মান্ডলার হান্টেড কাহিনী
৩
রাজবেশধারী
গাড়ি ছুটে চল ছিল। বেশ স্পীডেই যাচ্ছিলো। হাওয়া কেটে যাওয়ার সাঁইসাঁই শব্দ কানে এসে বাজছিল। সে শব্দের টানাপড়েন মাঝে সুব্রত তার হাতের কব্জি ঘুরিয়ে হাতঘড়ি দেখল, রাত তখন বারটার কাছাকাছি। রাস্তা জনপ্রাণী শূন্য। এমন কি রাত্রিকালীন একটা ট্রাকেরও দেখা নেই। স্তব্ধতার মাঝে কানে এসে বাজছে ঝিঁঝি পোকার রব, তার মাঝে বনের আঁধার চিরে এখানে ওখানে হঠাৎ হঠাৎ জ্বলছে নিভছে জোনাকি পোকার মিটমিট আলো। রাস্তার দু পাশে গাঢ় ছায়া পড়ে আছে--অন্ধকার সেখানে জটলা বেঁধে আছে। সুব্রত জানে না এ রাত অমাবস্যার রাত কি না !
সুব্রত জবলপুরে থাকে, এখানকার গান ক্যারেজ ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। চাকরীতে বেশ কিছু পয়সা আসলেও ওর বরাবরই বিজনেসের দিকে ঝোঁক বেশী। বাড়তি দুটো পয়সা যদি ঘরে আসে তবে ক্ষতিটাই বা কি ? কিছুদিন
একটা গাড়ি কিনে ভাড়ায় খাটাচ্ছিল। বেশ পয়সাও দিচ্ছিল সেটা। কিন্তু এতেও ঝকমারি কম নেই। গাড়ি আজ এখানে, কাল শহরের বাইরে। সব সময় খোঁজ খবরের মধ্যে থাকতেই হয়। বিশেষ করে গাড়ি বাইরের লং ডিসট্রান্সে গেলে মনে চিন্তা লেগেই থাকে। ড্রাইভার মাঝে মধ্যে ফোন করে, এই পেট্রল নিলাম, এই গাড়ি সারাতে হচ্ছে। সুব্রত দেখেছে দায়িত্বের সরকারী চাকরি ঘাড়ে নিয়ে গাড়ি চালানোর ব্যবসায় অনেক সমস্যা। অগত্যা সুযোগ বুঝে সে গাড়ির বিজনেস ছেড়ে মান্ডলার ঘুঘয়া ন্যাশনাল পার্কের কাছাকাছি একটা মুরগির ফার্ম কিনে বসল। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে মাসখানেক ধরে সেখানেই ফার্মের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকল। বর্তমানে অফিসের কাজ সেরে সুব্রত সপ্তাহে একদিনের জন্যে আসে মান্ডলার মুরগী ফার্ম তদারকিতে। আজও ড্রাইভার নিয়ে সুব্রত সেখানেই চলেছে।
--সার কিছু দেখছেন ? হঠাৎ
সুব্রতর ভাবনাকে চির খায়িয়ে ড্রাইভার ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল।
--কি ? সুব্রত
ড্রাইভারের দিকে তাকাল।
ড্রাইভার তেমনি ভীত গলায় বলে উঠলো, ওই যে একটা কালো ছায়া, অনেকক্ষণ
ধরে দেখছি কিন্তু কাছে আসছে না !
সামনের দিকে তাকাল সুব্রত।প্রথমটায় কিছুই তার নজরে আসছিলো না--বাইরের দানা বাঁধা অন্ধকার। তার চোখ একটু থিতিয়ে এলে ও দেখতে পেলো, সত্যি তো-একটা মানুষের ছায়া--এক জন পুরুষ মানুষ--যেন রাস্তার এক ধারে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার হলেও ঘন জঙ্গলের ফাঁক ফোঁকর যখন আসছে তখন চাঁদের সামান্য আলো চুয়িয়ে চুয়িয়ে রাস্তায় এসে নামছে। সেই আলোছায়ার খেলার মাঝে কালো ছায়াটা দাঁড়িয়ে। সব চে আশ্চর্য এই হচ্ছে যে গাড়িই সাঁ সাঁ করে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সামনের ছায়াটির দূরত্ব সেই একই রকম থেকে যাচ্ছে !
