গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সুবীর কুমার রায়

সাপের সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন

সাপ নিয়ে অকারণ ভীতি, ও সর্প নিধনের চরম অপকারিতা নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস এখন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। সাপ মেরে নিজেদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করতে কিছু দরিদ্র মানুষকে দেখা গেলেও, বিষধর ও বিষহীন সাপ সম্বন্ধে অজ্ঞতা ও পরিচিতির অভাব থেকেই মানুষ জীবনহানির ভয়ে সাপ হত্যা করে থাকে। আমি নিজেও এই অজ্ঞতার কারণে দু’-একবার যে সাপ হত্যা করেছি, একথা সত্য।  আবার একথাও তো সত্য, যে পরিস্থিতির কারণে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সাময়িক উত্তেজনায় কোন সাপকে হত্যা করে থাকে, বরং বলা ভালো, হত্যা করতে বাধ্য হয়। আজ বরং সাপ নিয়ে আমার দেখা কিছু ঘটনার গল্প শোনানো যাক।

প্রায় একত্রিশ বছর আগে, কর্মসূত্রে আমাকে তখন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একটা প্রত্যন্ত গ্রামে প্রায় পাঁচ বছর কাটাতে হয়েছিল। এলাকাটায় তখনও বিদ্যুৎ আসেনি, টেলিফোন ব্যবস্থাও চালু হয়নি। অত্যন্ত বিপদের সময়  থানাকে অনুরোধ করে তাদের বিশেষ ফোন থেকে ফোন করা যেত, যদিও সে সুযোগ সাধারণ মানুষের কাছে প্রায় দুর্লভ ছিল। বিকেলের পর বাস চলাচল ছিল না বলা চলে, সেক্ষেত্রে নিকটবর্তী শহরের সাথে যোগাযোগের জন্য একমাত্র ভরসা ছিল মানুষ টানা ভ্যানরিক্সা। তাও দূরত্বের জন্য বেশিরভাগ সময়েই একবার বা দুবার ভ্যানরিক্সা বদল করে শহরের মুখ দেখতে হতো।
এহেন একটা জায়গায় পোস্টিং পেয়ে প্রথম যে সুখবরটি জানা গেল, তা হলো এলাকাটিতে ভয়ানক সাপের উপদ্রব। অবশ্য আমাদের অফিসের কাছেই ব্লক হেল্থ সেন্টারটি অবস্থিত, এবং স্থানীয় একমাত্র ডাক্তার, বৃদ্ধ হরিপদ বাবু, এম.বি., নিকটেই বসবাস করেন। জানা গেল হরিপদবাবু সাপেকাটা রোগীর ধন্বন্তরি, সাপেকাটা কোন মানুষকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে পারলে, বিপদের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও সমস্ত এলাকাটি নিম্নচাপ কবলিত, এবং এঁটেল মাটির কর্দমাক্ত পিচ্ছিল রাস্তার জন্য অনেক সময়েই সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো।

