গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০১৭

শান্তিময় কর

ভালবাসা চিরন্তন                       


সেদিন বিকেলে শর্টকাট রাস্তা ধরে পার্কের ভিতর দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল শতদ্রু, হাতে তার  একটা মোটা ফাইল। দেখলে মনে হয় অফিসের কাগজপত্র নিয়ে যাচ্ছে। একমনে হেঁটে যাচ্ছে - অবশ্য যে কাজে যাচ্ছে, সে জন্য হাতে তার তখনও আধ ঘণ্টারও বেশী সময় আছে। কিন্তু তার বরাবরই একটু জোরে হাঁটা অভ্যেস। এমন সময় তার কানে গেল কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে। কোন মেয়ের গলার আওয়াজ, শুনে মনে হয় এই কণ্ঠস্বর যেন তার অনেক চেনা। মুখ ফিরিয়ে দেখেই শতদ্রু হতবাক, নিশ্চল হয়ে যায় -- কাকে দেখছে সে এই নয় দশ বছর পরে ? কি করবে বুঝতে না পেরে সে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার সে তার নাম ধরে ডাকে। ধীর পায়ে সে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। হাল্কা স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এখানে, এখন কি তোমরা এই শহরেই থাকো”? তার উত্তর পাবার আগেই সে ডুবে যায় তার ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিতে। এই সেই বিদিশা ? এখনও সেই আগের মতই আছে, তবে দশটা বছরের ব্যবধানে বয়সের হাল্কা ছাপ পড়লেও তেমন কোন পার্থক্য বোঝা যায় না।

শতদ্রুর মনে আবার কেন এমন তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে এই মুহূর্তে ? বহু কষ্টে মনের যে ব্যথা বুকে পাথর চাপিয়ে এতকাল ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছে সে, বিদিশাকে দেখার পর থেকে কেন আবার মনের সেই পুরন ব্যথাটা এমন ভাবে বিচলিত করে তুলছে তাকে ? না, কোন মতেই মনের এই বৈকল্য, এই অনুভুতি বুঝতে দেওয়া যাবে না বিদিশাকে। মুহূর্তের মধ্যে কত কথা, কত স্মৃতি তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে - বাল্যকালের খেলার সাথী, যৌবনে ভালবাসা, মন দেওয়া নেওয়া শেষ করে ভবিষ্যৎ জীবনে একান্ত আপন শান্তির নীড় গড়ার কত স্বপ্ন, কত প্রতিশ্রুতি, কত প্রতীজ্ঞা, হাতে হাত রেখে কত শপথ নিয়েছিল ওরা দুজনে, কিন্তু কেন যে এমন হয়ে গেল, শতদ্রু আজও বুঝে উঠতে পারে না। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সব কিছু তছনছ হয়ে গেছে, জীবনটাই বদলে গেছে তার। এক বছরের জন্য কোম্পানির প্রোজেক্টের কাজে বিদেশ যাবার দিন এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে বিদায়ের আগে বিদিশার সে কী কান্না, অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করেছিল শতদ্রু। তার হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বিদিশা বলেছিল প্রতিটি মুহূর্ত সে তার পথ চেয়ে, তার কথা ভেবে ভেবেই কাটিয়ে দেবে। প্রথম প্রথম প্রতিদিন বিদিশার সাথে তার কথা হত, ফোনেই তার কান্নার আওয়াজ পেত সে আর মনটা তার ছটপট করত তার কাছে ফিরে আসার জন্য। কিন্তু পরে পরে কথা বলা কমতে কমতে একদিন তাও বন্ধ হয়ে গেছল। সে বিদিশার বাড়ীতেও ফোন করেছিল অনেকবার কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোন খবর পায়নি, তারা যেন কেমন নিঃস্পৃহ থেকেছে। খুবই অবাক লেগেছে তার। সমগ্র ব্যপারটা তাকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছিল। দেশে ফিরে সে দৌড়ে গেছল তাদের বাড়ী আর চরম আঘাতে সে বিহবল, খানখান, খতবিক্ষত, টুকরো টুকরো হয়ে গেছল যখন সে শুনেছিল বিদিশার তো কবেই বিয়ে হয়ে গেছে এবং তখন সে শ্বশুর বাড়ীতে। সে এখনও ভাবতেই পারে না কি করে এমন হয়, হতে পারে। একদিন যে বিদিশা বলত এই পৃথিবীতে তাকে এবং তাকেই সে সব চাইতে বেশী ভালবাসে, সে কেমন করে এত বদলে যেতে পারে ? কোথায় হারিয়ে গেল তার সুন্দর সোনালি স্বপ্নগুলো, স্বপ্নমাখা দিনগুলো ? কোথায় হারিয়ে গেল সেই প্রতিশ্রুতি, সেই শপথ ? আজ এতদিন পর আবার কেন বিদিশার সামনে এসে দাঁড়াতে হল তাকে ?

