সোনার গয়না নয়, রুপোর বাসন নয়, বাঘের ছানা
নয়, অলিম্পিকের স্টেডিয়াম নয়, শুধু মাঝে
মধ্যে তোমার দিকে তাকিয়ে যখন একটা মাত্র
প্রিয় শব্দের আশা করি, তখন দেখি তুমি এখনো
ব্যস্ত সেই গত দশ বছরের মত; আমার সঙ্গে নির্জনে কথা বলার সময় তোমার এ জন্মে
আর হলনা । এই সব দেখেশুনে আমার ভেতরের এই
সব ছন্নছাড়া ইচ্ছেগুলি ক্ষইতে ক্ষইতে একসময়
মরে যায় । ব্যস্ততার ভেতরে তুমি
ক্লান্ত হয়ে সোফায় ঘুমিয়ে পড়লে তোমাকে জাগাতে চেয়ে খয়েরী টিউলিপেরা ছড়িয়ে দেয়
তাদের সুরভিত পরাগ, তবু তোমার অনড়
ক্লান্তির শেষ আর হয়না। যেমন শেষ হয়না অনন্ত ঘণ্টা ধরে হাজার কাজের । এতসব
দেখেশুনে প্রার্থনা গাছের পাতাগুলি হাত জোড় করে নড়ে বসে, পাতাবাহারের গায়ের বাহারী
লাল ফুটকিগুলো নিস্প্রভ হয়ে আসে, আর আমি রাত দুটোর সময় ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া ভাতের
থালা সরিয়ে রেখে, সিঁড়ি ভেঙ্গে অভিমানী চাঁদের ভাঙ্গা মুখ দেখতে উঠি।
বিমান বন্দরের কাছে আছি বলে প্রতিদিন
দেখি কত যে প্লেন ওঠে আর নামে বিদেশী মাটির গন্ধ মেখে। আমারও তো
থাকার কথা ছিলনা এমন বিদেশে, কি করে যে
রয়ে গেছি কচুরীপানার পাতার ভেতরে ভেজা শাঁসটির মতো অঙ্গেসঙ্গে, তবু এই দশ বছরে, কাজের শেষে কত আগ্রহ ভরে শুনতে
চেয়েছি একটা দুটো প্রিয় শব্দ, অথচ নীরব অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। আমি নিজে
কাজে যাবার সময় ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে যখন
গাড়িতে স্টার্ট দি, ইঞ্জিন পাকামো করে বলে, “ এমন রাগ করে অত দূরে যেতে নেই, যাও,
গিয়ে বলে এসো, দেখা হবে সন্ধেয়”, জানালার কাঁচেরা বলে,“একটা বিদায়ী চুমোয় কি এমন
দোষ? তুমিই না হয় আজ দিলে” । উইনশিল্ড ওয়াইপারের ব্লেডগুলি মাথা নেড়ে নেড়ে বলতে
থাকে, “বলে এলেনা? ভালো হলনা, ভালো হলনা কিন্তু।“ যেতে যেতে যত বরফ বৃষ্টিতে
পিচ্ছিল হয় পথ, অথচ ৮০ মাইল বেগে না গেলে মরে থাকার সম্ভাবনা সে উড়াল পথেই, তখন
মনে হয়, কার জন্য খেটে মরছি, কি জন্য করছি এই সব, কি দরকার? প্যাসেঞ্জার সীটে তোমার ফেলে যাওয়া
উদ্বিগ্ন স্কার্ফ, আমি জমতে থাকা হাত রাখি
তার নরমে। পশমের আদরে জল আসে চোখে । প্রিয় গান গেয়ে ওঠে সিডি প্লেয়ার, “ভালোবেসে
সখী...” । এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছি, চোখে জল আসা চলবেনা এখন, দুচোখ কুয়াসায় ঝাপসা
হওয়া চলবে না, মৃত্যু এখন বাজপাখীর মত এমন হাইওয়ের কোণে কোণে অপেক্ষারত, তাই ঢোঁক
গিলে ভেতরে চালান করে দিতে হয় যন্ত্রণাকে । পাথর কঠিন মুখে জরিপ করতে হয় আগের
গাড়িটির গতিবেগ, দুরত্ব, অন্ধকার, ঝুরো স্নোর আর
গলা তুষারের দৌরাত্ম্য ।
যত এগিয়ে আসে ফেব্রুয়ারী, তত বেড়ে যায়
কুয়াসার দৌরাত্ম্য, তত বাড়ে ভিড় তীব্র
গতির রাজপথে, আর আমি ভাবি এতোগুলি মানুষ এই ভোরে চলেছে কোথায় ? তারাও কি