আমাদের অফিসটা নাকি একসময় একটা বইয়ের দোকান ছিল। বাড়িটা ছোট হলেও ভিতরে বুলন্দ দরওয়াজার থামের আকারের খান তিনেক থাম ছিল। ছাদে জল জমে থাকার ফলে বাইরে বৃষ্টি না হলেও, ছাদ দিয়ে জল পড়ার বিরাম ছিল না। সে যাহোক, ওখানে যাওয়ার দিন তিনেক পরে একদিন বাড়ি আসার বিশেষ প্রয়োজন। ঠিক হলো দুপুরের বাসে মূল রাস্তায় এসে, সেখান থেকে হাওড়ার বাস ধরবো। দুপুরের খাবার খেয়ে বাসের অপেক্ষায় নিজের চেয়ারে বসে আছি। আমার ঠিক পিছনে একটা ছোট্ট ঘর রেকর্ড রূম হিসাবে ব্যবহৃত হতো। রাস্তার দিকের দেওয়াল ও মেঝের সংযোগ স্থলে বিরাট একটা ফাটল ছিল। আমার সামনে কিছুটা দূরত্বে ম্যানেজার, নবীন বাবুর বসার সিট্হঠাৎ তিনি ভয়ার্ত কন্ঠে চিৎকার করে আমায় পায়ের কাছটা দেখতে বললে, আমি চেয়ারের ওপর পা তুলে দিয়ে লক্ষ্য করলাম, যে একটা মোটা কালো চকচকে আঁশের দাগযুক্ত বেশ বড় সাপ, আমার চেয়ারের তলা দিয়ে এঁকেবেঁকে দ্রুত গতিতে আমার পিছনের রেকর্ড রূমে গিয়ে ঢুকলো। আমাকে অনবরতই ওই ঘরে ঢুকতে হতো। অজস্র খাতাপত্রের ভিড়ে কোথাও ঢুকে পড়লে, তাকে খুঁজে বার করা অসম্ভবওই ঘরে ঢুকে দেখি সাপটা সেই ফাটল দিয়ে শরীরের অর্ধেক অংশ বার করে রাস্তায় চলে যাচ্ছে। কি দিয়ে মারা যায় খুঁজতে খুঁজতেই, সেটা ফাটল দিয়ে বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে বাসের হর্নের শব্দে বাইরের রাস্তায় এসে দেখি বহুদূরে বাসটা দাঁড়িয়ে সম্ভবত লোক তুলছে। রাস্তার দিকে ফাটলের জায়গাটায় ইঁট ভেঙে খোয়া তৈরি করে জমিয়ে রাখা আছে। তার ওপর দিয়ে সাপটা মুখে একটা ব্যাঙ নিয়ে রাস্তায় এসে তাকে কব্জা করার চেষ্টা করছে। বাসটা এগিয়ে আসছে দেখে একটা আধলা ইঁট দিয়ে তাকে আঘাত করলে, সে আধমরা হয়ে রাস্তায় পড়ে রইলো। বাসটা একবারে কাছে চলে এসেছে, ফলে ড্রাইভারকে ইশারা করে সাপটার ওপর দিয়ে চলে যেতে বললাম। ড্রাইভার কিন্তু দক্ষ হাতে তাকে কাটিয়ে এসে বাস দাঁড় করালো। আমি বাসে উঠে পড়লাম। একটু এগিয়েই বাসটা একটা দোকানের সামনে বাস দাঁড় করিয়ে, ড্রাইভার ও কন্ডাক্টার ভাত খেতে বসলো। খাওয়া হলে বাস ছাড়বে। সাপটাকে অর্ধমৃত অবস্থায় দেখে এসেছি, তাই এই সুযোগে আমি আবার সাপটার কাছে ফিরে এলাম। পাড়ার লোক তো বিরাট চিৎকার শুরু করে দিলো, আপনাকে কেটেছে যা আপনি মারলেন। সেদিন প্রথম জানলাম, যে সাপে কাটার পরই সাপকে মারার অধিকার জন্মায়। যাহোক আমি আবার বাসে ফিরে গেলাম।

পরে দেখেছি, এখানে প্রচুর পরিবার আছে, যাদের বাড়ির কেউ না কেউ সাপের কামড়ে মারা গেছে, অথবা কপাল জোরে বেঁচে ফিরেছে। অথচ তার জন্য সাপের প্রতি প্রেম ভালবাসা এতটুকু কমেনি। একটা উদাহরণ দিলে বোধহয় বুঝতে সুবিধা হবে। একদিন এক কাস্টমার কথা প্রসঙ্গে আমায় বললেন, “আমার বাড়িতে উনি   থাকতেন, দীর্ঘদিন তাঁকে বাড়ির আনাচে কানাচে দেখতাম। বড় মায়া পড়ে গেছিল। একদিন দেখলাম উনি নেই, তাঁকে আর কোথাও দেখতে পেলাম না। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল, চোখে জল এসে গেল। অনেকদিন পরে মেয়ে বললো, বাবা উনি ফিরে এসেছেন। দেখলাম উনি সত্যিই আবার ফিরে এসেছেনএতক্ষণ যার সম্বন্ধে উনি কথাগুলো বললেন, তাঁর কথামতো উনি, আসলে একটা বাস্তু বিশেষণ যুক্ত সাপ।

