(৩)
সীতারামের দোকান থেকে বেরিয়ে ছেলেদের দঙ্গলটা একেবারে ক্যারামের গুটির মত ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। কেউ পূবে, কেউ পশ্চিমে আবার কেউ বা নাক বরাবর উত্তরের বাসিন্দে। কাছাকাছি দু চার জন যেমন আছে, আবার দুরেরও আছে। ছেলে ছোকরাদের মধ্যে হীরালালের বাড়িই এদের মধ্যে সকলের চেয়ে দূরে। সীতারামের দোকান থেকে সোজা উত্তরে মাইলখানেক গেলে পড়বে লোহাপট্টি। লোহাপট্টি থেকে বাঁদিকে যে রাস্তা ঘুরে গেছে সেখান থেকে আরো মাইলখানেক মত গেলে ঘুসুনিয়া। ঐ এলাকা টা শহরের যত অবাঙ্গালী ব্যবসাদারদের বসতি। হীরালাল নিজেও অবাঙ্গালী, যদিও এখানে থাকার সুবাদে, বাঙ্গালীপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে এক স্কুলে পড়া, একই ক্লাবে ফুটবল খেলা ...আর এইসব কারণে মোটামুটি ভালো বাংলা জানে, কথাবার্তায় ধরা গেলেও সেটা এমন কিছু নয়। দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজোতেও তাই হীরালাল এখানকার বাঙ্গালী ক্লাবের একজন।
জায়গাটা বিহার-বাংলার একটা মফস্বল শহর হলেও প্রচুর বাঙ্গালীর বসবাস, তাই অনেকসময় বাংলার
কোন ছোট শহর বলেই ভুল হয়। ছোট শহর হলেও এখানে বেশ কয়েকটি ভালো ভালো স্কুল আছে,আছে কলেজ। বড় হাসপাতাল আছে,
খুব বড় রকমের না হলেও রেল কলোনীও
আছে, যে কলোনীতে থাকেন এখানকার রেলের সব কর্মীরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে। একটা ছোটখাটো খেলার স্টেডিয়াম আছে, যেখানে এখানকার প্রায় সব স্কুল কলেজের বার্ষিক খেলার
অনুষ্ঠান হয়। হীরালাল ছাড়াও আছে উপেন,
ছেদিলাল, প্রতাপ
নামের আরো কয়েকটি অবাঙ্গালী ছেলে যারা একই স্কুল কলেজে পড়েছে, বন্ধুত্ব
হয়েছে, মিলেমিশে রয়ে গেছে এদেরই সঙ্গে। হীরালালের মত ঠিক অতটা না হলেও এরাও মেতে থাকে
সব রকমের উৎসবে। অল্পবিস্তর বাংলাতে কথা বলতে সকলেই পারে।
বাড়িতে ঢুকতেই চমক খেল হীরালাল।
বাইক রেখে উঠোনের দিক থেকে ঘরে ঢুকতেই কুসুম এসে দাঁড়াল, মুখে আঙ্গুল। ইশারায় জানালো বাবুজী বহোত গুস্সে মে হ্যায়! কুসুম
হীরালালের বৌ, সবে আট
মাস হল তাদের বিয়ে হয়েছে। অসম্ভব বিচ্ছু মেয়ে,কখন যে কি বলে আর কি করে বোঝা মুশকিল। কিন্তু বাবুজী
গুস্সে মে কেন, ভুরু
কোঁচকাল হীরালাল। বাড়িতে কিছু হয়েছে!
বাইরের ঘরে উঁকি মেরে দেখল
বাবুজী মানে জীবনলালা সিঙ্ঘানিয়া ঘরের
মেঝেতে পাতা গদির উপরে বসে তাকিয়াতে হেলান দিয়ে মৌজ করে বসে ভুবন চাচার সঙ্গে গল্প করছেন। ভুবন চাচারাও এখন তাদের
মত এখানকার বাসিন্দে হয়ে গেছেন। শহরে ভুবন চাচার মস্ত লোহা লক্করের কারবার, এ তল্লাটে অত বড় কারবারী কম আছে। দিওয়ালির পর একমাত্র মেয়ে
সরস্বতীর বিয়ে, তাই নিয়ে বাবুজীর সঙ্গে গল্প করছেন। হীরালালের বোন অঞ্জু আর সরস্বতী একই সঙ্গে স্কুলে পড়ত। অঞ্জুর স্কুল
পাশ করেই বিয়ে হয়ে গেছে, কিন্তু এই
মেয়ে জেদ ধরেছিল কি কলেজ পাশ না করে শাদীতে বসবে না, তাই দেরী।
কিন্তু কুসুম যে বলল—বাবুজী গুস্সে মেঁ, কি শয়তান মেয়ে, উফ্!
ঘরের ভিতরে এসে দেখে কুসুম খুব
মন দিয়ে টিভি দেখছে। বিনুনীতে এক টান মেরে বলল—ঝুট কিঁউ বোলী?
কুসুমের ঝটিতি উত্তর—তো, মেঁ কেয়া করুঁ...বলেই জোর গলায় ডাক—মম্মীজি... ত্র্যস্ত হয়ে কুসুমকে ছেড়ে দেয় হীরালাল। পাশের ঘর থেকে হীরালালের মা এসে জিজ্ঞেস করেন—ডাকছিলে কেন?’
অবাক হয়ে কুসুম বলে—কই, আমি না তো! টিভি তে একটা মেয়ে জোরে জোরে তার মা’কে ডাকছিল, ওউর হায় রাম, অপনে সোচা কি বহ মেঁ থী?’
