২য় পর্ব
(আগের অংশটি পড়ুন এই লিঙ্কে http://galpogucchho.blogspot.in/2017/03/blog-post.html)
সীতারামের দোকানের ছেলে ছোকরাদের মধ্যে সীতেশই সবচেয়ে বড়। বয়স প্রায় বছর চল্লিশেক, এখানকারই স্থানীয় ছেলে। অন্যদের মতো তারাও এখানে বহুদিনের বাসিন্দা। মাইল ছয়েক দূরে একটা কারখানায় মাঝারি মাপের কর্মী সে। সকালে স্কুটার নিয়ে বেরোয়, বিকেলে ফেরে। সকালে যাবার সময় মেয়েকে পিছনে বসিয়ে স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়। অবাঙ্গালী অধ্যূষিত অঞ্চল বলে এখানে বেশীর ভাগ ছেলেমেয়েরাই পড়ে ইংরাজি স্কুলে বা কনভেন্ট স্কুলে। বর্ণালী, সীতেশের মেয়ে, এখানে সেন্ট মেরী স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। বাঙ্গালী পাড়ার আরো কয়েকজন মেয়ে যায় ঐ স্কুলে পড়তে, ফেরার সময় বর্ণালী তাদের সঙ্গে স্কুলের বাসে ফেরে, কারণ সীতেশের শিফটের ডিউটী, ফেরার সময় এক এক দিন একেক রকম। এ পাড়ার থেকে ছেলেদেরও একটা স্কুল বাস আছে, যেটা যায় সেন্ট যোসেফ স্কুলে। তবে তাতে এখন আর এ পাড়ার ছেলে বিশেষ কেউ যায় না, প্রায় সকলেরই স্কুলের পড়া শেষ। বাটুর ভাই, রুদ্রদার ছেলে এমনিই দু চারজন এখনও যায় স্কুলে।
আজ সীতারামের দোকানে সীতেশের গলার জোর সবচেয়ে বেশী। মহালয়া হয়ে গেল ভোরবেলাতেই, সন্ধ্যাবেলায় মিটিং। শুভ, ঋষি, হীরালালেরা যে যার কর্মস্থলে চলে যাবে কাল সকালেই। বাইরে চাকরি করে তারা। শুভ ছাড়া প্রায় সকলেই আবার আসবে পুজোর সময় দু/চার দিনের ছুটিতে। এক শুভই দেওয়ালিতে পাটনা যায় বোনের কাছে, তাই আর আলাদা করে পুজোতে ছুটি নিয়ে আসতে পারে না, এখন এসে দু একদিন থেকে যায়। পুজোর আগে তাই কাজে, কর্মে বড় ছেলেদের খুব একটা দেখা যায় না, সীতেশকে একাই সামলাতে হয়। বাটু, দুলু, টুটুল, লাল্টু এরা আছে, কিন্তু এদের এখনও কেউ কেউ কলেজের পড়ুয়া ছেলে, বড়দের মত ঠিক গুছিয়ে কাজ করতে পারে না। তাই সীতেশকেই সামলাতে হয় সবদিক। এসব নিয়েই সীতেশ চীৎকার করছিলো, তার গলার জোর আজ সবচেয়ে বেশী।
তনু
একটু নড়ে চড়ে বলে উঠল— আজ কিসের মিটিং সীতুদা, শুনে তো অসুরের গর্জন মনে হচ্ছে...
‘
-তুই
থাম, তোরা থাকিস না, শেষে তো আমাকেই ধরবি সবাই—রেগে উঠল সীতু। -- এই, তোরা বাবা
থাম একটু, আগে
কথাগুলো সেরে নে, পরে গল্প করিস। এই,এই বাটু, কাগজটা দে ঋষিকে। ঋষি, পড়...সবাই চুপ
কর’ দু
হাত মুখের কাছে চোঙার মত করে বলল সীতু।
বাটুর
হাত থেকে ঋষি নেবার আগেই নাকের উপর চশমাটা ঠেলে দিয়ে কাগজটা পড়তে গেল শুভ, কিন্তু
হোঁচট খেল—এটা কোন বছরের কাগজ দিলে তুমি, সীতুদা?’
-কেন,
এই তো কালকেই তো নাম ধরে ধরে লিস্ট তৈরি করেছি...কই দেখি!’ হাত থেকে কাগজটা টেনে
নেয় সীতু। দেখে নিয়ে বলে—কেন, ঠিকই তো আছে। তোরা কিছু দেখিসও না, এই জন্যই তো
চীৎকার করছিলাম, নে পড়।‘
--কিন্তু
রণর নাম...বিড়বিড় করে শুভ।
--আরে,
ওর নামটাই প্রতিবার আগে লিখি...ও তো আছে রে...আমাদের মধ্যেই আছে। নে, পড়।‘
গলা
ভারি হয়ে আসে শুভর...। এবার
ঋষিই টেনে নেয় কাগজটা...একটানা পড়তে থাকে...ক্লাবের মেম্বারদের নাম, তাদের কাজের
দায়িত্ব,কত করে চাঁদা। প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট ধরে চলল লম্বা কাজের ফিরিস্তি। এক
ফাঁকে লাল্টু উঠে এলো বাপির কাছে—চা আনব বাপিদা, পয়সা দাও, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।‘
বাপির কাছ থেকে পয়সা নিয়ে দুলুকে ইশারা করল লাল্টু---তোর সাইকেলটা নিয়ে গেলাম,
দুলু বলে উঠল—বেশি পয়সা দিও না বাপিদা, মেরে নেবে।‘
-ভাগ
রে, তোর পয়সা নাকি,কিপটে কোথাকার! হেসে উঠল কেউ কেউ। মাথা ঝাঁকিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল লাল্টু।
তনু
প্রশ্ন করল সীতুকে—এবার চুল আনার ব্যবস্থা কি হবে, গতবার কম পড়েছিল।‘
--কেন,
যেমন হয়! দুলুরাই তো কলেজ থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসবে। কি রে, পারবি না—দুলুকে
প্রশ্ন করল
সীতু। দুলু কিছু বলছে না, কিন্তু মুখ দেখে মনে হচ্ছে রাজী নয়।
আবার
শুধলো সীতু---কি রে, পারবি না?