এখানকার মানুষ গোখরো কে খরিস, ও কেউটেকে তপ্ বলতেন, তবে খরিসের চেয়ে তপের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। সিং পাড়া নামে একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল, সেখানকার পুরুষেরা সাপ ধরে, ও মহিলারা শীতলপাটি মাদুর তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। শীতলপাটি নামে পরিচিত হলেও, আসলে সেগুলো খেজুর পাতা দিয়ে বোনা হতো। স্থানীয় এলাকায় খরিস বা তপের অভাব মোটেই ছিল না। এই অঞ্চলের কাছাকাছি, একটা বহু পুরাতন বাড়ির ধ্বংসস্তুপ আছে, শোনা যায় ওটা একটা পোস্ট অফিস ছিল। শুধু তাই নয়, সত্য মিথ্যা জানি না, তবে এটাই নাকি ভারতবর্ষের প্রথম পোস্ট অফিস। এই ধ্বংসস্তুপ থেকে একদিনে একুশটা তপ্ ধরা পড়েছিল। তবু নিকটবর্তী উড়িষ্যা অঞ্চলেও, তারা অধিক আয়ের আশায় সাপের সন্ধানে যেত। কিন্তু আমাদের দেশে আর যারই অভাব থাকুক না কেন, দই খাওয়ার নেপোর অভাব কোন কালে হয়নি। এক শ্রেণীর দালাল, এদের কাছ থেকে সামান্য টাকার বিনিময়ে এই সাপগুলো কিনে নিত। শুনতাম সাপগুলো নাকি ট্রপিক্যাল মেডিসিনে বিক্রি করা হয়। কোথায় বিক্রি করা হয় জানি না, তবে কোথাও না কোথাও যে ভালো দামে বিক্রি করা হয় এটা সত্য, তা নাহলে তারা সাপগুলো কিনে কি করতো?

প্রতিদিন ভ্যান রিক্সা করে বাড়ি ফেরার সময় কতবার যে তপ্ বা খরিস দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। মিলন নামে এক ভ্যান রিক্সা চালক আমাদের দু-তিনজনকে প্রায় প্রতিদিনই নদীর ধার থেকে অফিস, ও অফিস থেকে নদীর ধারে পৌঁছে দিত। এর কপালে বোধহয় সর্পাঘাতের আভিশাপ লেখা আছে। বার দু-এক সাপের কামড় ও বারকতক আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েও সে এখনও বেঁচে বর্তে আছে। এক দুর্যোগপূর্ণ নিম্ন চাপের বিকালে, আমি ও আমার এক সহকর্মী, মিলনের ভ্যান রিক্সায় পা ঝুলিয়ে বসে প্রায় কাকভেজা হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে নদীর ধারে যাচ্ছি। দুপাশে ঘাস জঙ্গল ও নয়নজুলির মাঝখান দিয়ে ভাঙাচোরা পিচের রাস্তা। শ্যামপুর নামে একটা জায়গায় এসে, হঠাৎ সেই হাড় হিম করা ঘটনাটা ঘটলো। এই শ্যামপুরেই গ্রামের ভিতরে মিলনের বাসাহঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সম্ভবত মিলনকে চিনতে পেরে, একটা বেশ বড় তপ্ দ্রুত গতিতে এসে সরাসরি মিলনের ভ্যানরিক্সার সামনের চাকার স্পোকে জড়িয়ে গেল। অভিজ্ঞ মিলন ততক্ষণে ভ্যানরিক্সার হ্যান্ডেলে পাদুটো তুলে দিয়েছে। আমরাও ভ্যানরিক্সার কাঠের তক্তার ওপর পা তুলে নিয়েছি। সাপটা ফণা তুলে স্পোক থেকে প্রায় আধ হাত শরীর ওপরের দিকে উচিয়ে তীব্র শিসের মতো হিস্  হিস্ আওয়াজ করতে শুরু করলো। আমাদের শরীর থেকে তার উদ্যত ফণার দূরত্ব অতি সামান্যই। কোনরকমে স্পোকমুক্ত হলে, হয় মিলন, না হয় ডানদিকে আমার ঊরুতে ছোবল মারবে। মিলনের রিক্সা থেকে নামার উপায় নেই, আমরা পিছন দিক দিয়ে নেমে সাপটাকে মারার জন্য একটা লাঠি জাতীয় কিছু খুঁজে না পেয়ে, শেষে সাপটার ওপর তীব্র নজর রেখে রিক্সাটাকে পিছন দিকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলাম। একটু পরেই সাপটা মাটিতে পড়ে গেল, কিন্তু তার তখন তীব্র শিসের মতো আওয়াজ করা ছাড়া, নড়বার ক্ষমতা নেই। মিলন এবার রিক্সা থেকে নেমে, একটা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে এসে ডাংগুলি খেলার মতো সাপটাকে অনেক দূরে নয়নজুলির জলে ফেলে দিল। হয়তো সাপটা আমাদের কাটার সুযোগ না পাওয়ায়, মারার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে তাকে একাজ করতে হলো। আমরা গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম।

