গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

ক্রীতদাস

কামালগাজির কাছাকাছি আসতেই সাত সকালে টায়ার পাঙ্কচার। ফটাস করে গুলি ছোঁড়ার মত আওয়াজ। 
রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার নিবারণ হতাশ গলায় জানালো স্টেপনির অবস্থাও ভালো নয়। সেই পুরনো অ্যাম্বাস্যাডার। সেই পুরনো আমলের টায়ার টিউব। এটা জানাতেও ভুললো না যে এই গাফিলতির জন্য সে নিজেই দায়ী এবং দুটো চাকা সারিয়ে গাড়ি চালু করতে কমসে কম ঘণ্টা দেড়েক। ততক্ষণ যদি সাহেবরা রাস্তার পাশের ধাবাতে বসে চা খান তবে সময়ের সদ্ব্যবহার হয়। 
নিবারণের গাফিলতির কী সাজা হতে পারে সে চিন্তা আপাতত কোন কাজে আসবে না জেনেও সমর আলতো রাগী রাগী গলায় ধরসাহেবকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, বেসরকারি কোন কোম্পানি হলে কি হত বলা যায় না, তবে এভাবেও বেশিদিন চলে না।

ধর বললেন, মিটিংয়ের কী হবে?
সমর বলল, পৌঁছে যাবো স্যার, চিন্তা করবেন না।
শালা ভণ্ডের একশেষ। কত চিন্তা মিটিংয়ের জন্য! কাল রাত দুটো পর্যন্ত কনট্রাকটরের ঘাড় ভেঙ্গে মাল খেয়েছে। তারপর শখ হলো নদীর ধারে বেড়াতে যাবে। তারপর তারস্বরে চিৎকার করে গান।
এখনও খোয়ারি ভাঙ্গে নি। ভোরবেলা প্রায় পাঁজাকোলা করে বিছানা থেকে তুলে রওনা হতে হয়েছে। গাড়ি থেকে নামালেই হয়ত হামাগুড়ি দিতে শুরু করবে।
তবু একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বলতে গেল, চলুন স্যার একটু চা খেয়ে আসি।
কিন্তু ধরের তো কোন সাড়াশব্দ নেই! গায়ে হাত দিতেই মাথাটা কাত হয়ে গেল।
মারা গেল নাকি লোকটা? সারা জীবন ধরে তার সেবা করে গেল সমর, কিন্তু লোকটি কোন প্রতিদান দিলো না। অথচ সুযোগ ছিলো। এরকমটিই হয়। প্রতিযোগিতা জিনিষটাই এমন। তোমার যোগ্যতা যতই থাকুক না কেন, কার হাতে পড়েছ সেটাই আসল কথা। কী না করেছে সে, বসের ব্যাগ ফাইল বয়েছে, ট্রেন প্লেনের টিকিট কেটেছে, এয়ারপোর্ট থেকে মাল ছাড়িয়েছে, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলেছে, ফরেন কারেন্সি জোগাড় করেছে। পিওনের কাজ করতেও দ্বিধা করেনি। 

আরও অনেক কিছুই করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু প্রোমোশন মিলেছে ওই ম্যানেজার হওয়া পর্যন্ত।
এখন মালটি দাঁত ছিরকুটে ঘাড় কাত হয়ে কেতরে পড়ে আছে। তাসের দাস হুকুমের গোলাম সমরের ভেতরে ভেতরে একটা হিংস্র উল্লাস খেলা করে। ঠিক হয়েছে শালার। বহুত জ্বালিয়েছে, চাকরের মত বহুত খাটিয়েছে আর টকাটক প্রোমোশন দিয়েছে পরমানন্দ পুরকায়স্থকে।

