গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০১৭

নীহার চক্রবর্তী

রফিকের মা


রফিকের যখন দুবছর বয়স,তখন বাড়ি থেকে উধাও হয় ওর বাবা আজাদ । সে রাজমিস্ত্রির কাজ করত । 
সেইথেকে টানা তিনবছর রফিকের মা পাড়ায় আর ভিন পাড়ায় মোট চার বাবুর বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতে থাকে । ঘরে বিধবা শাশুড়িও ছিল । 
আজাদের জন্য রফিকের মা কাজ করতে করতে উদাস হয়ে পড়ে । চোখ থেকে জল ঝরতে থাকে । ভাবে,অমন ভালমানুষকে কি আল্লা তুলে নিলো ? কিন্তু তার শরীর তো কোথাও দেখা গেলো না । তবে ? আর ভাবতে পারে না রফিকের মা তারপর । রফিক আর বিধবা শাশুড়ির কথা ভেবে চোখের জল মুছে কাজ করতে থাকে কষ্টের এক চিলতে হাসি মুখে নিয়ে ।
রফিকের যখন পাঁচবছর বছর বয়স,তখন ওর মার মনে হল মাথায় ছাতার বড় অভাব । অনেক সমস্যার নিজে সমাধান করা যায় না । সেকথা ভেবে অনেকে বারণ করা সত্ত্বেও আবার বিয়ে করল । এবার হুমায়ুন । সে কাঠের মিস্ত্রী । শুরুতে সব ঠিকঠাকই ছিল । হুমায়ুন তাকে খুব ভালোবাসতো পাঁচবছরের রফিককে নিজের সন্তান বলেই ভাবতো । এমনকি আজাদের বিধবা মাকেও সে নিজের মা বলে ভাবতে থাকে ।
একটা বছর বেশ গেলো । কিন্তু তার পর থেকে রফিকের মা দেখল স্বামী হুমায়ুন নেশা করে । মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে রাতে-বিরেতে । অনেক বুঝিয়েও তার নেশা দূর করতে পারে না । কিন্তু এও বোঝে হুমায়ুন ওকে খুব ভালোবেসে । শুধু ভালোবেসে নেশা ছাড়তে পারে না সে । দিনে-দিনে নেশার মাত্রা বেড়ে গেলো হুমায়ুনের ।
একদিন রফিকের মা তাকে সরোষে বলে উঠলো,’’জাহান্নমে যাও তুমি । আর দেখছি না তোমাকে আমি । শূন্যই আমার ভালো ।'' 
তখন সন্ধ্যা । বাইরে বেশ জোরে বৃষ্টি পড়ছে । সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হুমায়ুন সেই যে বাড়ি থেকে বেরোল আর বাড়ি ফিরে এলো না ।
আবার সংগ্রাম শুরু রফিকের মার । রফিক দিনে-দিনে বেশ বড় হয়েছে । ওকে স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলেও ভর্তি করে । আজাদের মা প্রায় দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে । শত কাজের ফাঁকে তাকে সেবা করে সে চোখের জল গোপন রেখে ।
প্রায় বলে শাশুড়ি ওকে কষ্টের হাসি হেসে,’’ভেবো না । আমার আজাদ ঘরে একদিন ফিরবেই ।‘’ 
তার কথা শুনে রফিকের মা কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখের কোণ মুছে আশ্বস্ত হয় । কিন্তু অপেক্ষা তার বাড়তেই থাকে ।
সেদিন বেশ রাত । রফিকের মা রফিককে বুকে জড়িয়ে ঘরের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে ঘুমিয়ে আছে । এমন সময় শোনা গেলো বাইরে থেকে এক চেনা কণ্ঠ ।