পরবর্তীকালে নিকটবর্তী শহরের লজ্ ছেড়ে, অফিসের কাছে সেই শ্যামপুরেই রাস্তার ঠিক পাশে একটা দোতলা বাড়ির একতলায় মেস করে অফিসেরই পাঁচজনে থাকা শুরু করলাম। বাড়িটা দক্ষিণমুখী হলেও, লাইট না থাকায় ও সামনের খোলা ফাঁকা জায়গাটায় গাব, আম, তেঁতুল, কামরাঙা, ইত্যাদি প্রচুর গাছপালা ও জঙ্গলি গাছ থাকায়, প্রয়োজনে দিনের বেলাতেও হ্যারিকেন জ্বালাতে হতো। বাড়ির আশেপাশে গাছপালার পাশ দিয়ে একটা বেশ বড় বড় কালচে আঁশের মতো শরীরের বিরাট লম্বা সাপকে প্রায়ই দেখা যেত। বাড়িওয়ালার ছেলে জানিয়েছিলেন, যে ওটা বাস্তু সাপ, বড় নিরীহ। ওকে কেউ কামড়ালেও, ও কাউকে কামড়াবে না। একদিন আমি ও আমার ম্যানেজার, নবীন বাবু সন্ধ্যার মুখে মেসে ফিরে যে যার ঘরে ঢুকলাম। বাকি তিনজন তখনও মেসে ফেরেনি। নবীন বাবু তাঁর ঘরে ঢুকেই, আর্তনাদ করে চিৎকার করে উঠলেন। আমি এক দৌড়ে তাঁর প্রায় অন্ধকার ঘরের কাছে গিয়ে দেখি, তিনি তাঁর চৌকির ওপর দাঁড়িয়ে। আমায় দেখেই তিনি আমাকে পালাতে বললেন। ওনার একটু ভূতের ভয় আছে জানতাম, তাই কোন ভৌতিক উপদ্রব কী না জিজ্ঞাসা করায় তিনি কোন উত্তর না দিয়ে বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে, হাত নেড়ে আমায় পালাতে বললেন। এবার একটু ভয় পেয়েই আমি দ্রুত নিজের ঘরে ফিরে এলাম।

কিছুক্ষণ পরে পরিবেশ ঠান্ডা হলে ঘটনাটা জানা গেল। ম্যানেজার আধো অন্ধকার ঘরে প্যান্ট্ ও টিশার্টটা দেওয়ালের হুকে আটকে রেখে লক্ষ্য করেন, বেল্টটা চৌকির পাশে মাটিতে পড়ে আছে। হুকে ঝুলিয়ে রাখার জন্য মাটি থেকে বেল্টটা তুলে নিতেই অসম্ভব গতিতে বেল্টটা হাত থেকে পালাবার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, আসলে সেটা বেল্ট ছিল না, সেটা ছিল বাড়িওয়ালার পরম আদরের বাস্তুসাপ। অন্ধকারে হ্যারিকেনের আলোয় তাকে আর খুঁজে না পেয়ে, ম্যানেজার রাতটা অন্য ঘরে ভয়ে ভয়ে কাটালেনঠিক করলাম বাস্তুকে যখন উদ্বাস্তু করা যাবেই না, তখন নিজেদেরই একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। কয়েকদিন পরেই তাকে সামনের জমিতে পেয়ে গেলাম। হাতের কাছে একটা আধলা ইঁট পেয়ে গিয়ে, টিপ করে সজোরে তার ওপর ছুঁড়ে দিলাম। কিন্তু পাশের গাছটায় হাত লেগে কবজির কাছ থেকে অনেকটা বেশ গভীরভাবে ছড়ে গেল। পরে শুনলাম সেটা নাকি বেত গাছ।

