ধুপ
ধুপ; ছোট ছোট শব্দ। কিছু ফেলছে কেউ। ঘুমাচ্ছিলেন রেবেকা। শব্দে ভেঙে গেল ঘুম।
কিসের শব্দ,কোনদিক থেকে আসছে! সদ্য ঘুম-জাগা রেবেকা বুঝতে পারেন না। রেবেকা মাথার
কাছে খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, রাতের আঁধার ফিকে হয়ে আসলেও তখনও কাটেনি
আঁধার। কিছুক্ষণ শব্দ শুনতে না পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলেন না তিনি। জানালা দিয়ে আকাশ
দেখলেন, দেখলেন আঁধারের ফিকে হওয়া। ভোর নামছে ধীরে। বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ের
যাওয়ার পর অন্যরকম শব্দ শুনতে পেলেন- খসখস, খসখস। কেউ কিছু কাটছে। ঘাস কাটা কাঁচি
দিয়ে বিরামহীন খসখস করে কাটছে কেউ। এবারে না উঠে পারলেন না রেবেকা। শব্দটা বাগানের
দিক থেকে আসছে।
সর্বনাশ!
কলাগাছগুলোকে কাটছে না তো কেউ। হঠাৎ কলাগাছগুলোর কথা মনে পড়লো রেবেকার। আম-কাঁঠাল
বাগানের কোল ঘেঁষে কলাবাগান করেছেন তিনি। গাছ পঞ্চাশটি। কলা এসেছে সবকটিতেই। কলাসহ
গাছ কেটে ফেলছে নাতো? তড়িঘড়ি বিছানা থেকে নেমে চাবি হাতে নিলেন।
বাড়ির
দুইদিকে দরোজা। একটি বাগানের অন্যটি বাইরে বের হওয়ার। রাতে তালা দিয়ে রাখেন।
ইদানিং মনে ভয় ঢুকেছে রেবেকার। মনে হয় কেউ ঘুরঘুর করছে আশেপাশে। অসুস্থ স্বামী।
স্বামী ছাড়া একজন কাজের লোক আছে বাড়িতে।
ছেলেমেয়ে দুজন; একজন আমেরিকা অন্যজন ঢাকা। রেবেকার বয়স ষাটের কাছাকাছি হলেও
ঘরে-বাইরে সামলাতে হয় তাকেই। রেবেকা বাগানে বের হয়ে আসেন। কলাবাগানের দিকে পায়ে
পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে। বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয় বাগান। দরোজা থেকেই দেখা যায়; চোখে
ভালো দেখেন না। কিছুদূর হাঁটতেই মানুষের ছায়া দেখতে পান তিনি। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন,
কাছে গিয়ে চিনতে পারলেন।
সেকান্দার, মেজতরফের বড়কর্তা। কাটা কলাগাছগুলোর
পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রেবেকাকে দেখে হতচকিত হয়ে পড়ে সেকান্দার। কথা বলতে তেতলায়। বলে,
দে- দে- দেখ টুনির মা, কারা যেন তো- তোমার গাছগুলো কেটে আমার সীমানায় ফেলে রেখেছে।
সেকেন্দারের মুখে স্থির দৃষ্টি রাখেন রেবেকা।
তারপর বলেন, ‘আমি তো এই মাত্র গাছ কাটার
শব্দ শুনতে পেয়েছি; তুমি ছাড়া এখানে তো আর কেউ নেই। তাছাড়া গাছগুলো তো আমার জমির
মধ্যেই পড়ে আছে।’ সেকান্দার নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘কী বলতে চাইছ, তোমার গাছ আমি
কেটেছি।’
‘আমি
শুধু আমার দেখার, শোনার কথা বলেছি। তুমি কেটেছ তাতো বলিনি।’ ‘বলার আর বাঁকি রেখেছ
কোথায়।’ রেবেকা থামাতে চেষ্টা করেন সেকেন্দারকে। যতই বলেন,আমি তো বলিনি তুমি কেটেছ
ততোই চিৎকার করে সেকেন্দার। রেবেকাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বকবক করতে থাকে
সে। দেখে নেব, বলে শাসিয়ে মারমুখী হয়ে হাতের কাঁচি নিয়ে তেড়ে আসে।
সেকেন্দারের
মারমুখী মূর্তি দেখে কথা বাড়ায় না রেবেকা। ওকে ভয় করেই চলেন আজকাল। ওর কথার কাজের
ঠিক নেই কিছুই। মেরেও বনতে পারে হয়তো! মরে বসলে অপমানের বাঁকি থাকবে কিছু। একা একা
অসুস' স্বামী নিয়ে থাকেন। কেন যেন মনে হয় যে কোন সময় খুন হয়ে যেতে পারেন তিনি। এই
জন্যই সেকেন্দারকে এতো ভয়। রেবেকা ধীরে ধধীরে বাড়ির দিকে হাঁটেন। দুঃখে ছেয়ে যায়
মন। এতো বড় বড় কলার কাঁদি- মনে হতেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল।
পুরানো
কথা মনে পড়ে রেবেকার। শ্বশুরেরা তিন ভাই, দুই বোন। মেজতরফ- সেকান্দারের বাবা যখন
মারা যায় তখন বেঁচে ছিলেন দাদাশ্বশুর। তখনকার আইন অনুসারে বাবার আগে ছেলে মারা
গেলে অংশিদারিত্ব থেকে বঞ্চিত হতো মৃত ছেলের ছেলেপুলেরা। সেই হিসেবে মেজ-তরফের
ছেলেপুলেরা দাদার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে পাশে দাঁড়ায় রেবেকা আর রেবেকার
