গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭

মৌসুমী ঘোষ দাস

 কে ?
               

বাসটা যখন খয়েরতলা মোড়ে এসে দাঁড়ালো তখন রাত সাড়েনয়টা বাজে। আরও আগেই এসে পৌঁছনোর কথা, কিন্তু রাস্তায় একটা এক্সিডেন্টের জন্য বাসটা আড়াই  ঘণ্টার বেশি জ্যামে আটকে ছিল। তাই দেরি হল। খয়ের তলা মোড় থেকে গ্রামের ভেতর দিকে আমার বাড়ি এক কিলোমিটারের একটু বেশি। এমনিতে তেমন কোন ভয়ের ব্যাপার নেই এই রাস্তায়। কখনো কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নি।  খেলাধুলা করার জন্য আমি একাই চলাফেরা করি। তাছাড়া অন্যদিন ডি,এস,এর মাঠে প্র্যাকটিস সেরে ফিরতে এতো রাতও হয় না।বাস থেকে নেমে হারু কাকুর দোকানে সাইকেল রাখা থাকে, সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরি। কিন্তু হারুকাকুর দোকান দুদিন বন্ধ থাকবে আগেই বলে দিয়েছিল। কুচবিহার যাবে কোন এক আত্মীয়ের বাড়ি। আমাদের মালদা জেলা মহিলা কাবাডি দল রাজ্যস্তরে দ্বিতীয় হয়েছে। এই দলের হয়ে খেলতে পরশু নদীয়া গিয়েছিলাম। আজ বিকেলে ফিরেছি। মালদা ষ্টেশনথেকে গাড়ি করে সোজা ডি,এস,এ-র মাঠে নিয়ে আমাদের দলকে ফুলের তোরা আর মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে সম্বর্ধনা দিল। তারপর যে যার বাড়ি নিজ দায়িত্বে ফেরা। বেশির ভাগেরই শহরে বাড়ি। শুধু মুক্তাদি ওল্ড মালদার আর আমি এনায়েতপুরের। সবার বাড়ি থেকেই কেউ না কেউ এসেছে নিয়ে যেতে, একমাত্র আমার বাড়ি ছাড়া। কারণ, আমার বাড়িতে শুধু মা আছে।
কোনোদিন এতো রাত না হলেও, এপথে বহুবার একা যাতায়াত করেছি। গেম স্যারের কাছে আত্মরক্ষার জন্য ক্যারাটে শিখেছি। ভয় আমি পাই না। তবে ভুতের ভয় একটু আছে। কারণ,  গ্রামে ঢোকার মুখেই ওই বড় পুকুরটা। আমাদের গ্রামে বিজলি বাতি আছে, তবে বহুদূরে দূরে টিমটিম করে জ্বলে। শহরের মতো অত ঝকঝকে আলো নেই। আর প্রায়ই লোডশেডিং হয়। একবার লাইন গেলে কয়েক ঘণ্টার আগে আসে না। সেজন্যই একটু ভয় করছে।
তাড়াতাড়ি হেঁটে ঢালাই রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তা ধরলাম। দুপাশে আমবাগানের বড় বড় গাছের ছায়ার জন্য রাস্তাটা কি অন্ধকার লাগছে। আকাশের ফালি চাঁদ কখনো কখনো মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে। রাস্তায়  দুই একটা লোক চলাফেরা করছে। আসলে আমাদের গ্রামের লোকেরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তারপর সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যে হতেই যে যার বাড়ি ঢুকে যায়। খেয়েদেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়ে। শহরের মতো এখানকার লোকেরা অনেক রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকে না।
আমার পিঠে বড় ব্যাগ, হাতে পলিপ্যাকে মিষ্টির প্যাকেট, ফুলের তোরা। স্যারের ডায়েট চার্ট অনুযায়ী  আমার মিষ্টি খাওয়া বারণ তাই মার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। মা আমার জন্য খুব চিন্তা করছে জানি। আমি ছাড়া মার আর কেই বাআছে?  বাড়িতে মোবাইল নেই যে আমার দেরীর কথা মাকে জানাবো। শুধু কথা বলার জন্য গেম-স্যার একটা মোবাইল আমাকে দিয়েছেন। সেটারও চার্জ শেষ। অবশ্য একটা ফোন করে নিলুদাকে আমার আসার কথা জানানোই যেতো। আর জানালেই আমাকে নিতে খয়ের তলা মোড়ে আসতোই আসতো সে আমি জানি। কিন্তু পাড়া গাঁয়ে এই ব্যাপারটা ভালোভাবে নেবে না। একে তো আমরা নমশূদ্র, তাতে আবার বাবা মারা যাবার পর সংসার চালাতে মা বিড়ি শ্রমিক হয়েছে।