কয়েকদিন পরে তাকে বাড়িওয়ালার ধানের গোলার মাচার নীচে দেখতে পেলাম। অত নীচে বাড়িওয়ালার চোখ এড়িয়ে লাঠি বা ইঁট দিয়ে আঘাত করাও সম্ভব হলো না। ফলে খানিক পরে লক্ষ্য করলাম যে তিনি কোনসময় স্থান ত্যাগ করে চলে গেছেন। তৃতীয়বার প্রায় সন্ধ্যার দিকে পুকুর ঘাটে তার সাথে মুলাকাত হলেও অস্ত্রের অভাবে যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।

সিং পাড়ার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ভীষণ রকমের দরিদ্র মানুষগুলো, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের  এলাকা ও উড়িষ্যা থেকে সাপ ধরে দালালদের কাছে অতি অল্পমূল্যে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। মহিলাদের ঋণ দেওয়ার একটা বড় টার্গেট পুরণ করতেই হতো। তাছাড়া সাপ ধরার জন্য যেহেতু ব্যাঙ্ক ঋণ দেওয়া যেত না, তাই মহিলাদের শীতলপাটি বোনার জন্য, দেড় হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়া হতো। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হওয়ার জন্য, এই দেড় হাজার টাকার পঞ্চাশ শতাংশ আবার সরকারী অনুদান দেওয়া হতো কিন্তু একজন মানুষকেও এই সাতশপঞ্চাশ টাকার এক টাকাও শোধ করতে দেখিনি। সেদিন অনেক নিয়মের বাধা থাকায় সবকিছু বুঝেও যেকথা মুখ ফুটে বলার অধিকার ছিল না, বা বলতে পারিনি, তা হলো তাদের কাছ থেকে একটা পয়সা ঋণ শোধের আশা করা শুধু মুর্খামি নয়, অন্যায়ও বটে। একমাত্র বিবেকহীন পাষণ্ডের পক্ষেই সেই আশা করা সম্ভব।

সে যাইহোক, যে কথা বলতে গিয়ে এত কথা এসে পড়লো, নিয়মমাফিক প্রতিটা গ্রামের প্রতিটা ঋণ গ্রহিতার সাথে দেখা করা আমার কাজের মধ্যে পড়তো। যেটা বাস্তবে অবাস্তব হলেও, আমার মতো একজন রুরাল ডেভেলপমেন্ট অফিসারকে সরকারি ও অফিসের নিয়মে, মানবমুক্তি, অর্থনৈতিক উন্নতি, চ্ছলতা, ইত্যাদির কারণে করতে হতো। বাস্তবে সম্ভব ছিল না, তাই মিথ্যা বলতেও বাধ্য হতে হতো, কারণ তারা নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবে ঋণের কিস্তি শোধ করে না। তার ওপর আমার পক্ষে সকলকে চেনা অসম্ভব হলেও, তারা প্রায় সকলেই আমাকে চিনতো। ফলে তারা স্বচ্ছন্দে আমার সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলতো, আর এই কারণে তাদের সাথে আমার একটা চোর পুলিশ খেলা লেগেই থাকতো। অথচ নেতা বা নেতার আশীর্বাদ ধন্য ঋণ গ্রহিতারা দিব্যি হাসিমুখে বুক ফুলিয়ে অফিসে এসে, প্রজাদের নতুন ঋণ প্রদান নিয়ে তদবির তদারকি করতো

শুক্রবার আমাদের নন্-ব্যাঙ্কিং ডে ছিল, ফলে ওইদিন অফিস খোলা থাকলেও, কোন লেনদেন হতো না। আর এই শুক্রবারগুলো আমাকে সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ইন্সপেকশন বা তাগাদায় যেতে হতো। এরকমই একটা শুক্রবারে দুজন কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে সিং পাড়ায় নিয়ম রক্ষার্থে তাগাদায় গেলাম। যদিও জানি আদায় এক পয়সাও হবে না, যদিও জানি গোটা দিনটা হয়তো অনেকেই অভুক্ত বা আধপেটা খেয়ে আছে, তবু ওই যে বললাম নিয়ম রক্ষার্থে যেতে হলো। মিথ্যা কথা বলবো না, আজ সিং পাড়া যাওয়ার পিছনে অন্য একটা কারণও আছে, আর সেটা সাপ দেখা। এমন ঘটনাও দেখেছি, যে বেতের চুবড়ি বা মাটির হাঁড়ি করে উড়িষ্যা থেকে সাপ ধরে ফিরছে। ঘাটের নৌকোয় অনেক যাত্রী, তাদের কেউ একজন জিজ্ঞাসা করে বসলো, ও সিং-এর পো কটা ধরলে গো? ব্যাস সিং-এর পো অমনি মাঝ নদীতে নৌকার ভিতর হাঁড়ি থেকে সাপ বার করে বসলো। এদের সংগ্রহের একটা সাপও কিন্তু বিষদাঁত ভাঙা নয়, কারণ বিষদাঁতহীন সাপ কিন্তু বিক্রি হবে না। যাইহোক শেষপর্যন্ত আবার গর্জনরত খরিস বা তপকে হাঁড়ির ভিতর চালান করে নৌকো যাত্রীদের বিপম্মুক্ত করলো। আমরা সেই সিং-এর পোয়ের গ্রাম সিং পাড়ায়, রথ দেখা ও কলা বেচার মতো, সাপ দেখা ও তাগাদা করার ধান্দায় এসে একটা বাড়িতে হাজির হলাম।