স্বামী আইনুদ্দিন। অন্য সব তরফকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে সম্পত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন
তাঁরা। ওরা যাবে কোথায়? খাবে কী? এতসব কথা শুনে শ্বশুর বলেছিলেন, দেখ বউ মা, এদের
সম্পত্তি না দিলেই ভালো হতো। তোমার চেয়ে অভিজ্ঞতা বেশি আমার, বললাম দেখে নিয়ো সূচ
হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হবে ওরা।’ রেবেকা বলেছিলেন, ‘কিছুই হবে না আব্বাজান।’
কথাগুলো মনে হয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয় বুক চিরে। মৃত শ্বশুরের উদ্দেশ্যে মনে মনে
বলে ‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন আব্বাজান;আপনার কথা শুনলে এই রকম ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে হতো
না আমার। সারাদিন সংসারের কাজকর্ম করেন কিন্তু মন দিতে পারেন না কাজে;ঘুরেফিরে
কলাগাছগুলোর কথাই মনে আসে রেবেকার। মন খারাপ হয়ে থাকে। কেন যে এতো টাকা খরচ করে এই
গ্রামে এসে বাড়ি করেছিলেন! এখন এই বাড়ি শহরে থাকলে রাজার হালে থাকতে পারতেন তিনি।
নিজে থেকেও ভাড়া দিয়ে কিছু হাতেও আসতো। সঙ্গী পেতেন অর্থও পেতেন। এরকম একা একা ভয়ে
ভয়ে দিন কাটাতে হতো না।
এখন
তো এই ভাবনা করে কোন লাভ নেই। ভেবে ভেবে তো অতীতের কিছু কিছু কাজ যা বদলানো সম্ভব
হয় না কখনও। এখানে তো স্বামীর ইচ্ছার প্রধান্য দিতেই এই বাড়ি। বাস্তুভিটা, কয়েক
পুরুষের বসতবাড়ি। দিন গিয়ে রাত আসে; ঘুম আসেনা রেবেকার। সেকেন্দারের মারমুখী
মূর্তি ভাসে চোখে। এই মূর্তি আগে দেখেননি কখনও। শুধু আজ নয় ইদানিং ওই পরিবারের
সবাই খারাপ ব্যবহার করছে তাঁর সঙ্গে। এই তো গতকাল, সেকেন্দারের বউ জরিনা অকারণে
বাড়ি বয়ে এসে যা-তা বলে গেল। রেবেকা সব শুনেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হন। ছেরে যদি
থাকতো কাছে তবে অপমানের জবাব দিতে পারতেন।
একা
একা খুব ভয় করে এখন। ভয়ের কারণ এই জমিজমা। সবটুকু জমি তো এখন তাঁর নামে। স্বামী
তাঁর নামে দানপত্র করেছেন বছর আগে। একথা কেমন করে জানতে পারলো সেকেন্দার তা জানেন
না তিনি। যেদিন থেকে জমির কথা জেনেছে সেদিন থেকেই পরিবর্তন হয়েছে সেকেন্দারের।
সম্পত্তির লোভ বড় লোভ।
রেবেকা সম্পত্তি ছেলেমেয়ের নামে ট্র্যান্সফার
করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই সম্পত্তির আসল হকদার তো ওরাই। রেবেকা আবোল-তাবোল
চিন্তায় খেই হারান। মাঝরাতে কুকুরের ডাক শুনতে পেয়ে উঠে বসেন। ঘরের পেছনে মৃদু
পায়ের শব্দ পেয়ে মাথার কাছে রাখা দা’টা শক্ত করে ধরে জানালায় গিয়ে দাঁড়ান। বাইরে
থইথই জোছনা। বের হয়ে জোছনা ভিজতে ইচ্ছা করে এই বয়সেও। কিন্তু বের হতে ভয় পান। নাহ্
সম্পত্তি বড় খারাপ জিনিস!
পরদিন শহরে যান রেবেকা। উকিলকে কাগজপত্র তৈরি
করতে বলে সোজা থানায় উঠেন। বড় বোনের ছেলে রশিদ নতুন ওসি হয়ে এসেছে। রশিদ সব শুনে
আশ্বাস দেয় তাঁকে। কথা দেয় এখন থেকে থাকবে রেবেকার বাড়িতে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
দুইদিন
পর। মাঝ রাত। টুক টুক শব্দ। খুলে যায় দরোজা ছিটকিনি। পা টিপে টিপে বিছানার দিকে
এগিয়ে আসছে কেউ। অন্ধকার ঘর;আড়ষ্ট রেবেকা বসে আছেন চেয়ারে। রশিদ তৈরি ছিল। জ্বলে
ওঠে আলো। হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠায় ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে পড়ে সেকেন্দার। রেবেকা ধিক্কার
দিয়ে বলেন, ছি সেকান্দার ছি! সম্পত্তির এতো লোভ তোমার, খুন করতে এসেছ আমাকে! যে
সম্পত্তির জন্য খুন করতে এসেছ তাতে আর আমার নামে নেই সেকেন্দার! সেকান্দারের মুখে
কথা নেই। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতকড়া হাতে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে
থাকে রশিদও।