নিলুদারা ব্রাহ্মণ, ধনী। নিলুদা আমার থেকে মাত্র দুই বছরের বড়।  ছোট থেকেই এক পাড়াতে একসাথে বড় হয়েছি। জঙ্গলে ফড়িংধরা, খেলাধুলা,পড়াশুনো,  ঘুড়ি ওড়ানো, সাইকেল চালানো সব একসাথে। আজকাল আমার ওপর তারখবরদারিএকটু বেড়েছে। কেবল বলে, “তুই এখন বড় হয়েছিস সুপ্রিয়া, কোথাও কেউ তোকে কোনোরকম হেনস্থা করলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে বলবি। আমি দেখে নেবো”। মনে মনে হাসি পায়। সেই কোন ছোটবেলায় বর-বউ খেলার সময় আমি তার বউ হতাম। এখনো যেন তিনি আমার-
আমরা ছোট জাত, মা বিড়ি বাধে  বলে ওর বাবা আমাদের পছন্দ করে না। আমিও চাই না, বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে।তাই একটু এড়িয়েই চলি আজকাল। গরীব হলেও লোকের কুকথা শুনতে নারাজ। কিন্তু নিলুদাকে বোঝাবে কে? আমি ভালো খেলি, তাই স্যার বলেছেন একটা পাশ করলেই খেলার কোটায় আমার চাকরি হয়ে যাবে। তখন মাকে নিয়ে শহরে থাকবো। মাকে কোন কাজ করতে দেবো না।
হাঁটতে হাঁটতে বটতলা পেরিয়ে বড় পুকুর পাড়ের কাছে চলে এসেছি। এই পুকুরে এক বছর  আগে নায়েকদের বাড়ির মেজো বউ ডুবে মরেছিল। কেউ কেউ তো বলে নায়েকরাই নাকি খুন করে দেহ পুকুরে ডুবিয়ে দিয়েছিল। দুদিন পর যখন তাঁকে জল থেকে তুলেছিল, বীভৎস ভাবে ফুলে গেছিল। চোখদুটো গর্ত মতো, বড় মাছে নাকি চোখ খুবলে খেয়ে ফেলেছিল।তারপর থেকে অনেকেই সন্ধ্যের পর তাঁকে দেখেছে ওই পুকুর থেকে উঠে এসে দাঁড়াতে। যে ওই পুকুরপাড় দিয়ে যায় তার নাম ধরে নাকি ডাকে। যদিও আমি কোনোদিন দেখিনি। আর এতো রাতও যে কোনদিন হয় নি। পুকুরটার চারদিকে এতো বাগান, কেমন যেন ছায়াছায়া ভুতুরে পরিবেশ। আলো নেই এখানে। সেজন্যই হয়তো মানুষ এতো ভয় পায়।
আজ এতো রাতে পুকুরটার কাছে আসতেইগায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। দূরেকোথায় একটা কুকুর টেনে টেনে কাঁদছে।  মা বলে কুকুর, বেড়ালের কান্না নাকি অশুভ। কোনদিকে না তাকিয়ে আমি হনহন করে হাঁটতে লাগলাম। একটু এগোলেই বুড়ো নিমতলা। তারপর আর ভয় নেই। পাশাপাশি ঘর থেকে আলো আসবে। কিন্তু হঠাৎ অনুভব করলাম কে যেন আমায় ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। পায়ে হাঁটার শব্দ নেই অথচ দিব্যি একটা অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। এতো রাতে এই বড় পুকুর ধারে আর কে হতে পারে নায়েকবাড়ির মেজো বউ ছাড়া? পেছন ঘুরে তাকাতেও ভয় করছে। যদি ওই বীভৎস চোখ খুবলানো চেহারা দেখি। তাহলে নির্ঘাত জ্ঞান হারাবো। আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। চিৎকার করার শক্তি হারিয়েছি। কোনমতে এগিয়ে চলেছি।
খানিক বাদে শুনি ফিসফিসিয়ে কে আমার নাম ধরে ডাকছে আর একটা বরফের মতো ঠাণ্ডা বাতাস আমার গায়ে এসে লাগছে। কোন  অপশক্তি বলে পাদুটো অসাড় হয়ে গেছে। এগোতে শক্তি পাচ্ছি না। তবে কি আজ এখানেই ভয়ে মরে পড়ে থাকবো? ভোরের আগে কেউ জানতেও পারবে না। এবার ডাকটা আমার কানের কাছে স্পষ্ট শুনতে পেলাম। একেবারে যেন আমার গা ঘেঁসে হাঁটছে! আমি আর আমাতে নেই। বেশ কয়েকবার ডাকার পর মনে হল ডাকটা কি খুব চেনা চেনা লাগছে? সাহস সঞ্চয় করে তাকিয়ে দেখি নিলুদা।
-“ কি রে , কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না? কালা হয়ে গেলি নাকি?”
