কাজটি
ছেড়ে দিয়েছে তবিরন। খাটুনি বেশি নয়;তবে অল্পেই ক্লান্ত হয়ে যায়। টিবি হয়েছে ওর। চার
মাস ধরে অল্প অল্প জ্বর,কাশি। সিটামল, কফ সিরাফ খেয়েও যখন কোন কাজ হলো না তখন ওই বাড়ির
গৃহিনী, রেহানা বেগম ডাক্তার দেখিয়ে আনে ওকে। রক্ত-কফ পরীক্ষার পর ধরা পড়ে টিবি। রিপোর্ট
হাতে পাওয়ার পর ওকে ডেকে বলে রেহানা বেগম, ‘দেখ তবিরন তোমার টিবি ধরা পড়েছে।’ টিবির
কথা শুনেই হাউমাউ কান্না জুড়ে দেয় তবিরন। ওর কান্না দেখে সান্ত্বনা দেয় রেহানা বেগম,
‘না না কেঁদো না। টিবি তো এখন বড় রকমের অসুখ নয়। নিয়মিত ওষুধ খেলে আর বিশ্রাম নিলে
সেরে যায় টিবি। তুমি কাজ ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম নাও, সেরে যাবে।’ তবিরন সেই থেকে বাড়িতে।
শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না তবুও শুয়ে থাকে, ওষুধ খায় নিয়মিত। টাকা পয়সা কিছু দিয়েছে রেহানা
বেগম আর সবকিছু জয়ই করছে। সংসারের কাজ আর কতোটুকু,
সেটুকু করে সমিরন।
ছেলে-মেয়ে
দুটিকে নিয়ে চিন্তা নেই। ওদের নিয়ে সুখেই আছে ও। সুখ নেই স্বামীকে নিয়ে। ওর স্বামী
সব সময় ওর দোষ ধরার জন্য মুখিয়েই থাকে। পান থেকে চুন খসলেই মারামারি। স্বামীর জন্যই
সারছে না অসুখ। শারীরিক বিশ্রাম পেলেও পাচ্ছে না মানসিক বিশ্রাম। স্বামী অন্য নারীতে
আসক্ত। ওর আর জয়ের জমানো টাকা পয়সা সব নিয়ে যায় স্বামী, শুধু তাই নয় ঘরের জিনিসপত্র
বিক্রি করে দেয় ওই নারীকে। স্বামীর মতিগতি ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন' কোন ফল হয়নি।
অসুখে-বিসুখে আর মানসিক কষ্টে পঁচিশ বছর বয়সেই দেখায় চল্লিশের মতো। টিবিতে শরীর শুকিয়ে
অর্ধেক। কণ্ঠার হাড় বেরিয়েছে, কালো হয়েছে রং, ডাগর চোখ ঢুকেছে কোটরে। তবিরন আয়না ধরে
সামনে। আয়নায় শ্রীদেবীর ছবি ভেসে ওঠে। শ্রীদেবীর ছবি টাঙানো আছে ওর ঘরে। আহা, এমন রূপ
যদি থাকতো ওর। তাহলে কী নিজের স্বামী পর হয়ে যায়। কষ্টে ভরে ওঠে মন।
তবিরন
শ্রীদেবী হয়ে যায়। কিছুদিন আগে দেখেছিল নাগিন ছবি। কাজ শেষে রেহানা বেগমের টিভিতে।
ভাবনাতে বিভোর তবিরন। ও যেন সাপ হয়ে গেছে, ছোবল দিয়েছে স্বামীর পছন্দের নারীকে। ‘ইসিরে, যে আমার রূপ তা আবার আয়নায় দেখা।’ চমকে
ওঠে তবিরন। কখন ঘরে ঢুকেছে স্বামী টের পায়নি। স্বামীর কথার কোন জবাব দেয় না তবিরন।
স্বামী আবার খোঁচা দেয়। ‘আয়না ফেলা, ঐ রূপ আর দেখতি হবি না।’ তবিরন এখন খুব একটা রাগ
করে না। আজ স্বামীর কথায় রক্ত গরম হয়; তেজের সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘রূপ তো আছেই, আফনের
অযতনে নষ্ট হইয়া যাইতেছে।’
‘চুপ
হারামী, কথা কবি না। মরতে পারিস না। হারামী মরেও না পথও সাফ হয় না।’
‘কী
কইলেন?’
