ধারাবাহিক
হ্যান্টেড কাহিনী--৩০
হেস্টিংস হাউজ--মিস্টেরিয়াস
ওয়ারেন
হেস্টিং ছিলেন বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল। তিনি তাঁর বেশীর ভাগ সময় যেখানে বাস
করে গেছেন সেটা হল কলকাতার আলিপুরে অবস্থিত হেস্টিংহাউজ। শশীভূষণ নেটে হেস্টিং
হাউজের ওপর কোন হ্যান্টেড কাহিনীর ভিডিও খুঁজে পেলেন না। তবে সেখানকার কিছু অলৌকিক
রহস্যের কথা নিয়ে লেখা কিছু আর্টিকেল তাঁর চোখে পড়ল। হেস্টিংহাউজ ও তার আশপাশের
রহস্যজনক ব্যাপারগুলি ছিল অনেকটা এই রকম--হেস্টিং তাঁর জীবনের কিছু মূল্যবান কাগজপত্র ও জিনিস হেস্টিং হাউজে রেখে
ছিলেন। মৃত্যুর পরে নাকি তাই তিনি এ হাউজে এসে গভীর
রাতে সে সব ফাইল ও জিনিস পত্র খুঁজে বেড়ান। হেস্টিং যে ঘোড়ার গাড়িতে মাঝে মাঝে
যাতায়াত করতেন সেই চারটে সাদা
ঘোড়ায় টানা গাড়িটাকে আজও নাকি কোন কোন মাঝ রাতে দেখতে পাওয়া যায়। সে গাড়ি থেকে
হেস্টিংকে উঁকি মারতেও কেউ কেউ নাকি দেখেছে বলে দাবি করে। আরও একটা দৃশ্য
হেস্টিংহাউজ সংলগ্ন মাঠে দেখা যায়। সেটা হল--মাঝ রাতে
একটা ছেলে মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার বন্ধুদের আসার অপেক্ষা করতে থাকে। কাউকে যেন সে
হাত ছানি দিয়ে ডাকে। সেই ছেলেটি নাকি একদিন এই মাঠে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলার সময়
বুকে বলের আঘাত লেগে মারা গিয়ে ছিল। এ ঘটনার পর থেকেই তাকে অনেক রাতে হঠাৎ হঠাৎ
এমনি ভাবে দেখতে পাওয়া যায়!
শশীভূষণ
ঘটনাগুলি পড়ার পর থেকেই সেখানে যাবার পরিকল্পনার কথা ভাব ছিলেন। তারপর একদিন তিনি যথারীতি তাঁর বন্ধু জনান্তিক ও অর্ণবকে জানিয়ে হেস্টিংহাউজ ভিজিট
করার দিন স্থির করলেন।
শশীভূষণ
অকৃতদার। অর্ণব বিপত্নীক আর জনান্তিকের স্ত্রী আছেন কিন্তু ছেলেপুলে না হওয়ায়
সংসার নিয়ে তিনি তত জড়িয়ে পড়েননি। কাজেই একমাত্র তাঁদের দ্বারাই সম্ভব এ ধরনের
মিস্টিরিয়াস ঘটনার পেছনে ছুটে ফেরা। ওঁদের নিজস্ব পেশা থাকা সত্যেও
নেশা হিসাবে এই কাজটা তাঁরা মাঝে মাঝেই চালিয়ে যান।
রাত তখন
এগারোটা বেজে গেছে। তিন বন্ধু এসে হাজির হলেন হেস্টিংহাউজের সামনে। এখানে
বিল্ডিংয়ের সামনে বিস্তৃত জাগা বিছিয়ে আছে সাজানো গাছপালা ও ফুলের বাগান, তার একপাশে বড় খোলা ময়দান। অনেক
রাত বলেই হবে সামান্য টিম টিমে আলো এখানে ওখানে জ্বলছে। বিল্ডিঙে তিনটে সাবেকী
প্রকাণ্ড প্রবেশ পথের দরজা, একাধারে দুই পরতে লোহার ও কাঠের তৈরি। মাঝের অপেক্ষাকৃত বড় দরজাটাই প্রধান বলে
মনে হয়। এক দিকে দু দরজার মাঝখানে বেশ বড় সর কালো পাথরের প্লেটে কিছু একটা লেখা