অভিমানে...? যেদিন বেশী করে আশা করি খুব
তাড়াতাড়ি ভোর ফুটবে আর একটা গোলাপি-কমলা আভামাখা আকাশ দেখবো, সেদিন সারাদিন ধরে
ঝরে বৃষ্টি । মেঘে ভরা ওই নিকষ অন্ধকারের আকাশের নীচে এখানে ওখানে একা জ্বলে
তিনতলা সমান আলোয় সাজানো গাছগুলি। একঝলক রঙিন আর উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ে জনহীন ডাউন-টাউনের
চৌকোনা অফিসগুলিতে । পুরনো লেপ কাঁথা আর শীতের জ্যাকেটের খোঁজ করে কিছু লোকজন, এত
শীত, মানুষ জমে শক্ত হয়ে মরে যাবে যে । কত হাজার লোকের যে রাতের আশ্রয় নেই, একটা
উষ্ণ ঘর নেই, তা আর কয়জন জানে। বুকে ভালোবাসার স্রোত এলে, কেউ কেউ সারারাত খুলে
রাখে ভবঘুরেদের জন্য বিনামুল্যের রেস্তোরাঁ,
এই শীতে গরম সুপের চাহিদা অনেক। রেডিওর খবরে বলে, “মিনেসোটাতে এবছর তিন ফুট
স্নো ঝরেছে, তারপরে ঝড়ে উড়ে গেছে গ্রামকে গ্রাম, শীতের দাপটে বাস্তুহীন মৃত লোকের
সংখ্যা এখন পাঁচশো ”। আমাদের এখানে এক ইঞ্চিও স্নো ঝরেনি, অথচ
প্রতিরাতে লেপের ভেতরেও আমার হাত পা কালিয়ে আসে শীতে। সারাদিনরাত খেটেও ঘুম আসেনা
চোখে । বালিশে ঝরে পড়ে অর্থহীন অশ্রুজল,
তার তলায় বাবা মায়ের একমাত্র সাদাকালো
ছবি, পোকায় খাওয়া, একটা হালকা স্নেহের গন্ধ নিয়ে চুপ করে থাকে।
একেকদিন ইচ্ছে করে সারা বাড়ির সব আলো নিভিয়ে অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে ঘুরি,
যাই দোতলায় নিজের ঘরে, ঘুরে আসি
ফাঁকা বারান্দায়, নামি সিঁড়ি দিয়ে। কল্পনা
করি তুমি এসেই বলে উঠবে, “এ আবার কি হচ্ছে? খেলছ নাকি অন্ধকারে? আমাকেও নেবে এ
খেলাতে? চলো, এই অন্ধকারে বসে গল্প করি মনের সাধে, সেই আগের মত, চলো তুমি হবে রাজকন্যা আর আমি...।
কিম্বা চলো, সারারাত ধরে দেখি নিজেদের ছবি পুরনো গান শুনতে শুনতে আর কাটিয়ে দি রাতটুকু এলেবেলে গপ্পে গপ্পে, আজ
সারা আকাশ নক্ষত্রে ভর্তি, যাবে খোলা আকাশের নীচে শুতে? ”
আয়নার কপালে লেগে থাকা টিপটা চেয়ে থাকে
একদৃষ্টে, জানি তারও মন খারাপ হয়। দুই তোরঙ্গ ভর্তি শাড়ি আর গয়নার বাক্সটা একা
থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, ওরাও আজকাল তেমন গেয়ে ওঠেনা হৃদয় জুড়ে । ওদের ভেতর
থেকেও কবেই যেন মুছে গেছে পুজোর,
বিয়েবাড়ির বা পিকনিকের চেনা সুগন্ধ; মেলায় কেনা প্রিয় কবিদের কবিতার কয়েকটা ভারী
বই, হলুদ হয়ে আসা দু বাক্স ম্যাগাজিন,
তাদের কাছে গিয়ে বসলে তারাও কেমন
যেন অবাক হয়ে তাকায়, আর বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আমার হৃদয় ছেঁড়া কবিতার পাণ্ডুলিপি । ওদের গায়ে হাত দিয়ে আদর
করতে করতে বুঝি, আমি নিজেই কবে একে একে
হারিয়ে ফেলেছি চেনা শব্দাবলী, কি ভাবে যেন
তিলে তিলে অচেনা একটা ধুসরতার মাঝে তাদের দেখছি মিশে যেতে অথচ আমারই নাকি আলো জ্বালিয়ে পথ চিনে কোথাও
পৌঁছনোর কথা ছিল।