সুর্য্যিমামার
সোনাসোনা রোদ পুব আকাশ ভরিয়ে উঠানের আমগাছটার লাললাল নতুন পাতায় ঝিকঝিকিয়ে উঠতেই
বিছানায় ডানদিক থেকে বামদিকে কাত হয়ে শুলো আনন্দি নামের একরত্তি মেয়েটা। হাত
বাড়িয়ে দেখলো পাশে ঠাকমা নেই। মা বাপ খোয়ানো আনন্দির দুই ঠাকমা। এক ওর নিজের ঠাকমা
আরেকজন ঠাকমার সই দুগ্গিঠাকমা। বেজারমুখে কোলবালিশটাই জড়িয়ে নিলো। কোথাও একটা
অনামুখো কাক একটানা ডেকেই চলেছে। কে জানে পুবমুখো ডাকে নাকি উত্তরমুখো। ভালো নাকি
খারাপ খবর কি বয়ে আনে কে জানে। সাথে সঙ্গত রেখে অল্প বিরতি দিয়ে কখনো বড়ির পিছনের
পোড়োজমিটা থেকে পোষা মুরগির “কোক্কর কক কক- এর সাথে
মজা পানা পুকুরের পৈঠা থেকে পানুর মায়ের পোষা হাঁসের প্যকপ্যাকানি ডাকও ভেসে আসছে।
ঘোষবাড়ির দুর্গামন্ডপের ভেঙে আসা খোপড়ার চালের ওপর থেকে পায়রার বকবকম কি পালদের
উঠানের মরইয়ে ধান খুঁটে খাওয়া চড়াইয়ের চিড়িক পিড়িকেরও কোন কমতি নেই।দিন ভালো করে
শুরু হয়নি যদিও গোটা গ্রাম আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়েছে বেশ অনেকক্ষন,
টুকটাক হাতের কাজও চলছে যথানিয়মে।গতকালও ঠিক এই সময়টাতেই
দুগ্গিঠাকমা বাসি বিছানায় বাবু হয়ে বসে দুনিয়ার ঠাকুরদেবতার নাম জপ করে তুরতুরে
পায়ে দরজা খুলে হীরামতি চাঁদমোতিদের খোঁয়ার খুলে মাঠে চরতে ছেড়ে দিয়ে কবেকার সেই
রংচটা বেতের ঝাঁপি হাতে ফুল তুলতে বাইরে পা রেখেছিল। দেরি করলে রায়বাবুদের
জঙ্গলপ্রায় বারোয়ারি বাগানের জবা কল্কে নয়নতারা চাঁপা অতসি টগরদের একটিও পড়ে
থাকেনা। কেউ না কেউ ঠিক তুলে নিয়ে যায়। বয়েসের ভারে আস্তে আস্তে হাঁটে ঠাকমা ।
অনেক বছরের মানসিক তার। শিবেঠাকুদ্দা তো সেই কবে চোখ বুজেছে। দুগ্গিঠামার একটা
ছেলে ছিল। ছেলের বউ ছিল। নাতি নাতনিও আছে।তবে ঠাকমা তাদের দেখেনি। সেই সমুদ্দুর
পাড়ের দেশে তারা থাকে। ছেলেটাও সেই কবে উড়োজাহাজ চড়ে সমুদ্দুরপাড়ের দেশে গেছে তো
গেছে। আর আসেনি। তা মিথ্যে বলব না, দু’মাস তিনমাস অন্তর দুগ্গিঠাকমার
নামে পোস্টাপিসে টাকা আসে। নিজের খাইখরচা চালানোর মত টাকা রেখে বাকি টাকা ঠাকমা
গ্রামের একমাত্র স্কুলের হেডমাস্টারকে পাঠিয়ে দেয়।(ওই ইস্কুলেই শিবেঠাকুদ্দা পড়াতো। ছেলেটাও জলপানি নিয়ে ঐ ইস্কুল থেকে পাস
দিয়েছিলো কিনা)। মাঝেসাজে রায়বাবুদের ঠিকানায় দুলাইন চিঠিও যে পাঠায়না
তা নয়। তা ঐ ছেলের নামেই গাঁয়ের জাগ্রত বশিষ্ঠমঙ্গলা মন্দিরে মানসিক ঠাকমার।