আছে। হেস্টিংহাউজ ও তার স্থাপনার কথাই লেখা থাকবে। তা ছাড়াও দরজার উপর ও পাশে অফিস
ও কোম্পানির সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। অস্পষ্ট অন্ধকারে সেগুলি পড়ে ওঠা যাবে
না। অন্যদিকের আশপাশে
এদিক ওদিক দু-চারটে বড়
গাছ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক নির্জনতা ভরে আছে।
হেস্টিংহাউস
সংস্কারের পর আগের মত আর পোড়ো বাড়ি নেই। এখানে দু'একটা ব্রাঞ্চ কোম্পানির অফিস ছাড়াও রয়েছে ওমেন কলেজ ও ছাত্রীদের থাকার
ব্যবস্থাও। বিল্ডিংয়ের ওপরের তলার দু-একটা ঘর থেকে তখনও আলোক রশ্মি বাইরে এসে পড়ছে। তার মানে, হোস্টেলের ছাত্রীদের কেউ কেউ এখনো জেগে আছে। নিচে প্রধান প্রবেশ দ্বারে কিছু
কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। দ্বারের এক পাট খোলা আছে বলে মনে হচ্ছে।
তিন বন্ধু
খানিক দাঁড়িয়ে থাকলেন, তাকিয়ে থাকলেন সামনের বিল্ডিং, রাস্তা ও আধ অন্ধকারের দিকে। আশপাশে দু তিন কামরার ছোট বড় বিল্ডিং আছে বটে তবে
তা হেস্টিংহাউজের অফিস বা হোমগার্ডদের জন্যেই তৈরী করা হয়ে ছিল হবে। এ ছাড়া আর কোনও ঘর বাড়ি বা লোকালয়ের
অস্তিত্ব নজরে পড়ে না।
এর মধ্যে
নির্জনতা ভেঙে হঠাৎ অর্ণব ফিসফিসিয়ে উঠলেন,
ওই ওই, ওই দেখো একটা কালো ছায়া--
--কোথায়? জনান্তিক
যেন আঁতকে উঠলেন।
শশীভূষণ
চাপা স্বরে বললেন, মনে হচ্ছে গার্ড হবে--কোন
অশরীরী নয় ! শশীভূষণ এবার সেই ছায়াকে লক্ষ্য করে এগিয়ে চললেন। বন্ধুরা একটু থমকে থেকে তারপর বিনা
বাক্যব্যয়ে হাঁটতে লাগলেন শশীভূষণের পেছনে পেছনে। তিন বন্ধুই একেবারে নীরব।
হঠাৎ
প্রবেশ দ্বারের পাশ থেকে গার্ড ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলো--কে ? কে ওখানে ? আর সঙ্গে
সঙ্গে আরও দুজন গার্ড হবে বিল্ডিংয়ের ভেতর থেকে প্রবেশদ্বার দিয়ে বাইরে বেরিয়ে
এলো।
--আমরা--শশীভূষণ চাপা গলায় বলে উঠলেন।
--তোমরা কারা ? এত রাতে ! একজন
গার্ড ভীত জড়ানো স্বরে বলে উঠলো।
ইতিমধ্যে
তিন বন্ধু গার্ডদের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
--কোথা থেকে আসছেন--কে আপনারা? গার্ডের মধ্যে থেকে একজন প্রশ্ন করল।
--বলছি, এবার
শান্তস্বরে নিজেদের আগমনের কথা শশী বাবু গার্ডদের সামনে খুলে বললেন।
জনান্তিক
প্রশ্ন করলেন, আপনারা
এখানকার--
--নাইট গার্ড, একজন
গার্ড বলে উঠল।
অন্য একজন
গার্ড শশীবাবুদের দিকে তাকিয়ে অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে বলল, আপনাদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র নেই
তো ?
