ভয়ানক রাত্রি
গত সেপ্টেম্বর মাসে কলেজের ছেলেদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। ইয়াং ছেলেরা
হুজুগে
মেতে স্থির করলো ওরা রাতে বেরোবে
ভেড়াঘাট
আর বর্গীড্যাম
ঘুরে আসতে। যেই ভাবা সেই কাজ। সবাই ওরা জবলপুর
সিটি এরিয়াতে
থাকে। এমনিতেই
ছেলেরা
রাতবিরাতে
ঘুরে বেড়ায়।
ওরা ঘরের মা-বাবার বাধা খুব একটা মানতে চায় না। রাত এগারটায় যখন মানিক ঘর থেকে বেরচ্ছিল তার মা একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন--এই এতো রাতে কোথায় বেরচ্ছিস, মানিক
?
মানিক বলেছিল,
এই এক ঘণ্টার
মধ্যে এসে যাবো মা !
ব্যাস, এমনি
ভাবে গার্জিয়ানদের
বলতে গেলে না জানিয়ে
মানক, শম্ভু, গজ্জু, তিলক ওরা সবাই বেরিয়ে গেলো ভেড়াঘাটের দিকে। ভেড়াঘাট জবলপুর সিটি থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটারের মত দূরে। তা প্রায় আধা ঘণ্টা তো লেগেই যাবে পৌঁছাতে। ওদের সঙ্গে আছে পাঁচটা বাইক আর ওরা সংখ্যায় দশ জন। ইয়াং ছেলেরা একত্র হলে যা হয়--হৈহল্লা চেঁচামেচি করতে করতে বেশ স্পিডে ওরা পৌঁছে গেলো ভেড়া ঘাটে। নর্মদা নদীর জলে নৌকা বিহার করা, এখানকার
বড় আমোদের
ব্যাপার।
কিন্তু
এত রাতে নৌকা কোথায় ! এত রাতে মাঝিমাল্লারা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে হবে। আর তা ছাড়া মিউনিসিপাল্টির তত্ত্বাবধানে এখানকার নৌকা চলাচলের বাঁধাধরা নিয়ম আছে। যাই হোক, যা এত রাতে সহজ লভ্য,
দশ জনের দলের ছেলেরা
তাই নিয়ে
দিশী মদ-দারু
খেয়ে কিছু সময় হৈহল্লা
করলো। তারপর ঠিক করলো এবার বর্গী ড্যাম যাওয়া যাক।
ওদের মধ্যে এক অবাঙ্গালী বন্ধু গজ্জু যেতে রাজি হচ্ছিল না। ও নাকি শুনেছে বর্গী ড্যামে রাতের বেলা যাওয়া নিষেধ। তা ছাড়া গজ্জুর শরীরও নাকি তেমন ভাল লাগছিল না। হবে মনে মনে ও ভয় পাচ্ছিল। ও বলছিল, নেহী রে, মেয় নেহী যাউঙ্গা, আমার কেমন ভয় ভয় করছে, শরীর অবশ অবশ লাগছে।
বাকি ছেলেরা
ওর পিছে পড়ে গেলো। ওরা ওকে, ছে ছে, করলো, বলল, তুই একটা--। তারপর
এক রকম জোরজার
করেই গজ্জুকে
নিয়ে ওরা রওনা হল ড্যামের
দিকে। মানিক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে
দেখল রাত তখন দুটো বাজে--কুছ পরোয়া নেহী--
রাত প্রায় আড়াইটায় ওরা সবাই মিলে বর্গী ড্যামের কাছাকাছি পৌঁছল। পথে তিলবারা ঘাট পড়ে। তিলবারা ঘাট নর্মদা নদীরই আর একটা ঘাট। গজ্জু এখানে এসে আবার ভয় পেতে লাগলো। ওর নাকি শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে ! গজ্জু বারবার বলে চলছিল ও ফিরে যাবে ও বর্গী ড্যামে যাবে না। ওদের মধ্যে এক আধজন গজ্জুর সমর্থন করছিল। কিন্তু
গরিষ্ঠ
মতে ফিরে যাওয়ার
প্রস্তাব
টিকল না। অগত্যা
ওরা আবার বাইকে স্পিড বাড়াল।
রাস্তা নিস্তব্ধ, জনপ্রাণী
শূন্য, কেবল এই দশ প্রাণীর দল অন্ধকার বন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে। হঠাৎ একটা চীৎকার শোনা গেলো, পালসার গাড়িতে ছিল গজ্জু, ওদের গাড়ি ছিল সবার মাঝখানে, গজ্জুর ভয়ের জন্যেই এ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। চীৎকার
শুনে কি হল, কি হল রব উঠলো। এখানে স্ট্রিট লাইটের বালাই নেই। অন্ধকারে বাইকের লাইটগুলি শেষ পর্যন্ত ফোকাস করলো গজ্জুকে। সে মাটিতে
গড়াগড়ি খাচ্ছিল, ভয়ে হবে, গোঙাচ্ছে !