আমাকে হঠাৎ দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেও, পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য একটা একদিকের হাতল ভাঙা কাঠের চেয়ার বাইরের মাটিলেপা পরিস্কার শুকনো জায়গাটায় পেতে দিয়ে বসতে বললো। বসলাম, দুধারে দুই শাগরেদ দাঁড়িয়ে রইলো। উপায় নেই, এর কাছে এর বেশি আশা করাও অন্যায়। এরপর সে তার প্রথা মাফিক দুঃখ দৈন্যতার হিসাব দিতে বসলো। আমাকেও নিয়ম মাফিক কিছু শোধ করা ও শোধ না করলে বিপদের গল্পের রেকর্ড বাজাতেই হলো। আগের ঋণ শোধ করে, বেশি টাকার নতুন লোনের টোপও দিতে হলো। কিন্তু এপক্ষের মোলায়েম ব্যবহার ও ঋণ শোধের জন্য বিশেষ চাপ না দেওয়া লক্ষ্য করে, সে একটু নিশ্চিন্ত হলো। এবার আমি আসল উদ্দেশ্যে ঢোকার প্রয়াস নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, শীতলপাটি থেকে যথেষ্ট আয় না হলেও, সাপ বিক্রির টাকা থেকে কিছু কিছু টাকা শোধ করো না কেন? সে কোন ভণিতা  না করে খুব সরল ভাবে বললো, সাপ বিক্রি করে বিশেষ টাকা পাইনা বাবু। সাপ তো আর আলু পেঁয়াজ নয় যে বাজারে গিয়ে বেচে দেবো, ও তো কলকাতায় গিয়ে বেচতে হয়। তাই চেনাশোনা কিছু লোকের কাছে খুবই কম দামে বেচে দিতে হয়। ওরা কলকাতা গিয়ে ওষুধ কোম্পানির কাছে অনেক টাকায় বিক্রি করে দিয়ে আসে। এ তথ্য তো আমার জানা, তাই কথা না বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কাছে এখন কতগুলো আছে? উত্তরে সে জানালো, যে দুদিন আগেই এ পাড়ার সকলের কাছ থেকে ওরা মাল নিয়ে গেছে, তাই প্রত্যেকের ঘরেই দুএকটার বেশি হবে নাআমি জিজ্ঞাসা করলাম ওগুলো একটু দেখা যায়, সঙ্গের বাবুরা একবার দেখতে চাইছে। লোকটি বিপদের আশঙ্কা নেই দেখে, অত্যন্ত খুশি হয়ে আর সব বাড়ির কর্তাদের নাম ধরে চিৎকার করে জানালো যে ম্যানেজার বাবু আইটে সাপের খেলা দেখতে চাইছে।

মুহুর্তের মধ্যে কয়েকজন, অল্প হলেও তাদের সঞ্চিত সম্পদ এনে খোলা জায়গাটায় রাখলো, সাথে পিলপিল করে একগাদা বাচ্চা এসে হাজির হলো। এরা কিন্তু সাপ খেলা দেখায় না, পয়সা দিয়ে সাপ খেলা দেখার মতো বিলাসিতা করার মতো মানুষই বা এ তল্লাটে কোথায়? এরা সাপ বিক্রি করে, তাই যে অবস্থায় এরা সাপ ধরে ঠিক সেই অবস্থাতেই চুবড়ি বা হাঁড়ির ভিতর বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত রেখে দেয়। এদের মধ্যে একজন সবকটা চুবড়ি বা হাঁড়িকে পরপর এক জায়গায় রেখে, খেলা দেখাবার জন্য মাটিতে বসলো। সম্ভবত এই লোকটিই এই অঞ্চলের সব থেকে অভিজ্ঞ ও এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। আমাদের ঘিরে কিছু পুরুষ ও অনেকগুলো বাচ্চা।