শতদ্রুর কথার জবাব দিতে গিয়ে বিদিশাও সেই অতীতে ফিরে যায়। চাপা অথচ হৃদয় বিদীর্ণ করা একটা ব্যথা তাকে বিমুঢ়, বিহবল, উতলা করে তুলে। অতীতের স্মৃতিতে হারিয়ে যায় সেও। কী ছিল সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো ! এই মুহূর্তে তার চোখের সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে কত স্বপ্নই না সে পোষণ করতো নিজের মনে। শতদ্রুর মধ্যে এই মুহূর্তে কোন পরিবর্তন খুঁজে পায় না সে। শুধুমাত্র তার শরীরটা একটু রোগা হয়ে গেছে। সাদামাটা ছিমছাম পোষাকেও সে এখনও খুবই সুন্দর, শুধু মুখটা কেমন যেন করুণ। দেখলেই মনে হয় অনেক ঝড় বয়ে গেছে ওর দেহে মনে। ওর করুণ মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না বিদিশা। আজ এতকাল পর আবার তার মনে হতে থাকে শতদ্রুর এই অবস্থার জন্য সেই তো দায়ী। প্রতিশ্রুতি তো সেই ভেঙ্গেছে। কিন্তু হায় ভগবান, সে যে কত নিরুপায় ছিল সেদিন, সে কথা আজ এতকাল পর কেই বা বিশ্বাস করবে। কে বিশ্বাস করবে, তার সেই অসহায় অবস্থায় সে শুধু শতদ্রুকেই পাশে পেতে চেয়েছে মনে মনে অথচ তার সাথে যোগাযোগ করারও কোন উপায় ছিল না তার। একটা বোবা কান্নায় তার বুক ফেটে গেছে কিন্তু কিছুই করতে পারেনি সে। আজ এই মুহূর্তে সারা দেহমন তার উত্তাল হয়ে উঠছে। কত কথাই না মনে পড়ছে তার, আর একটা অসহ্য যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। চোখ দুটো তার ঝাপসা হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে পারলে মনটা তার হাল্কা হত, কিন্তু তারও যে উপায় নেই। এতদিন সে অনেক কষ্টে যা ভুলে থাকার চেষ্টা করে আসছে, আজ আবার নতুন করে সেই কষ্টটা তাকে জর্জরিত করে তুলছে। কত স্মৃতি তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। একটা দিনও এমন যায়নি যেদিন তারা নিভৃতে, একান্তে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা না পার করে দিত। হাতে হাত রেখে নদীর তীরে বা মাঠের সবুজে বসে কত রঙিন স্বপ্নেই না মশগুল হয়ে থাকতো তারা দুজন। শতদ্রুর কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় সে। শতদ্রু জিজ্ঞেস করে, “কী ভাবছ এত” ? সে বলে, “ আমরা এখন এখানেই প্রায় দুবছর ধরে শতদ্রু তাকে আরও জিজ্ঞেস করে, “তুমি এখানে একা বসে” ? সে উত্তর দেয়, “না, একা নই, তো ওখানে আমার হাসব্যান্ড ছেলে মেয়েকে নিয়ে খেলাচ্ছে এই বলে সে একটু এগিয়ে গিয়ে তার হাসব্যান্ড সুশান্ত কে ডেকে নিয়ে এসে তার সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তিনি বলেন, “আপনারা গল্প করুন, আমি ওদের কাছে যাই' এই বলে তিনি চলে যান। বিদিশা শতদ্রুকে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছো তুমি” ? শতদ্রু বলে, “বেশ আছি, মানে খুব ভাল আছি এর পরের প্রশ্ন, “বিয়ে করেছো তুমি শতদ্রু” ? কিছুক্ষণ একদম চুপ থেকে সে উত্তর দেয়, “ কাজটাই আর করা হয়ে উঠলো না। থাক না ওসব কথা, পরে না হয় অন্য কোনদিন ব্যপারে কথা বলা যাবে এই বলে সে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু বিদিশা তাকে বলার জন্য জিদ ধরায় সে বলে, “কি করে আর বিয়ে করি বল ? মনের মানুষ আর কোথায় পেলাম ? একজনকে মন দিলাম, মনটাই আমার ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল, মনে প্রাণে ভালবাসলাম তাকে, আমার ভালবাসা মিথ্যে হয়ে গেল। সে বলত, সে আমাকে এই পৃথিবীতে সব চাইতে বেশী ভালবাসে, তাও শুধু স্বপ্ন হয়েই থেকে গেল। কাউকে একবার মন দিলে, আর কি ফেরা যায়? আমার হৃদয়, মন, আমার সব ভালবাসা আমি যে তাকেই দিয়ে দিয়েছি। সে আজ বিবাহিত, স্বামী, পুত্র, কন্যা নিয়ে তার সুখের সংসার। কিন্তু আমি, আমার মন সেই একই জায়গায় থমকে থেমে আছে। মনটাকে কতভাবে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করি, মনে মনে গভীর ভাবে উপলব্ধি করি যে তার কথা এখন মনে স্থান দেওয়াও পাপ, কিন্তু তবুও এই মনটার উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রন নাই। আর তাই মনে হয়, শত চেষ্টাতেও তাকে আমার মন থেকে সরাতে পারবো না।