--না, সার্চ করে
দেখতে পারেন, অর্ণব এবার
বলে উঠলেন।
এবার নাইট
গার্ডরা যেন কিছুটা আশ্বস্ত হল।
শশী বললেন, আচ্ছা বলুন তো হেস্টিং সাহেবের
আত্মাকে নাকি মাঝে মাঝে এই হাউজে দেখতে পাওয়া যায়--কথাটা কি সত্যি ?
গার্ডরা
পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে নিলো। তারপর তাদের মধ্যে থেকে একজন বলল, না আমরা দেখিনি, তবে রাতে একবার তার পায়ে চলার আওয়াজ শুনেছি !
জনান্তিক
বলে উঠলেন, সে আওয়াজ
তো বিল্ডিংয়ের বাসিন্দাদের কারও হতে পারে ?
একজন
গার্ড বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, না--সে আওয়াজ একদম অন্য রকমের ছিল--
আর এক
গার্ড বলল, সে ছিল গা
ছমছম করা আওয়াজ--
শশী বললেন, আপনারা গিয়ে দেখেন নি কখনও ?
--হ্যাঁ গিয়েছি বটে কিন্তু কিছু দেখতে পাইনি, শুধু আওয়াজ শুনেছি--
কথার
মাঝখান থেকে এক গার্ড বলে উঠলো, তোরা দেখিস নি, কিন্তু আমি দেখেছি ! আমি বড়
একটা পায়ের ছাপ দেখেছি--
আশপাশে
আবার স্তব্ধতা নেমে এলো। খানিক স্তব্ধতার মধ্যে থেকে জনান্তিকের গলা শোনা গেলো, আপনারা আর কিছু দেখেননি ?
--না, তবে উপরের
দিদিমণিরা একদিন চীৎকার দিয়ে উঠেছিল, তারা নাকি কেউ কেউ হেস্টিং সাহেবের সাদা ছায়াকে দেখতে পেয়েছে, এক গার্ড বলে উঠল।
আর এক জন
গার্ড বলে উঠলো, এক
ম্যাডাম বলেছে, হেস্টিং
সাহেব নাকি প্রায়ই আসেন, ঘরের আসবাবপত্র, ফাইলপত্র খুঁজে
বেড়ান।
শশীভূষণ
এবার বলে উঠলেন, আর ওই
বাইরে,
সামনের ময়দানে--ওখানের ভূত-ভৌতিক ব্যাপার কিছু আছে কি ?
গার্ডের
মধ্যে একজন বলে উঠলো, আমরা এক বছরে কিছুই দেখতে পাইনি, তবে শুনেছি আগের গার্ডরা নাকি দেখেছে--
--কি ? শশীভূষণের
মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে এলো।
--ঘোড়ার গাড়ি চলার শব্দ--ঘোড়ার
খুরের খটখট শব্দ। যেন এক সঙ্গে তিন চারটে ঘোড়া গাড়ি টেনে ছুটে যাচ্ছে! ওরা নাকি একদিন রাতে চারটে সাদা ঘোড়াকে গাড়ি টেনে নিয়ে যেতেও দেখেছে। আর সেই গাড়িতে নাকি বসে ছিল এক জন ইংরেজ সাহেব ! তারপর
দেখতে দেখতে সে ঘোড়া ও গাড়ি সবকিছু কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়েছিল !
--আমরা আজ ভৌতিক কিছুই কি দেখতে পাবো না?
