রসগোল্লা
আমার
অভাবের সংসার। ছোট ছোট তিন ছেলে মেয়ের মুখে অন্ন জোগানোই দুষ্কর। ওদের বাবা
কারখানায় কাজ করে ।সকালে পান্তা খেয়ে কাজে যায় সেই রাতে ফেরে। ছেলেমেয়েগুলো
সকালবেলা কোনদিন একটু টিফিন খেতে পায় না । স্কুলে যাওয়ার আগে ভাত সাথে ওর বাবাকে
করে দেয়া আলুর তরকারি দিয়ে মেখে খেয়ে যায় । স্কুলে কোনদিন টিফিন দিতে পারি না
। তবে ওরা ভীষণ লক্ষ্মী। কোনোদিন বাড়ি এসে অনুযোগ করেনা।দোষ দেয়না আমাদের
অপারগতাকে । বাড়ি এসে একটু যা হোক কিছু দিয়ে ভাত খায় । আর রাতেও সামান্য পান্তা
।তিনবেলা আধপেটা ভাতই ওদের মুখের সামনে দিতে পারি। ক্লাসের অন্য বন্ধুদের মতো ওদের
কোন শখ আহ্লাদ ই মেটাতে পারিনা । একদিন রাতে খেতে বসে ছোট ছেলে বায়না করল
-----"মা আমাদের একটু লুচি আর আলু চচ্চড়ি খাওয়াবে?"
মেয়ে সাথে সাথে বলে উঠলো ----" সাথে রসগোল্লা ?"
আমি ওর বাবার মুখের দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকায় উনি বললেন,---"
হোক না, সামনের রবিবার সকালে লুচি আর
আলু চচ্চড়ি? আমি ময়দা কিনে দেবো । আর খুকি শোন্ তোর
রসগোল্লা ও হবে।" রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনজনে পড়তে বসেছে ।মনযোগ
দিয়ে পড়ছে । কারণটা বুঝতে আমার সময় লাগেনি ।আজ লুচি হবে, এই আনন্দে ওরা আমাদের সুখী করতে চাইছে প্রাণপণে । সকাল আটটা নাগাদ ওদের
বাবা বের হয়েছে পাশের পাড়ায় ওনার অসুস্থ পিসেমশাই কে দেখতে। যাওয়ার সময় মেয়ে
বলেছে,----" বাবা রসগোল্লা.....?" ওর বাবা হাসতে হাসতে বললো,--- আনবো মা আনবো
।" নটা বাজে আমি আলু চচ্চড়ি করে লুচি ভাবছি। এমন সময় আমার খুড়তোতো দেওর
সুদেব এল হাতে এক হাড়ি রসগোল্লা নিয়ে। দেখেই তো ছেলেমেয়েদের চোখ চকচক করতে
লাগলো। ওরা কাকাকে পেয়ে তার সাথে আমোদে- আহ্লাদে মেতে উঠলো । তাতে কাকার প্রতি
যতোটা না ভালোবাসা ছিল তার থেকে বেশি ছিল তার আনা রসগোল্লায়। আমি শুধু একবার
বললাম----" কি ব্যাপার, ঠাকুরপো ?তুমি মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে ?চাকরি পেয়েছে
বুঝি?" " তা পেয়েছি । আজ মাইনে পেলাম ।তাই
মা-বাবার জন্য একটু ,আর কি?" ছেলেমেয়েরা না বুঝলেও আমি বুঝে গেলাম। সুদেবকে থালা করে গোটা দশেক
লুচি আর আলুর চচ্চড়ি দিলাম। খেতে খেতে বলল ------"বৌদি তোমার হাতের আলু
চচ্চড়ি খাসা।" আমি হাতা করে আরেকটু আলুচচ্চড়ি আর আরো দুটো লুচি দিলাম। ওর
খাওয়ার দিকে ছেলে মেয়েরা এক লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমি ইশারা করে ওদের
দাওয়া থেকে সরে যেতে বললাম। আমি ওদের কিছু কিছু সহবত শিখিয়েছি তার মধ্যে এটাও
ছিল যে কারো খাওয়ার সময় সেখানে বসে থাকবে না। কি জানি খেতে না পাওয়া দৃষ্টি
লোভীতে পরিণত করবে কিনা এই ভয়। পেট পুরে খেয়ে দেয়ে হাত ধুয়ে রসগোল্লার হাঁড়ি
টা হাতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় সুদেব বলল,---- " বৌদি
ওদের একটু ডাকুন।" ওরা এলে পকেট থেকে তিনটা কাঠি লজেন্স ওদের হাতে দিয়ে বলল ,----"ভুলে গিয়েছিলাম, চাকরি পেয়েছি তো, তাই তোদের জন্য এনেছি ।" এই বলে চলে গেলো। বাচ্চা তিনটি লজেন্স
পেয়েই খুশিতে টগবগ করছে। আমি তাকিয়ে রইলাম ওর হাতে গতিময় রসগোল্লার হাঁড়ির দিকে
এক ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে।