গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭

পার্থ রায়

যাবজ্জীবন 


হাতে ধরা মোবাইলটা আবার বেজে উঠলো রুমনার।অপেক্ষা করে করে অস্থির হয়ে উঠেছে নিলয়। স্বাভাবিক, রুমনা পৌঁছয়নি ষ্টেশনে, ধরছেও না ফোনটা।আসলে, রুমনার মাথাটা জট পাকিয়ে আছে।বাড়ী থেকে বের হবার সময় যে দৃঢ়তা নিয়ে বের হয়েছিল, যত হাঁটছে ততই যেন ওর দুটো পা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে।দুটো স্বত্বার অনবরত লড়াই চলছে। মনের একটা স্বত্বা অনবরত একঘেয়ে ভাবে বলে চলেছে,“রুমনা,কিসের দ্বিধা?কিসের দ্বন্দ?।মুক্তি পাওয়ার এই সুযোগ কেউ ছাড়ে? নিলয় তোকে ভালবাসে, বিয়ে করবে, সুখে রাখবে। এখনো জীবনের অনেক বসন্ত বাকি”। আবার আর একটা কেউ যেন মনের ভেতর থেকে খুব নরম কিন্তু বড্ড দাগ কেটে বলছে, “রুমনা, কোথায় চলেছিস?১৬ বছরের দাম্পত্য পায়ে ঠেলে, পঙ্গু স্বামী কে অসহায় অবস্থায় ফেলে সুখের খোঁজে?যদি তোদের সন্তান থাকত? পারতিস? যদি আজ তোর নিজের এই অবস্থা হতো যেমন দুর্ঘটনায় নির্ঝরের হয়েছে?তোদের সন্তান হয়নি, সে তো প্রথমবার তুই চাকুরী করবি বলে গর্ভপাত করিয়ে নিলি, নির্ঝর কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল। তোর ইচ্ছেতেই সায় দিয়েছিল। পরের বার তোর মিস ক্যারেজ হোল- তারপরে তো ওর এই দুর্ঘটনা”।
ইঞ্জিনিয়ার নির্ঝর একটা কন্সট্রাকশন সাইটে ক্রেন থেকে পড়ে যায় অনেকটা নীচে, বাঁচার কথা ছিলনা। মাথায় সেফটি ক্যাপ পড়া ছিল বলে প্রাণে বেঁচে যায় কিন্তু কোমরের নীচ থেকে অসাড় হয়ে যায়।হুইল চেয়ারে যাবজ্জীবন বন্দী হয়ে পড়ে নির্ঝর।নির্ঝর যে নারসিং হোমে ভর্তি হয়েছিল, সেখানেই নিলয়ের সাথে দেখা এত বছর পরে। স্কুলে রুমনার সহপাঠী ছিল। পরে নিলয় ডাক্তারি পড়তে চলে যায় মেডিক্যাল কলেজে। যোগাযোগটা আর ছিলনা। নির্ঝরের নিউরলজির ব্যাপারটা নিলয়ই দেখত।
নির্ঝরের পঙ্গু হয়ে যাবার পরে রুমকির জীবনে যেন সীতার অগ্নি পরীক্ষা।স্কুলের চাকুরীটা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে সব ভুলে নিজেকে নির্ঝরের সেবায় সঁপে দিয়েছিল। সদ্যোজাতকে মা যেমন সব করে দেয়, করিয়ে দেয় ঠিক তেমনি করে নির্ঝরের সব কিছু ওকে করে দিতে হয়। প্রথম দিকে সবই ঠিক ছিল, কিন্তু যত দিন যেতে লাগল নির্ঝর যেন কেমন পালটে যেতে লাগল।খিটখিট করত, কথায় কথায় খুঁত ধরত, সব সময় যেন রুমকিকে ব্যতিব্যাস্ত করে রাখার একটা আপ্রাণ প্রচেষ্টা।মাঝে মাঝে অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁছে যেতো। আজকাল নির্ঝর গায়েও হাত তুলছিল। রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারত না রুমনা, জেগে জেগে উঠত আতঙ্কে, এই বুঝি নির্ঝরের  বেড প্যান দরকার পড়ল, এই বুঝি ও জল খেতে চাইল।দুপুরে ও ঘুমলে, কিছুটা সময় রুমনা একা নিজের মত করে পেত। আনমনা হয়ে সেসব আদর, সোহাগের সোনা ঝরা দিনগুলোর কথা ভাবত, আর চোখে জল নিয়ে হাসত।কি প্রানবন্ত আর দামাল ছিল নির্ঝরটা।বড় আদর ভালবাসায় ভরা রঙ্গিন ছিল সেসব দিনগুলো।    
 নিলয় নারসিং হোম থেকে ফেরার পথে প্রতিদিন দেখে যেত।কিভাবে কখন যেন ওরা দুজনে খুব কাছাকাছি এসে পড়েছিল। নির্ঝরের অবুঝপনা আর অত্যাচার যত বাড়ছিল, ততই দুজনের মধ্যে চিড়টা ক্রমে ক্রমে বড় একটা ফাটলের আকার নিয়েছে আর সেই ফাটলে কিভাবে জানি একটা মুক্তির স্বপ্ন বাসা বেঁধেছে। সে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল নিলয়।
আবার ফোনটা বাজছে। নাহ!সব ভাবনার শেষ। আর ভাববে না রুমনা। এখন নির্ঝরের ওষুধ খাওয়ার সময়, চা খেতেও চাইবে নিশ্চয়, ঘুম থেকে উঠে। পাগলের মতো বাড়ীর দিকে দৌড়ুতে লাগলো রুমনা।