বহুকাল আগে দেখতাম, সাপ খেলা দেখাবার আগে দুই হাতে দুই পুতুল নিয়ে খেঁদি নাচবি খেঁদি গান করে  দুই সতীনের তুমুল ঝগড়া লাগাতো। পুতুল দুটোর সম্পর্ক ছিল দুই সতীনের। দুজনের মধ্য বিবাদ ও মারামারি দেখিয়ে, সঙ্গে তুই ওলাউটো, তুই ভাতারখাকি, তুই উচ্ছেখাকি, তুই পটলখাকি, তুই নির্বংশ, ইত্যাদি যা মনে আসতো, কিছু গালাগালি দিয়ে সময় কাটিয়ে বিষদাঁত ভাঙা নির্জীব সাপের খেলা শুরু করতো। এখানে পুতুল নেই, পুতুল খেলাও নেই। নেই, তার কারণ এরা সাপ খেলা দেখায় না। সাপ ও সাপের হিংস্রতা দেখাতেই এদের এই আয়োজন, তবে খেলা দেখাবার আগে কালীদহে গো কানাই ডুবেছে না মরেছে বলে কিছুক্ষণ গান শোনানো হলো। এরপর শুরু হলো খেলা, খেলা মানে পরপর সবকটা চুবড়ি বা হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেওয়া। ওদের ঠিক সামনে আট-দশ হাত দুরত্বে আমরা আছি, আর আছে বেশ কিছু পুরুষ ও অগুণতি শিশু।

চুবড়ির ঢাকনা খোলার সাথে সাথে, আট-দশটা সাপ চুবড়ি থেকে বেড়িয়েই সামনের দিকে এগতে শুরু করলো। যে খেলা দেখাচ্ছে তার একমাত্র কাজ হলো, সাপগুলোর ওপর তীব্র নজর রাখা ও পিয়ানো বাজানোর মতো, যে সাপটা বেশি এগিয়ে গেছে, তার লেজে টোকা মারা। টোকা মারার সাথে সাথে আঘাতপ্রাপ্ত সাপটা ফণা তুলে তীব্র আওয়াজ করছে। আমি প্রয়োজনে নিজেকে বাঁচাবার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, অথচ বাচ্চাগুলোকে কিন্তু কেউ সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো নাস্বাভাবিক ভাবেই এই খেলার স্থায়িত্ব কিন্তু খুব অল্প সময়ের। খেলা শেষ হলে অদ্ভুৎ তৎপরতায়, এবং সাবধানতায় তাদের ধরে আবার চুবড়িবন্দী করা হলো। বাচ্চাদের নিয়ে কিছু পুরুষ চুবড়ি হাতে ঘরে ফিরে গেল। কিছু আমাদের ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো। একটা ব্যাপার দেখে অদ্ভুত লাগলো, এদের অনেকেরই হাতে বা পায়ে, তাবিজের মতো ছোট্ট কিছুটা অংশ ফুলে আছে। শুনলাম এগুলো নাকি সাপে কামড়ানোর ফলে হয়েছে।

আমি আবার চেয়ারে বসে ঋণ গ্রহীতার তালিকা বের করার সাথে সাথে, প্রথমজন আবার চিৎকার করে উঠলো, ফিল্টার বাবু (ফিল্ড অফিসার) আয়েটে ডাব কেটে নিয়ে আয়। এদের এখানে ভাত রুটির অভাব থাকলেও, ডাবের অভাব নেই। একটা দুটো নারকেল গাছ সব বাড়িতেই আছে। বারণ করা সত্বেও একজন কয়েকটা ডাব, গাছ থেকে পেড়ে এনে সাপ খেলা দেখানো লোকটির হাতে দিলো, সাথে একটা চকচকে কাটারি।  ওই সাপ ধরা হাতে কাটা ডাব খাওয়ার ইচ্ছা মোটেই ছিল না, তবে ফিল্টার বাবু বলে কথা, তাই খেতেই হলো। শেষ হলো আমাদের সাপ দেখা কাম ঋণের তাগাদা করা মিশন।