 বিদিশা বাকশক্তি রোহিত হয়ে পাথরের মত শক্ত হয়ে বসে থাকে। কি আর বলার আছে তার, কিই বা বলতে পারে সে। আর বললেও তো তার কথা কি এখন আর বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে শতদ্রুর ? জীবনে সে আর নিজের অবস্থাটা তার সামনে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে ধরতে পারবে না। শতদ্রু কেন, এরকম মানসিক অবস্থায় কোন মানুষই কোন যুক্তিই মেনে নেয় না, মেনে নেবে না। তাই সে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে। তবুও কি মনে করে সে একবার শতদ্রুকে বলার চেষ্টা করে তার অসহায় অবস্থাটার কথা। শতদ্রু বলে, “থাক না ওসব কথা, আমি তো তোমাকে দোষ দিচ্ছি না বা তোমার কাছে কোন ব্যাখ্যা চাইছি না। আমরা একদিন পরস্পরকে অনেক ভালবেসেছিলাম, একটা শান্তির নীড় গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সব কিছু চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না। তাই আমার সেই স্বপ্নও আর পূরণ হল না। থাক না ভালবাসা বেঁচে আমার বুকের মধ্যেই। আমার মনে তো কোন ক্ষোভ নেই এখন আর। তাছাড়া সব সুখ তো সবার কপালে জোটে না। তুমি যেখানেই থাকো, ভাল থেকো, সুখে থেকো। আমার ভালবাসা আমার অন্তরে আর আমার ভালবাসার মানুষের জন্য, তার সুখের জন্য আমি সব কিছুই করতে পারি, এমনকি এই জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি। ভালবাসা মরে না, ভালবাসা অমর। আমার হাতে আর সময় নেই, আমার বস অপেক্ষা করে থাকবেন, এক্ষুনি তাঁকে এই ফাইলটা দিতে হবে। চলি এখন এই বলে শতদ্রু আর সেখানে দাঁড়ায় না, চলে যেতে থাকে। বিদিশা তার চলে যাওয়ার পথের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকে আর তার দুচোখে দু' ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
এর কিছুদিন পর একদিন বিকেলে শতদ্রু রাস্তা পার হবার সময় দেখতে পায় উল্টো দিক থেকে দ্রুত গতিতে সুশান্ত এগিয়ে আসছে। হঠাৎ সে দেখতে পায় একটা বাস তীব্র গতিতে তার দিকে এগিয়ে আসছে, সুশান্তর সেদিকে খেয়ালই নেই। বাসটা যখন তার খুব কাছে এসে গেছে, আর একটু হলেই সে চাপা পড়বে বাসের তলায়, তখন শতদ্রু তীব্র গতিতে দৌড়ে গিয়ে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। কিন্তু শেষরক্ষা আর হল না। বাসটা তাকেই চাপা দিয়ে একটু সামনে গিয়ে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। রাস্তার মানুষজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। সত্যিই ভালবাসার মানুষের জন্য নিজের জীবন দিয়ে সে তার ভালবাসাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। সত্যিই ভালবাসা মরে না। ভালবাসা চিরন্তন।