প্রতিদিন একঝুড়ি পুজোর ফুল মন্দিরে দিয়ে মন্দিরের উঠোনটুকু ঝাঁটপাট দেবে,পুকুর থেকে জল তুলে মুছে দিয়ে মন্দির লাগোয়া বাগানের দু চাট্টি গাছে জল দিয়ে
তবে ঘরে ফিরে স্নান করবে। ঘরের কালো কষ্টিপাথরের কেষ্টঠাকুরকে পুজো করে
জলবাতাসাটুকু খাবে।তারপর সেই অনেকদিন আগেকার কাঁসার রেকাবিতে দুটি নাড়ু কি মোয়া কি
বাতাসা নিদেনপক্ষে শসা কলার টুকরো আর সদ্য দোয়ানো হীরামতি কি চাঁদমোতির ফেনাওঠা
দুধ নিয়ে আনন্দির মাথার দিকের খোলা জানলায় দাঁড়িয়ে বলবে “ও রাইমণি সোনা আমার।ওটো তো যাদু।তোমার ভোগ এনেছি যে।“
অম্নি আনন্দি টুক করে বিছানায় উঠে বসবে।
কিন্তু আজ
কি যে হল। সুয্যি ঠাকুর সেই কখন বুড়োবটের মগডালে উঠে গেছে,
আনন্দীর পেট চুঁইচুঁই করছে খিদেয় তবু দুগ্গিঠাকমার দেখাটি
নেই। সকালটা আনন্দী দুগ্গিঠাকমার জিম্মাতেই থাকে। ওর নিজের ঠাকমা তো সেই কোন
সকালেই ঘুমন্ত নাতনীকে বিছনায় রেখে মাঠের কাজে বেরিয়ে যায়। ফিরতে ফিরতে
মাঝদুপুর।আনন্দী ধীরে ধীরে মেঝেতে নামে। কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খেয়ে জলবিয়োগে যায়।
তারপর ঘরের দরজাটা টেনে পা উঁচু করে শিকল তুলে দিয়ে দুগ্গিঠাকমার ঘরের দিকে হাঁটা
দেয়।
- ও দুগ্গি ঠাকমা, কই গো,
কোতায় গেলে।
ঠাকমার
ঘরের দরজা খোলা।ঠাকমা মেঝেয় উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে।বিছানা পরিপাটি করে সাজানো।
ছোট ঠাকুরআসনে কালো কষ্টিপাথরের কেষ্ঠাকুর রোজকার চন্দন লেপা হয়ে আছে,
রোজকার মত মালা পড়েছে। ধূপ পুড়ে ছাই হয়ে মেঝেয় পড়ে আছে।
সামনের বেঁটে টিপয়টার ওপর কাঁসার রেকাবিতে দুটি নারকেল নাড়ু আর মর্তমান কলার টুকরো
কেটে রাখা আছে আনন্দীর জন্য। দুধের গ্লাসটা কাত হয়ে পড়ে গেছে,
দুধ বয়ে গেছে নিকানো পরিস্কার লাল সিমেন্টের মেঝের
ওপর।নির্ঘাত মেনি বিড়ালের কাজ। ঠাকমা একটু চোখ বুজেছে আর ও ঠিক এসে দুধে মুখ
দিয়েছে।বড্ড খিদে পেয়েছে। আনন্দী দুগ্গিঠাকমার গায়ে হেলান দিয়ে বসে রেকাবিটা টেনে
নিয়ে একটা নাড়ু মুখে পুরল। ওর ছোট্ট দেহের ধাক্কায় কেঁপে উঠলো দুগ্গিঠাকমার পাতলা
হাল্কা ঘুমন্ত শরীর। মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়া আঁচলটাতেও টান পড়ল। কালো কুচকুচে কেউটে
সাপটা তাতেই বোধহয় বিরক্ত হয়ে আরেকটা ছোবল দিল উল্টোমুখে হেলান দিয়ে বসা আনন্দীর
বামথাইয়ের পাশে। সারা ঘরে কেমন এক অদ্ভুদ নিস্তব্ধতা।ওই দেখো,
অনেকক্ষণ পাখিটা যে আর ডাকছে না।