আমরা যে বাড়িটায় মেস করে থাকতাম, তার উলটো দিকে ছিল একটা মসজিদ। আশেপাশে বেশ কিছু টালির চালের মাটির ছোট ছোট ঘরবাড়ি। একদিন খুব ভোরে বার বার একই সুরে চিৎকার শুনে, কি হয়েছে বুঝবার জন্য ভালো করে কান পেতে শুনি কে যেন বার বার ও সিং-এর পো, মসজিদের কাছে জালে সাপ পড়েছে গোবলে চিৎকার করে যচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে দেখি চিৎকারের উৎসস্থল মসজিদের ডানদিকে একটু দুরেই এক পুকুর পাড় থেকে। রাতে পুকুরে একটা জাল ফেলে রাখা ছিল, জানি না সেই জালে কিভাবে মাছ ধরা পড়ে। তবে সেই জালের ভিতর মাছের পরিবর্তে এক বিরাট তপ্, অর্থাৎ কেউটে ধরা পড়েছে। জালের ছোট্ট গর্তে তার মুখের চোয়ালের কাছটা আটকে যাওয়ায় সে জালমুক্ত হতে না পেরে সারারাত পুকুরের জলে জালে জড়িয়ে কাটিয়েছে। সকালে জাল ও পুকুরের মালিক জল থেকে জাল তুলে, সাপটাকে দেখে ঘাবড়ে যায়। সাপটার পেটের কাছটা বেশ মোটা, সেটা জল খেয়ে না মাছ খেয়ে জানি না, তবে তার অবস্থা তখন বেশ কাহিল, নড়াচড়া করার ক্ষমতাও নেইজালের মালিকের তখন মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। জাল থেকে সাপকে মুক্ত করার সাহস বা বিদ্যে, কোনটাই তার নেই, আবার সাপ সমেত জালটা ফেলে দেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব নয়। শেষে একমাত্র উপায় হিসাবে ক্রমাগত ওই চিৎকার—“ও সিং-এর পো, মসজিদের কাছে জালে সাপ পড়েছে গো

এই পুকুরের কাছ থেকে সিং পাড়া অনেক, অনেকটাই দূরে। মনে পড়ে গেল অরণ্যদেবের খুলি গুহার গল্প। ঠিক সেই একই কায়দায় একটু দূরের একজন একই কথা বলে চিৎকার করলো, তার চিৎকার শুনে আরও একটু দূরের আর একজন। এইভাবে মুহুর্তের মধ্যে খুলি গুহার মতো, সিং পাড়ায় সুসংবাদটা পৌঁছে গেল। এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে, সিং পাড়ার একজন খোঁজ নিয়ে নিয়ে পুকুর পাড়ে চলে এলো।

 পুকুর পাড় থেকে জালটা তুলে নিজের প্রায় মুখের কাছে এনে, আমরা যেভাবে সুতোর জট ছাড়াই, সেইভাবে অনেক কসরত করে সাপটাকে জালমুক্ত করে নিজের প্রায় পায়ের কাছে মাটিতে শুইয়ে দিল। সাপটার তখন আক্রমণ করা বা পালানোর ক্ষমতা নেই, বেঁচে আছে এটুকু বোঝা যাচ্ছে। দুচারবার ঠেলে দেওয়ার পরেও যখন সে শুয়ে রইলো, তখন সিং-এর পো সাপটার মাথাটা ধরে চাপ দিয়ে হাঁ করিয়ে, মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জলে ডোবা মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসার মতো সাপের মুখে জোরে জোরে কয়েকবার ফুঁ দিয়ে,  মাটিতে নামিয়ে রাখলো। কিছুক্ষণ পরেই সাপটা ধীরে ধীরে এগবার চেষ্টা করতেই সিং-এর পো সাপটাকে থলে বন্দী করে পুকুরের মালিককে সাপের কবল থেকে মুক্ত করে, বিনা চেষ্টায় ও প্রায় বিনা পরিশ্রমে বিনা পয়সায় একটা তপ্ লাভ করে বাড়ি ফিরে গেল। আমিও প্রায় উলটো দিকের মেসে ফিরে এসে দ্বিতীয় দফা ঘুমের চেষ্টা দেখলাম।