সেই
কোন ছোটবেলা থেকে এরকমটা হয়ে আসছে । ঘুমিয়ে পড়লেই যত রাজ্যের স্বপ্ন এসে আমার সামনে
ভিড় করে । এমন একটা রাত যায় না, যেদিন আমি স্বপ্ন
না দেখি । অদ্ভুত অদ্ভুত কিম্ভুত কিমাকার সব স্বপ্ন । এক একটা স্বপ্নে আমিতো ভয়ে আতঙ্কে
পাগলের মত হয়ে যাই । কিন্তু রেহাই নেই, স্বপ্নেরা সব আসবেই
এবং এটা আমার জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে । এমনি একটা বীভৎস স্বপ্নের কথা বলতে চাই।
মারাত্মক ঘটনা,এবং ঘটেছিল আমার ঘুমের মধ্যে ঐ স্বপ্নেই । এটাকে
দুঃস্বপ্ন বলবো না অন্য কিছু, ভেবে পাই না । তবে এটুকু বলতে
পারি, ঐ ভয়ংকর স্বপ্নের কথা ভাবলেও এখনও কেমন যেন সারা শরীরটা
শিরশির করে ওঠে -- ভয়ে আতঙ্কে সিটিয়ে যাই । কদিন ধরেই প্রচণ্ড
জ্বর, সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম ।
জ্বর ও ব্যথার কাতরানির মধ্যে মাথায় মায়ের হাতের কোমল স্পর্শে কখন এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
। আর তার পরেই সেই বীভৎস, ভয়ঙ্কর স্বপ্নটা । সবার যা হয়,
স্বপ্ন দেখার সময় মনে হয় সমস্ত ঘটনা বাস্তবে ঘটছে । তাই স্বপ্নে যা
যা ঘটে, সবই সত্য মনে হয় । আমার বেলাতেও তাই হয়েছিল । এখনও
আমি চোখের সামনে সমস্ত ঘটনাটা দেখতে পাই । একা থাকতে পারি না --- মূর্তিমান বিভীষিকা যেন আমায় তাড়া করে ফেরে ।
স্বপ্নটা
এইরকম --- দেখলাম অনেকগুলো লোক মাঝরাতে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে
" বল হরি হরিবোল " চিৎকার করতে
করতে দড়ির খাটিয়ায় একটা মৃতদেহ কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে শ্মশানে । ঐ চিৎকারে ধড়মড়িয়ে
উঠতে গিয়ে মাথাটা কেমন যেন বনবনিয়ে ঘুরতে লাগলো । যাই হক, কোন রকমে নিজেকে সামলে নিলাম । লোকগুলো প্রবল উৎসাহে নেচে নেচে '
বল হরি হরিবোল ' আর ' রাম নাম সত্য হ্যায় ' বলতে বলতে একটু এগিয়ে পথের
ধারে বুড়ো শিব মন্দিরের সামনে মৃতদেহের খাটিয়াটা নামালো । বোধ হয় শিব ঠাকুরের কাছ থেকে
লোকটার জন্য শেষ আশীর্বাদটুকু পাইয়ে দেওয়ার জন্যই । আমি সামনে এগিয়ে গেলাম । মুখটুকু
বাদ দিয়ে মৃতের পুরো দেহটা সাদা চাদরে ঢাকা । গ্রামের সবাইকেই চিনি, তাই ঐ লোকগুলোকে কোন প্রশ্ন না করে এগিয়ে গেলাম কে মারা গেছে স্বচক্ষে দেখার
জন্য এবং মৃতের উদ্দেশে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর ইচ্ছায় ।
কিন্তু সামনে গিয়েই যা দেখলাম তাতে
আমার সারা শরীরের রক্ত হিম হয়ে যাবার জোগাড় । মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যেতে
থাকলো । থরথর করে কাঁপতে লাগলো আমার পা দুটো । মনে হল শরীরটা অবশ ঠাণ্ডা হয়ে জমে যাচ্ছে
। চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে । এ কী দেখছি আমি ? কে ঐ মৃত লোকটা,
কার মৃতদেহ ওটা ? আমি কি ভুল দেখছি ?