ধরে প্রাণ ফিরে এলো আমার। সত্যি মনের মধ্যে একবার ভয় এসে বাসা বাধলে কত কিযেবাজে অনুভূতি হয়!
- “তুমি? এতো রাতে তুমি পেছন পেছন আসবে, ভাবতেই পারি নি। আমি তো ভাবলাম-”
-“নায়েকবাড়ির মেজো বউ? তাই তো? তুইও এসব বিশ্বাস করিস? আজ তোর  ফিরতে রাত হতে পারে, তুই আবার এই পুকুর পার দিয়ে একা ফিরতে ভয় পাস।  আমি মল্লিক পাড়া গিয়েছিলাম একটা কাজে। তাই সেখান থেকে ফেরার সময় ভাবলাম তোর জন্য অপেক্ষা করি। তা তুই এমন হনহন করে হাঁটছিস যে আমাকে দেখতেই পেলি না? ”
-“ না গো,  একা ফিরছি তো তাই একটু তাড়াহুড়ো করছিলাম।জানো নিলুদা, আমরা খেলায় সেকেন্ড হয়েছি”।
_“ বাহ! এর পরের বার কিন্তু ফার্স্ট হতে হবে, আর সাথে পড়াটাও ভাল করে কর। চাকরি তোকে পেতেই হবে। আমি চাই তুই নিজের পায়ে দাঁড়া”।
কথা বলতে বলতে এগোতে লাগলাম দুজনে। বুড়ো নিমতলার কাছে এসে নিলুদা বলল,
-“এবার কোন অসুবিধা নেই, তুই একা যেতে পারবি, যা, বাড়ি যা”
-“সেকি? তুমি বাড়ি যাবে না?”
-“আমি একটু পরে যাচ্ছি। দুজনে একসাথে পাড়ায় ঢুকবো না।”
বুঝলাম, নিলুদাও অশান্তি চায় না। নিলুদা দাঁড়িয়ে থাকল। আমি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ির দিকে এগোলাম। দরজায় কড়া নাড়তেই মা দরজা খুলে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
-“এতো রাত হল সুপ্রিয়া, একা এতোটা পথ আসবি ভেবে আমি খুব চিন্তা করছিলাম। যা অন্ধকার পথঘাট, বড় পুকুরপাড়,  কখন কি হয়। তারপর যা সাপের উপদ্রব বেড়েছে। কাল তো- ”
মার চিন্তা দেখে আমি আশ্বস্ত করে বললাম,
-“না মা, নিলুদা আমাকে বড় পুকুরটা পার করে দিল।”
-“কে? কে পার করে দিল?”
-“নিলুদা গো।”
-“কি বলছিস? নিলু পার করে দিল? তুই ঠিক বলছিস?”
-“বারে, দিলই তো! আমাকে বুড়ো নিমতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। কত কথা বলল।”
মা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে খানিক আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, -“ কাল  রাতে নিলুকে সাপে কেটেছিল, হাসপাতাল নিতে নিতে রাস্তাতেই সব শেষ। আজ সকালে ওঁকে দাহ করে এসেছে।”