কুসুমের ঝটিতি উত্তর—তো, মেঁ কেয়া করুঁ...বলেই জোর গলায় ডাক—মম্মীজি... ত্র্যস্ত হয়ে কুসুমকে ছেড়ে দেয় হীরালাল। পাশের ঘর থেকে হীরালালের মা এসে জিজ্ঞেস করেন—ডাকছিলে কেন?’
অবাক হয়ে কুসুম বলে—কই, আমি না তো! টিভি তে একটা মেয়ে জোরে জোরে তার মা’কে ডাকছিল, ওউর হায় রাম, অপনে সোচা কি বহ মেঁ থী?’
--একদম পাগল
হ্যায় তু’ মা চলে গেলে কুসুমের দিকে চোখ পাকায় হীরালাল-একদিন এয়সা
পিটুঙ্গা না..., দেখ লেনা!” বাইরে গেল
সেও। ওঘরে বাবুজির কাছে তারও একবার বসা উচিৎ। জামাকাপড় বদলে বাইরের ঘরে এসে ঢোকে
হীরালাল । ভুবন চাচার দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে—রাম রাম চাচা, পায় লাগি...!’
রেল কলোনীর ৮নং কোয়ার্টারের রেলবাবু পার্থ বসুর বাড়ির সামনে ইদানীং বেশ ঘন ঘন দেখা যাচ্ছে দুলুকে। সাইকেলে ঠিক বসা নাহলেও দুদিকে দুটো পা ছড়িয়ে আধ বসার ভঙ্গিতে সাইকেলের উপর বসে আছে কিংবা দাঁড়িয়ে আছে দুলু। হাত, পা , মুখ নেড়ে অনবরত কথা বলে চলেছে দুলু ঘরের দরজার সামনে। পর্দার আড়ালে যে কেউ আছে এবং তার সঙ্গেই কথা হচ্ছে বোঝা গেলেও পর্দার ভিতরের মানুষটি সামনে আসছে না একবারও। স্টেডিয়ামের দিক থেকে দুলুর কাছে আসার জন্য বাটু আর টুটুল জোরে সাইকেল চালিয়ে আসছিল কথা বলতে বলতে। সাইকেল চালানোর জন্য আগে-পিছে করে আসতে হচ্ছিল ওদের। কথা হচ্ছিল কলকাতা নিয়ে। বাটু কলকাতা দুচক্ষে দেখতে পারে না। দিদির বিয়ে ঠিক হচ্ছে কলকাতায়, একেবারেই পছন্দ নয় বাটুর। তার ধারণা কলকাতার লোকেরা সব ঠগ,জোচ্চোর। ওদের মফস্বলের লোক বলে আরো ঠকিয়ে নেবে। দরকার কি, ওখানে ছুটকির বিয়ে দেবার। এই নিয়েই গজগজ করছিল বাটু। টুটুল হেসে বলল, তুই কলকাতা দেখেছিস?
বাটু একবার টুটূলের দিকে তাকিয়ে
বললে- কেন, পরীক্ষা দিয়ে যাইনি? আরে আমায় একটা পেয়ারা গাছ দেখিয়ে
আমার মাসির মেয়ে কি বললে জানিস! -এটা কি গাছ চিনিস, ছোট?’
আমি বলেছি-আমরুদ। অমনি কি হাসি, এমা, তুই পেয়ারা গাছ চিনিস না। আমিও বলেছি জানব না কেন? আমি আমরুদও জানি, পেয়ারাও জানি। তোরা তো শুধু একটাই জানিস। যত্তসব, কলকাতার
ঢঙ!!’
বাটুর রাগ দেখে হা হা করে হাসছিল
টুটূল হাসতে হাসতেই ওরা চলে এলো পার্থ বসুর বাড়ির সামনে। এসে দেখল দুলু বিচিত্র ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে কারো
সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। বাটুদের দেখে ঘরের সামনের যেটুকু পর্দা সরানো ছিল, তাও ঢাকা পড়ে গেল। দুলু ওদের দেখে বলে ঊঠল,
এতো দেরী করলি, সেই কখন
থেকে তোদের জন্য দাঁড়িয়ে আছি!’
-আমাদের
জন্য দাঁড়িয়ে আছিস? ঠিক আছে, চল—কাল লীলু পিসিকে জিজ্ঞেস করব তুই কার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলি। এখন চল তো’
লীলা রেলবাবুর বড় মেয়ে, দুলুর সহপাঠিনী। সাইকেলে নিয়ে তিনজনে কিছুটা যাবার পর দুলু
একটু পিছিয়ে এসে বাটুকে জিজ্ঞেস করল—তোরা লীলাকে লীলু পিসি বলিস কেন রে, বাজে লাগে
শুনতে’
বাটু টুটুলকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোরা পিসে কে কি বলিস রে, টুটুল- বলেই দুলুকে বললে,তোকে পিসে বলব কিনা, তাই!’ তিনজনেই জোরে হেসে উঠে সাইকেলের গতি বাড়াল। আজ বাজারের একটা গুজব কানে এসেছে, কি হয়েছে, দেখাই যাক্। পুলিশ এসেছিল, খবর পেয়েছে। পুলিশ কেন, কার কি হল? ওরা জোরে সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে গেল।
বাটু টুটুলকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোরা পিসে কে কি বলিস রে, টুটুল- বলেই দুলুকে বললে,তোকে পিসে বলব কিনা, তাই!’ তিনজনেই জোরে হেসে উঠে সাইকেলের গতি বাড়াল। আজ বাজারের একটা গুজব কানে এসেছে, কি হয়েছে, দেখাই যাক্। পুলিশ এসেছিল, খবর পেয়েছে। পুলিশ কেন, কার কি হল? ওরা জোরে সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে গেল।