো দেখেনি। প্রমার যখন খুব মন খারাপ হত, বাড়ির মধ্যে একমাত্র সে এসে প্রমার খোঁজ নিতো, জিজ্ঞেস করতো, " এই, তোর কি হয়েছে? মন খারাপ কেনো?" সেই কাকুর প্রতি তার বাবার এরকম অন্যায় আচরণ তার কাকুর নীরব কান্না প্রমাকে ভীষণ দৃঢ়চেতা কঠিন করে তুললো। তার মনের জমাট জমাট অভিমানের কালো মেঘ বজ্রপাত বিদ্যুতের মত আগুন হয়ে ঝরে পড়লো। সে ছুটে গেলো বাবার ঘরে। বাবাকে বললো," বাবা, কাকু তোমার নিজের ভাই না! তো তোমার নিজের ভাই! তারপরও সে একজন অসহায় মানুষ, অসুস্থ মানুষ। তাকে তুমি আঘাত করলে, কাঁদালে, ওই মিথ্যাবাদী ছোট মেয়েটাকে বিশ্বাস করে!" প্রমা সেদিন আগুনের স্ফুলিঙ্গ, তার কন্ঠস্বরে সেদিন বিবেকের স্বঘোষিত বজ্রনিনাদ। প্রমার এই মূর্তি বাড়ির কেউ কখনো দেখেনি। বাড়ির আর সবাই তাদের কাজ ফেলে ছুটে এলো সেখানে। আর প্রমার বাবা, যে এই বাড়ির সর্বময় কর্তা প্রচণ্ড রাশভারী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ, প্রমার গনগনে আগুনের মত ব্যক্তিত্বের কাছে অসহায় ভাবে ম্লান হয়ে গেলো। প্রমার বাবারও ভিতরে ভিতরে একটা প্রচণ্ড অন্তর্দহন চলছিলো। সাথে সাথেই সে মানুষটি তার অন্যায় স্বীকার করে নিয়ে বললো, "হ্যাঁ, আমারও মনে হচ্ছিল ওই পাজি মেয়েটার কথা বিশ্বাস করা আমার ঠিক হয় নি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল এতক্ষণ সুবোধ, সুবোধ কোথায়?" এই কথাটা বলেই প্রমার বাবা ছুটে গেলো তার ভাই এর ঘরে। ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো, " সুবোধ, আমায় ক্ষমা কর।" তারপর উষ্ণ আবেগে সব গ্লানি ধুয়ে মুছে গেলো। বাড়ির পরিবেশ আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এলো। প্রমার হঠাৎ বাঁ হাতের কব্জির দিকে চোখ পড়াতে দেখতে পেলো রক্ত এখনও বন্ধ হয়নি, কাপড়টা ভিজে গেছে। তুলোতে ওষুধ নিয়ে নতুন কাপড় দিয়ে ক্ষতস্থানটা আবার ঠিক মত বেঁধে নিলো সে। অভিমান করে আর কোনোদিনও হাত পা কাটেনি প্রমা, শুধু গভীর চলা গোপন রাখার প্রতিজ্ঞায় মাঝে মাঝে সরব হতে শিখেছে।