--দেবে
নাকি আমাকে? আবার কম পড়বে’ মাথা নীচু করে বলল দুলু।
-কেন,কম
আনবি কেন, পয়সা দিস তো। নেবার
সময় দেখে আনতে পারিস না!’
--পয়সা
দেব না কেন...জান না তো, কি বলে।‘
--কি
বলে? এবার শুভ প্রশ্ন করল।
--বলে
তোদের দুর্গার এত কেজি কেজি চুল চাই কেন রে? এখন তো বয়েজ কাটের যুগ, এই চুল নিয়ে
যা...স্টেপ কাট হয়ে যাবে। ব্যাটা হাড় পাজি!’ রাগত মুখ দুলুর।
হা
হা করে হেসে উঠল সবাই। লাল্টু চা নিয়ে এসে দেখল দুলু, বাপিরা হেসে এ তার গায়ে
গড়িয়ে পড়ছে। চায়ের কেটলি মাটিতে নামিয়ে বলল--- আর টুটুলের বাঁশ আনাটাও ফাইনাল করে
নাও তনুদা, সীতুদা। এবার আনতে পারবে না বলেছে। শেষে আমায় দোষ দিও না।‘
--কেন,
তোদের কিসের এতো গা গরম রে...এই সামান্য কাজটুকু করতে পারিস না—রেগে উঠল সীতু।
--রেগে
মেগে সীতু কিছু বলতে যাবে, দেখে দুলু, লাল্টূ, টুটুল বাপিরা এর তার গায়ে গড়িয়ে পড়ে
হাসতে লেগেছে। দেখাদেখি অন্যেরাও।
--কি
ব্যাপার রে, হাসছিস কেন? —মুখে হালকা হাসি এনে জিজ্ঞেস করল সীতু।
--টুটুল বলেছে, ব্যাটা আমি মুসলমান বলে আমায় শুধু বাঁশ দেবে, না? কেন, অন্য কাজ নেই নাকি?’
--টুটুল বলেছে, ব্যাটা আমি মুসলমান বলে আমায় শুধু বাঁশ দেবে, না? কেন, অন্য কাজ নেই নাকি?’
--যা,
পুরোহিতের পাশে বসে মন্ত্র পড় গে, তারপর বাড়ি গিয়ে বুড়ির ঠ্যাঙ্গানি খাস... হেসে
বলল শুভ। তনু হা হা করে হেসে উঠল। হীরালাল এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি, এবার হেসে
বললে—তুমি আমার বাড়িতে লুকিয়ে থাকবে, টুটুল—ওই নোয়াপাড়ার লোহাপট্টিতে কেউ খুঁজবে
না তোমাকে।‘
--তুমি
জান না তো বুড়িকে,মক্কা থেকে টেনে নিয়ে আসবে আমায়!—বললে টুটূল। বুড়ি মানে, ঠাকুমা। মিটিং-এ এলে দোষ নেই, কাজকর্মে দোষ নেই, কিন্তু পুজোর সময় বেচারাকে
মন্ডপে ঢুকতে দেবে না বুড়ি। ওরাও জোর করতে পারে না। কিন্তু তবু প্রতিবার টুটুল
আসে। মিটিং থেকে শুরু করে সব কাজে উপস্থিত
থাকে। হয়ত প্রবাস বলেই এটা সম্ভব, অন্য কোথাও হলে কি হত জানে না।
চা
খেয়ে মিটিং শেষ--- কে যেন বলল। আর অমনি সিনেমার দৃশ্যের মত ঝপ্ করে একটা দৃশ্য
মনে পড়ে গেল শুভর। রণ যখন ছিল, আজকের দিনে মিটিং এর পর সীতারামের দোকানে
টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে দু হাত মুখে নিয়ে বলত--- পুজোর পর আমাদের বাড়িতে সকলের বিজয়ার
নেমতন্ন...আর চা খেয়ে মিটিং শেষ!’
মানুষ
চলে যাবার পরও তার কিছু থাকে, যা মনে পড়ে নিত্যদিন, নিত্যকাজে। বাইরের অন্ধকারের
দিকে চেয়ে বসে রইল শুভ, রণকে তার মনে পড়ছিল, খুব বেশী মনে পড়ছিল।
(ক্রমশঃ)