‘’
দরজা খোলো । কিছু কথা বলতে এসেছি । বলেই চলে যাবো ।‘’
ধরফরিয়ে উঠে বসলো রফিকের মা তখন । বিলক্ষণ বুঝতে পারলো সে,এ আজাদের গলা ।
বুক-ভরা আনন্দ নিয়ে সাথে-সাথে ছুটে গেলো দরজায় । 
খুলে দিতেই আজাদ হুরমুর করে ঘরে ঢুকে তার গলার টুটি চেপে ধরে সক্রোধে বলে উঠলো,’’আমি আবার ঘরেই ফিরছিলাম । পথে শুনলাম তুই আবার বে করেছিস । এবার তোকে জনমের মতো শেষ করে দিতে চাই ।‘’ 
অসহ্য শ্বাস-কষ্টে তখন রফিকের মা গোঙাচ্ছে । কখন যে রফিক আজাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ টের পায়নি । আজাদের সিল্কের লুঙিতে রফিক কুপির আগুন ঠেসে ধরে । তারপরেই দাউদাউ করে আগুন ধরে যায় আজাদের সারা শরীরে । 
রফিক ওর মার হাত ধরে মুহূর্তে ঘরের বাইরে চলে আসে । মাকে নিয়ে ছুটতে থাকে সামনের রাস্তার দিকে । 
ওদিকে তখন আজাদের শখের ঘর পুড়ছে । পুড়ছে একসাথে বিধবা মা আর ছেলে । কিছু সময় পরে সব ভস্ম । কিন্তু পাড়ার কেউ বুঝতে পারলো না ভস্ম-পুরুষটা আসলে কে । তাদের চোখে জল এলো শুধু রফিকের বুড়ী ঠাকুমার কথা ভেবে ।
তার একবছরে পরে সেই হুমায়ুন আবার ঘর বেঁধেছে রফিকের মার সঙ্গে পাশের গ্রামে । নেশা তার গেছে । নতুন করে কাজে মেতেছে । কিন্তু রফিকের মা আজো ভুলতে পারে না,সেই ভালোমানুষটার কথা । কেন সে বাড়ি ছেড়েছিল । কেনই বা ফিরতে চেয়েছিল । ভেবে সে কূল পায় না ।
তখন রফিক মাকে জড়িয়ে ধরে নিষ্পাপ হেসে বলে,’’যা হয়েছে ঠিক হয়েছে । তোমার চেয়ে দামী মানুষ আর কেউ নেই । তাই আমি ভাবিই না । আবার কিছু হলে আমি আগের মতো আগুন ধরাবো ।‘’
রফিকের কথা শুনে হুমায়ুন আঁতকে ওঠে ।
তার দিকে তাকিয়ে রফিকের মা তখন সান্ত্বনার সুরে বলে,’’এবার মরলে আমি আর রফিক মরবো । তুমি সেই হুমায়ুন হুমায়ুনই থাকবে । হুমায়ুন কে গো ? কোথায় যেন তার নাম শুনেছিলাম ।‘’
তখন হুমায়ুন বুকে বল পেয়ে এক-গাল হেসে ওঠে । দেখে খুব রাগ হয় তখন বালক রফিকের । বুঝি সে হুমায়ুনের মধ্যে আজাদের ভূত অনুভব করে ।
তারপর আবার হারিয়েছে হুমায়ুন । রফিকের মা ভাবে একা-একা হাসতে হাসতে,সব দেখি অকারণে । আমি ব্যথা পাই কী কারণে ?
তবে তখন তার চোখে জল আসে । 
বালক রফিক মার চোখ মুছিয়ে দিতে বলে,''আমি আছি তো । আমি থাকবো । কেন কাঁদো তুমি বেকারণে ?'' 
রফিকের মা রফিককে তখন তার বুকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে কিশোরী-বেলার হাসি হাসতে হাসতে বলে ওঠে,''তুমি আজাদের রক্তের মানুষ । তাই ভাবি । আর তবে ভাবছি না । চল আনন্দ করে কাটিয়ে দিই মা-ছেলের জীবন ।'' 
তারপর দৌড়,দৌড়... দুজনের অনিন্দ্য-দৌড় ।