ওকে ধরে তোলা হল বাইকে,
ও ভয়ে কাঁপছে, আর মুখে
বলে চলেছে, মেয় নেহী যাউঙ্গা, মেয় নেহী যাউঙ্গা !
প্রায় আধ ঘণ্টা সময় নিয়ে গজ্জুকে
বুঝানো হল, ঘরে তো ফিতেই হবে, আর যে দিক দিয়েই ঘরে ফের এত রাতে সব জাগাই ভয়ের। ওকে জল-দারু খায়িয়ে কোন মত বাইকে বসিয়ে আবার ওরা ড্যামের দিকে রওনা হল।
ড্যামের ব্রিজের কাছাকাছি আসতে আসতে হঠাৎ একটা কালো গাড়ি হুশ করে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। দ্রুত বেরিয়ে গেলেও তার নাম্বার ও নাম যেন আলোর ফ্ল্যাশ নিয়ে জ্বলে উঠে ছিল--ছেলেদের চোখে তা অনায়াসে ধরা পড়েছিল। কারটা আই ২০ ছিল। কিন্তু গাড়ির ব্যাপারটা কি হল ? দশজন ছেলেরা সমস্ত রাস্তা জুড়ে হেঁটে চলছিল--তা হলে গাড়িটা কি ভাবে ওদের পাশ কাটিয়ে
বেরিয়ে গেলো ? এটাই ওদের কাছে সবচে ভয়ের ব্যাপার মনে হল। ছেলেরা
সবাই আতঙ্কে
এক জাগায় জড়সড় হয়ে জটলা বেঁধে আছে।
গজ্জু একবার চাপা চীৎকার
দিয়ে ঝিম মেরে গেছে,
হয়ত ভয়ে তার গলা থেকে আর আওয়াজ বের হচ্ছে না। ছেলেরা
দেখল,
কালো গাড়িটা
সামনের ব্রিজ
পার করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে
পড়েছে।
গাড়ির মধ্যে দুটো ছায়া মূর্তি
বসে আছে, দূর থেকেও তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কারের ভিতরে মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশ লাইটের মত আলো জ্বলে উঠছিল। মনে হচ্ছিলো
যেন ওরা ক্যামেরা বা মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটে ফটো তুলছে।
ছেলেরা হতবাক, দাঁড়িয়ে
নীরবে সব কিছু দেখে যাচ্ছে। গজ্জু বেহোশ প্রায় হয়ে টালমাটাল দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ ছেলেরা দেখতে পেলো কার থেকে একটা মানুষের ছায়া নেমে এলো আর সে ছায়াশরীর ধীরে ধীরে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে ! ছায়া যত ওদের দিকে
এগিয়ে আসছিল
তার ছায়ার আকারও
ধীরে ধীরে তত বেড়ে
যাচ্ছিলো।
ছেলেরা
ভয়ার্ত
চীৎকার
করে পিছিয়ে যেতে
লাগলো। অন্যদিকে একটা ছায়া আগের মতই কারের ভেতর বসে আছে। দীর্ঘ ছায়া ছেলেদের দিকেই এগিয়ে আসছে--ছেলেরা ভয়ে চীৎকার করে পিছনে ছুটে যাবে ভাবছিল, ঠিক এমনি সময় ওদের কানে এসে বাজল কোন
ভারি গাড়ির আওয়াজ, মুহূর্ত সময় পরেই ওদের চোখে
পড়লো বিপরীত দিশা থেকে একটা
ট্রাক ওদের দিকেও এগিয়ে আসছে। ট্রাকের
হেড লাইটের
আলো ওদের চোখে এসে পড়লো। এবার ট্রাক ওদের কাছে এসে পড়লো ওদের পাস কাটিয়ে
ট্রাকটা
কালো কারের দিকেই
এগিয়ে যাচ্ছে।
ছেলেরা
দেখল সে ছায়া মূর্তি আর নেই—এ কি কোথায় গেলো সে ছায়া মূর্তি ? আর সেই কালো কার সব যেন মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল ! ওদের মনে হল ওদের এতক্ষণের দেখা দৃশ্যগুলি বুঝি মাত্র কোন যাদু-মন্ত্রের খেলা ছিল ! পড়িমরি করে ছেলেরা এবার বাইকে চড়ে বসল আর যে
রাস্তায় এসেছিল সে রাস্তাতেই ঘরে ফিরে গেল।
ছেলেরা সেদিন যা দেখেছিল তার
ব্যাখ্যা ওরা জানে না। তবে সে ঘটনার পর থেকে ওরা বন্ধুদের বলে বেড়াত, সাবধান,
বেশী রাতে কখনও বর্গী ড্যামের
দিকে যাবি না।