‘শুনলিই
তো যা কইলাম’ রাগে ফেটে পড়ে স্বামী।
‘তা
তো শুনলাম। কাম-কাইজ করবেন না, ঘরের জিনিস বেচবেন,খাইবেন-দাইবেন আর হম্বিতম্বি করবেন
ক্যান। দাঁড়ান আজ জয় আসুক।’ তবিরন হাঁফাতে থাকে। ওর হাঁফানি নজরে পড়ে না রাগে অন্ধ
স্বামীর। দৌড়ে এসে চুলের মুঠি ধরে দুই গালে থাপ্পড় মেরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
‘আফনে
মারলেন আমারে!’
‘হ,
মারলাম; কী করতে পারিস কর।’
ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করে জয়। তবিরনের ইচ্ছা
টাকা জমলে একটা ওয়েল্ডিংয়ের দোকান দিবে। কিন্তু টাকা জমলেই হাত সাফাই হয়ে যায়। কেমন
করে টের পায় স্বামী বুঝতেই পারে না।
তবিরন
চুপ করে বসে থাকে। স্বামী গোসল সেরে সিঁথি কেটে আয়না ঘুরিয়ে দেখতে থাকে নিজেকে। বাইরে
নারী কণ্ঠ শোনা যায়। ‘হাসু ভাই, ও হাসু ভাই।’ কণ্ঠ শুনতেই উজ্জ্বল হয়ে হয়ে হাসেমের
মুখ। বের হয়ে যায়। তবিরন জাফরি টানা দরোজার ফাঁকে এক ঝলক দেখতে পায় মেয়েটিকে। ঝলমলে
মালা শাড়িতে সাজুগুঁজু করে এসেছে মেয়েটি।
স্বামী
বের হয়ে যাওয়ার পরে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে তবিরন। ভাবে, এই জীবন নিয়ে কী করবে ও; স্বামী
এখন পরনারীতে আসক্ত। ওর কী দোষ! একটাই তো জীবন! কেন এই জীবনে সুখ পেল না ও। এ প্রশ্নের
জবাব খুঁজে পায় না ও। এসব প্রশ্নের জবাব হয় না। কোন দোষ না থেকেও ওরা দোষী! এর দায়
পড়ে ভাগ্যের ওপর।
রাত
বারোটা বেজেছে অনেকক্ষণ। ছেলেমেয়েদুটো ঘুমিয়ে
পড়েছে। স্বামী আসেনি এখনও। থালায় ভাত ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে ও। ঘুম নেই চোখে। দরোজার ঝাঁপ
বন্ধ করেছে। ধাক্কা দেওয়ার শব্দে দরোজা খুলে অবাক হয় তবিরন। সেই মেয়েটি! নতুন পাজামা
পাঞ্জাবী পড়া ওর স্বামীর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ঝলমলে মালা শাড়িতে ঘোমটা দেওয়া। ওদের দেখে
চিৎকার করে ওঠে তবিরন,‘আফনে বিয়া করছেন।’
তবিরনের
চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় ছেলের। লাফ দিয়ে মায়ের
পাশে দাঁড়ায়।‘কী হইছে মা?’ তবিরন কথা বলে না। জয় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে খোলা দরোজার
দিকে তাকায়। দেখতে পায় তার বাবা আর বাবার নতুন বউকে। রাগ হয়ে যায় জয়ের। ঋজু কণ্ঠে বলে,
‘আমার মায়ের অপমান হইতে দিমু না। তুমি চইলা যাও,কইলাম।’ ছেলের এই রূপের সঙ্গে পরিচিত
ছিল না হাসেম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে থাকে। দরোজার ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে মাকে নিয়ে
শুইয়ে দেয় বিছানায়। পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয় মায়ের মাথায়। তবিরন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।