শশীভূষণ ব্যগ্র স্বরে বলে উঠলেন।
--আপনারা একবার বিল্ডিংয়ের লনগুলি আমাদের সঙ্গে ঘুরে যেতে পারেন! কোন ঘরের মধ্যে ঢোকা তো এত রাতে সম্ভব না. এক গার্ড বলল।
তাই হল।
শশীভূষণ, অর্ণব ও
জনান্তিক তিন গার্ডের সঙ্গে বিল্ডিংয়ের লন ধরে ঘুরে বেড়ালেন। নিচের ও ওপর তলার
সবকটা লন ওরা নিরীক্ষণ করলেন। না কিছুরই
আভাস ওরা টের পেলেন না। বিল্ডিং থেকে বেরোবার পথে একটা ঘর শশীবাবুর চোখে পড়লো, মস্ত একটা তালা ঝুলছে তার দরজায়।
তার কাছে এসে হঠাৎ দরজায় কান পাতলেন তিনি। কিছু শব্দ হচ্ছে না ? হ্যাঁ ভেতরের শব্দ টের পাওয়া
যাচ্ছিল। শব্দটা ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগল, সে শব্দ উপস্থিত সবার কানে এসে পৌঁছল।
কেউ আছে
কি এই ঘরের মধ্যে ? জনান্তিক ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন।
বিস্মিত
গলায় একজন গার্ড বলে উঠল, না !
বহুদিন খালি পড়ে আছে ! ওর মধ্যে
পুরনো ফাইল-পত্র, সাবেকি কিছু আসবাবপত্রর স্টক রাখা আছে শুনেছি।
শশীভূষণ
ঘোর ঘোর গলার স্বর নিয়ে বলে উঠলেন, ঘরটা খোলা যাবে কি একবার ?
--না, স্যার এ ঘরের
চাবির ব্যাপারে আমরা কিছুই জানিনা, গার্ড বলল।
হতাশ হলেন
শশী বাবু। আর কান পাততে হচ্ছে না--ঘর থেকে বেশ জোরে জোরে আওয়াজ ভেসে আসছে। কেউ যেন ফাইল-পত্র
ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে ! এক সময় কাঠের বাক্স টানার ঘষ-ঘষ আওয়াজ হল--
জনান্তিকের
গলা থেকে আওয়াজ বেরিয়ে এলো, কে ? কে ভেতরে ? ব্যাস,
আর কোন শব্দ নেই, এক নিস্তব্ধতা আবার বিল্ডিংকে যেন ঘিরে ধরল।
সবাই বিল্ডিং থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। না, আজ বিনা দর্শনেই ঘরে ফিরে যেতে
হবে, এমনি
চিন্তা করে শশীভূষণরা গার্ডদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেশ কিছুটা দূরে রাখা তাদের
নিজেদের কারের দিকে হাঁটতে লাগলেন।
রাতের
ছায়াও কখনও ধূসর হয়ে ওঠে। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার কোনও মাঝামাঝি রাত্রি হবে। সামনের বিস্তৃত খোলা ময়দান যেন খা খা করছে ! ঠিক এমনি একটা অবস্থাতেই বুঝি পৃথিবীতে অলৌকিকতা নেমে আসে ! কিছুটা
দূরে ওঁদের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাইরের রঙের সঙ্গে মিলেমিশে গাড়িটা কেমন ভারী
কুয়াশা আকৃতি ধারণ করে আছে। অর্ণব হঠাৎ আঙুল দেখিয়ে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ওই ওই--বাকি শব্দ আর ওর মুখ থেকে যেন বের হতে পারছি না।
শশী ও
জনান্তিক অর্ণবের দেখানো আঙুলের দিশা মত তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলেন, মাঠের ঠিক মাঝখানটায় একটা ছেলে
দাঁড়িয়ে আছে, ও যেন
ম্লান চাঁদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে চাঁদকে ডেকে চলেছে ! নিঃশব্দতার মাঝে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্ত কয়েক পরে মনে
হল ছেলেটার ঈষৎ সাদা ছায়া আদল কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
তিন
বন্ধুর মুখ থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। অর্ণব শশীকে জড়িয়ে ধরে আছেন। ওঁর
শরীরের কাঁপন শশীভূষণ স্পষ্ট টের পাচ্ছিলেন। আর অন্য দিকে ছেলেটার শরীর তেমনি ভাবে
কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ কোথাও যেন মিলিয়ে গেল !