ছোটবেলা
থেকেই মা আমাকে পাহাড়ের গল্প শোনাতে শোনাতে ভাত খাওয়াত।মা সেই গল্পগুলো শুনত
রমেনকাকুর কাছে।রমেনকাকু ব্যাচেলর।পাশের বাড়ীতেই থাকে,এক মা ছাড়া সংসারে আর কেউ নেই।শত অনুরোধেও বিয়ে করে সংসারে আবদ্ধ হতে চায় নি
এক নেশার জন্য।দুর্গম থেকে দুর্গমতর পর্বতজয়ের নেশা।যাওয়ার আগে প্রতিবারই বলে যেত “বৌদি, মাকে তোমার জিম্মায় রেখে গেলাম,বুড়িটাকে দেখো।যদি না ফিরি তবে বোলো তোমার ছেলের স্বর্গলাভ হয়েছে,
দুঃখ কোরো না।স্বর্গে কি কেউ আর এমনি এমনি যেতে পারে গো!তোমার ছেলে পায়ে হেঁটে স্বর্গে পৌঁছেছে,ওর মুক্তি
ঘটেছে,পৃথিবীতে আর জন্ম নিয়ে
নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না।” মা রে রে করে তেড়ে গিয়ে বলত “বালাই ষাট! তোমার
মুখে কি কিছুই বাধে না গো!মাসীমার জন্য কোন চিন্তা কোরো না তুমি, নিশ্চিন্তে তোমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে ঘরে ফিরে এসো। দুগ্গা দুগ্গা।”
কাকুও পরম নিশ্চিন্তে রওনা দিত।ঠাকুমাকে অবশ্য আলাদা করে
কিছুই দেখতে হত না, কাকুদের
বাড়ীর কাজের মাসীই বাজার, রান্না সব
করে দিয়ে যেত। মা অবসর সময়ে গিয়ে ঠাকুমাকে সঙ্গ দিত, খোঁজ খবর নিত। বাবা কিছুতেই ভালো চোখে দেখত না রমেকাকুদের সঙ্গে মার এই
মেলামেশা। বাবার ছিল সন্দেহ রোগ। আমাদের পরিবারে আরো অনেকের এই রোগ আছে। বিয়ের পর
থেকে মার জীবন পুরো নরক করে দিয়েছিল বাবা। অনেক চেষ্টা করেও মানসিক ডাক্তারের কাছে
নিয়ে যাওয়া যায়নি বাবাকে।মাও খুব জেদী হয়ে গিয়েছিল, কোন ব্যাপারে বাবাকে আর মানত না, দরকারে বেমালুম মিথ্যে কথা বলত বাবাকে। আমি মেয়ে হয়েছি বলেও বাবার খুব রাগ ছিল
মার ওপর, আমার সামনেই ছোটবেলা থেকে
যারপরনাই খোঁটা দিত মাকে,আর ভেতরে
ভেতরে হিংস্র বাঘিনীর মতই জ্বলতে থাকতাম আমি অক্ষম আক্রোশে।
একবার এরকমই এক শৃঙ্গ জয় করে ফিরে এল রমেনকাকু।এক দুপুরে মা
আর আমি হামলে পড়ে সব ছবি দেখছি ও গল্প শুনছি।কাকু বোঝাতে লাগল মাকে,এরপরের বার হবে আসল অভিযান।এভারেস্ট জয় করে ফিরব।আমার কি মনে হল,পাশের ঘরে গিয়ে পাহাড়ের ছবি আঁকতে শুরু করলাম।সদর দরজায় খিল লাগাতে ভুলে
গিয়েছিলাম,বাবা কখন
নিঃশব্দে এসে মা ও রমেনকাকুর পেছনে দাঁড়িয়েছিল কেউ টের পায় নি।ঝুপ্ করে ভারী কিছু
পড়ে যাওয়ার শব্দ হল।একটা ঘুসি মেরেছিল বাবা রমেন কাকুর কানের পাশে রগের ওপর।ব্যস্,
এক ঘুষিতেই জীবন শেষ,যাবজ্জীবন জেল হয়ে গেল বাবার। এর পরের গল্প খুব সাধারণ।যা হয়,সব স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে আঠেরো বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে গেল জানাশোনা এক বয়স্ক
দোজবরের সাথে।খুনীর মেয়েকে আর কোন্ রাজপুত্তুর বিয়ে করবে!খুব তাড়াতাড়িই ফুট্ফুটে এক কন্যাসন্তানের মা হলাম আমি।পরিবারের অন্যান্যদের
মুখভার হলেও আমি খুব খুশী।রমেনকাকুর মৃত্যুর দিন থেকে সঙ্গোপনে ও সযতনে এক
অদম্য ইচ্ছেকে লালন করে এসেছি,কোন অবস্থাতেই তাকে মিলিয়ে যেতে দিই নি।এইবার সময় হয়েছে সেই বীজ রোপণ
করার।সমস্ত প্রাণমন ঢেলে দিয়েছি মেয়ের ওপর।বরের শত চাপেও দ্বিতীয় সন্তান নিতে রাজী
হই নি।”
এ গল্পের নায়িকা আজ জীবন মধ্যাহ্নে এসে পৌঁছনো এক মহিলা,নাম রমা।বসে আছেন টিভির সামনে।প্রতিবেশীদের ভীড়ে ঘর থই থই করছে।শিয়ালদা
স্টেশনে চার অভিযাত্রীকে বরণ করার জন্য সমস্ত টিভি চ্যানেলগুলো হামলে পড়েছে।লোকে
লোকারণ্য।অসংখ্য ফুলের মালায় মধ্যমণি শীর্ণ, ক্লান্ত মেয়েটির উজ্জ্বল মায়াময় হরিণী চোখ দুটি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে
না।হঠাৎই রমা ছুটে শোবার ঘরে গিয়ে বিছানায় আছড়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন “কাকু!উপমা পেরেছে, হ্যাঁ পেরেছে সমস্ত বাধা পেরিয়ে
সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটিকে জয় করতে।আজ তোমার নাতনী এভারেস্ট জয় করে ফিরেছে কাকু,
তোমার চোখ বেয়ে যে স্বপ্ন ধীরে ধীরে আমার চোখে নেমে এসেছিল
তা উপুড় করে ঢেলে দিয়েছিলাম আমার উপমার মধ্যে।আজ উপমার চোখে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি
কাকু...”। কেঁদে চলেন, কেঁদেই চলেন রমা।