নিজের মনকে প্রবোধ দিতেই হয়। এছাড়াও কপালকেও দোষ দেওয়া যায়। মোটামুটিভাবে জীবন যুদ্ধের সমস্ত পরাজিত সৈনিকেরা যেভাবে নিজেদের সান্ত্বনা দিয়ে বেঁচে থাকে সমর তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। মাঝে মাঝে তাই তার চিৎকার করে বলে উঠতে ইচ্ছে করে, তোমরা যা ভাবছ, আমি তা নই। আমি জানি এবং বুঝি তোমরা আমাকে ঠকাচ্ছ। আমার অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছ। আমার সততাকে শোষণ করছ।
কিন্তু কাকে জানাবে এই আক্ষেপ?
কাকে বলবে যে, একলা রাতে বিথোভেন নবম সিম্ফনি বা চাইকভস্কির সোয়ান লেক শুনতে তার এখনও ভালো লাগে। ধরসাহেব গতকাল মালের ঘোরে তীব্র চিৎকারে বেদের মেয়ে জোছনার গান ধরেছিলেন। পরমানন্দের পছন্দ অপছন্দ জানার সুযোগ তার হয়নি।
–----
এই সাতসকালে পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকে। শীতের ভোরের সেই মিঠে ঘুম থেকে লোকজনকে ডেকে তুলে মানুষটাকে সজুত করতে একটু সময় লাগলো। এই তো ঠিক ছিল, হঠাৎ কী যে হল!
ততক্ষণে নিবারণ ফিরে এসেছে। চাকা লাগিয়ে গাড়িও রেডি হয়ে গেল। কোথা থেকে এক ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনা হয়েছে। তিনিও স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে দেখছেন। তেমন কিছুই হয়নি। তবে বয়েস হচ্ছে। অত্যাচার অনিয়মটা কম হওয়া দরকার। সমর বাধ্য গলায় যতক্ষণ কিছু উপদেশ আওড়ালো ততক্ষণে সূর্যের তাত গা পুড়িয়ে দিচ্ছে।
তখন তিনি প্রবাল প্রতাপ মানুষ নিতান্ত অসহায়, সমরের কাঁধে ভর দিয়ে গাড়িতে বসলেন। সকালের রোদ্দুর জোরালো হচ্ছে। তিনি দরদর করে ঘামছেন। সমর পাশে গিয়ে বসতেই ড্রাইভার কলকাতার দিকে গাড়ি ছোটাল। 

মানুষের মন কখনও কখনও এমন তরল হয়। তিন পাত্তির ক্রীতদাস সমর অত্যন্ত আলগোছে তাকাল প্রভুর দিকে। ঘাড়টা সিটের ওপর হেলে গেছে। হা করা মুখে অন্তত গোটা তিনেক দাঁতের অনস্তিত্ব চোখে পড়ছে। সারা গালে একদিনের বাসি দাড়ি সাদ সাদা গুঁড়োর মত ছড়িয়ে আছে। মাথার চুল অনেকটাই পাতলা, কলপ হাল্কা হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এক যুদ্ধ বিধ্বস্ত সৈনিকের মত দেখতে লাগছে।
একাই থাকেন। উপনগরীর আবাসনে তখন শেষ সকালের ব্যস্ততা। ছাত্র, অফিসবাবু, আর গৃহিণীদের চোখের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা উপেক্ষা করে বসার ঘরের ডিভানটায় ধরসাহেবকে আধশোয়া করে পিঠের তলায় বালিশ গুজে দিল সমর। কাজের লোকটিকে ওষুধ ইত্যাদি বুঝিয়ে দিতে হবে। হয়ত অন্য কোন ডাক্তারের চেম্বারে বা নার্সিংহোমেও যেতে চাইতে পারেন সাহেব। তাঁর স্ত্রী আর ছেলেকেও খবর দিতে হবে। অবশ্য পরমানন্দ ইতিমধ্যেই হাজির। সমরের আর চিন্তার কিছু নেই। বাকীটা সেই সামলাবে।
পরমানন্দ ভেতরে ঢুকেছে। সে বেরোলেই সাহেবের অনুমতি নিয়ে সমর বাড়িমুখো হবে। কিন্তু একটা সিগারেট শেষ না হতেই পরমানন্দ গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল। 

তখন নিবারণ বেরিয়ে এসে বললো, চলুন স্যার, আপনাকেই আবার আসতে হবে। সাহেব বলেছেন, আপনি একবার বাড়ি হয়ে এখানেই চলে আসবেন। অন্য কারও থাকার কোন দরকার নেই। 
সমর কিন্তু রাগতে গিয়েও রাগতে পারলো না।
মহানগরীর রাজপথে গাড়িটা আবার ছুটতে লাগলো।