আমি বিহ্বল আর অবাক বিস্ময়ে দেখছি সামনের খাটিয়ায় আমারই মৃতদেহ শোয়ানো
আছে --- আমিই শুয়ে আছি মৃতদেহ হয়ে । এটা কি করে সম্ভব
? আমি তো জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে আছি । তবে ঐ লোকটা কি করে আমি হল বা আমি
কি করে ঐ লোকটা হলাম ? আর তা ছাড়া আমার তো কোন যমজ ভাই নেই
। অথচ ও আর আমি হুবহু একই লোক । ' আমি ও ', ' ও আমি ' ভাবতে ভাবতে মাথাটা আমার ঝিমঝিম টলমল করে
উঠলো । মনে হল মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছি । পড়েই যাচ্ছিলাম সত্যি সত্যি, হঠাৎ কে যেন আমাকে পিছন থেকে জাপটে ধরলো --- " কি হল ঘণ্টা দা, এমন করছো কেন, কি হল তোমার ?" এই বলে ও আমাকে গাছতলায় শুইয়ে
দিল । পাশ থেকে আর একজন কে টিপ্পনী কাটল , " শালার কলজের
জোর নেই তো ভড়ং করে মড়া দেখতে আসা কেন ? দে মাকড়াটাকে তুলে
দে খাটে, এক সাথেই পার করে দিই "।
এই
রকম ডায়ালগ বাজির মধ্যেই আমি আস্তে আস্তে জ্ঞান হারালাম
--- কিন্তু অবচেতনে মানসচক্ষে সব কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ।
মৃত ভেবে নিয়ে ওরা সবাই মিলে আমাকেও ঐ একই খাটিয়ায় তুলে দিয়ে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে
বেঁধে ফেললো । কিন্তু এ কী অবাক কাণ্ড রে বাবা ? একটু আগে
যে লোকটা এই খাটিয়ায় শুয়েছিল, সে গেল কোথায় ? যেন কর্পূরের মত উবে গেল । আর আমি তো বেঁচে আছি, আমাকে এরা কাঁধে চাপিয়ে হরিবোল বলতে বলতে নিয়ে যাচ্ছে কেন ? আমি একবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে চাইলাম, " আমি বেঁচে আছি ", কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ
বেরোল না, শুধু ফসফস করে কিছুটা হাওয়া বেরিয়ে গেল । হাত,
পা, সারা শরীরে বজ্র আঁটুনি, নড়াচড়ারও উপায় নাই । পালানোর কথা তো ভাবাই যায় না । নেহাৎ নিরুপায় অসহায়ের
মত চুপচাপ পড়ে থাকলাম । ভাবলাম, যা হবার হক --- কী আর করতে পারি আমি । জন্মেছি যখন, মরতে তো হবেই
একদিন । বেশী ভেবে কি লাভ ? তাছাড়া এই বেহেড মাতালগুলোর হাত
থেকে তো নিস্তার নাই কোনমতেই । কিন্তু তবুও আমার দুচোখ দিয়ে ভরা শ্রাবনের ধারা বইতে
লাগলো । এমন বেঘোরে জীবনটা যাবে ? আমি ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম
না এটা কি রকম উদ্ভট ব্যাপার ? একটু আগে যে এই খাটিয়ায় বিরাজমান
ছিল, সে উধাও । সে আর আমি দুজনই এক, কোন তফাৎ নেই
। ওরা নেচে নেচে সুর করে হরিবোল গাইতে গাইতে শ্মশানের বুড়ো বটগাছ
তলায় আমার খাটিয়াটাকে নামিয়ে দিয়েই যে যার বোতলের ছিপি খুলে বসে গেল গোল হয়ে একটু দূরে
গাছতলায় । আমি হাত পা বাঁধা অসহায়ের মত পড়ে রইলাম একধারে একলা, একটু পরে নিজের অন্ত্যেষ্টির স্বাক্ষী হয়ে থাকার জন্য । আমার দিকে কেউ ফিরেও
তাকাচ্ছিল না । আমি ভাবছিলাম আমার শেষ পরিণতিটা এই ছিল ! নানা
ভাবনা আমার মাথায় ভিড় করে আসছিল । হঠাৎ দেখি সেই উধাও হয়ে যাওয়া লোকটা আমার সামনে এসে
দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে ----
-কি ঘণ্টা দা, কেমন লাগছে?
- আমি ঘণ্টা
হলে তুমি কে? ' আমি তুমি, তুমি আমি
তো মিলে মিশে একাকার --কি করে হয় ?
- হ্যাঁ
হয়, ঘণ্টা দা, হয় । এ রকমটাই হবার
ছিল । বিদায় বন্ধু, বিদায় -- তোমার
স্বর্গের পথ সুগম
হ'ক, হ্যাপি জার্নি
।
- কি বলছো
তুমি ?
-তা নয়তো
? আমি মরে মরা, তুমি না মরেও মরা
। ওপারে তোমার সাথে দেখা হবে।
- আচ্ছা,
তুমি আমায় মুক্তি দিতে পারো না?
- মুক্তি
কোথায় হে দাদা? মুক্তি নাই । সব শালার তোমার আমার মতই বেঘোরে
প্রাণ যাবে ।
কথোপকথন
শেষ হয় না । তার মধ্যেই মুর্দাফরাস মাতালগুলো হৈহৈ রই রই করতে করতে এসে আমার দড়িদড়া
খুলে আমাকে চ্যাংদোলা করে চিতায় তুলে ফেলে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল । আমি হাউমাউ
করে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলাম ----- বাঁচাও, বাঁচাও, আমাকে
বাঁচাও ।
আর ঠিক তখনই সেই মুহূর্তে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে
গেল । শুনতে পেলাম মা চিৎকার করে বলছেন, " খোকা, ওরকম করছিস কেন, কী হল তোর ? " এই বলে মা আমার চোখে মুখে জলের
ঝাপটা দিতে সম্বিত ফিরে পেলাম । মনে হল যমলোক থেকে ফিরে যেন নবজীবন প্রাপ্তি হল আমার
।