মান্ডলার ফসিল ন্যাশনাল পার্ক ঘুঘয়াতে। ঘুঘয়া একটা জাগার নাম। সে জাগার নামেই পার্ক হয়েছে। পার্কের আশপাশে বেশ কিছু আদিবাসীদের গ্রাম আছে। মান্ডলা এমনিতেই জঙ্গল, খাই, আর পাহাড়ের জাগা। তারই মাঝে মাঝে শহর গ্রাম গাঁয়ের পত্তন। জঙ্গল বহুল এ জাগার পুরানো ইতিহাসের মাঝে মুংলী সিরিয়ালের কাহিনীর ছোট্ট নায়ক মুংলী নাকি এখানকার ঘন জঙ্গলেরই একছত্র নায়ক ছিল। গন্তব্যস্থল একটু দূরে বটে, জবলপুর থেকে ১২৫ কিলো মিটার দূরত্বে হবে। মান্ডলা জেলা শহর পর্যন্ত যেতে হয় না। মান্ডলার শাহপুর মেইন রোড চলতে চলতে প্রায় শ কিলোমিটার পার করে কাঁচা রাস্তার দিকে বাঁক নিতে হয়। ঠিক এই বাঁকে রাস্তার এক ধারে লাগানো এক বিরাট সাইনবোর্ডে নির্দেশিত আছে ঘুঘয়া ন্যাশনাল পার্ক, দূরত্ব ২৫ কি.মি.। এই রাস্তা ধরে প্রায় বিশ কিলোমিটার গিয়ে পড়ে ভিজোলী গ্রাম, এই গ্রামের পাশ থেকে আবার একটা বাঁক নিয়ে বেশ সরু কাঁচা রাস্তা পার করে আধ কিলোমিটার দূরে গেলে পড়ে সুব্রতর মুর্গিফার্ম। ফার্মের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে এক চৌকিদার পরিবার থাকে। সারাদিন মুরগির চুইচাই শব্দ অবশ্য লেগে থাকে—তবে রাতের বেলায় অনেক সুনসান নির্জনতায় ঘেরা।
শুরুর কয়েকটা সপ্তাহে সুব্রত এখানে দিনের বেলাতেই এসেছে। ফার্মের কাজ সেরে রাত দশটার মধ্যে সে ফিরে গিয়েছিলো নিজের বাসস্থান, জবলপুরে।
কিন্তু আজ একটু অন্য রকম হয়ে গেলো। ফার্মে রাত কাটিয়ে ভোর বেলায় ফিরে আসার প্রোগ্রাম করে ঘর থেকে বেরতে প্রায় রাত নটা বেজে গেল। কথা মত রাত সাড়ে এগারটায় ফার্মে পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তার একদিকে গভীর খাই অন্য দিকে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চলে যাওয়া রাস্তা আর সব কিছুকে ঘিরে কোথাও ঘন কোথাও হালকা জঙ্গল। আর এসবের মধ্যে মধ্যে আছে মোড়, এক পাহাড় পেরিয়ে
অন্য পাহাড়ের উঠে বা
নেমে যাওয়ার
পিচ্ছিল বিপদজনক টার্ন। এসব বাধা কাটিয়ে গাড়ি এগিয়ে চল ছিল। তখনও
ঘুঘয়ার মোড় পার করেনি
ওরা। স্তব্ধতার মাঝে ড্রাইভার মুখ খুলল, সার, জানেন তো এই মান্ডলাতে প্রায় তিন হাজার বছর আগের কয়েটা দুর্গ আছে। এখন অবশ্য ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। তবু বাইরে থেকে অনেকে দেখতে আসে।
সুব্রত বলে--জানি, মান্ডলা টাউনের পাশে নর্মদা নদীর কিনারা ধরে কয়েকটা ফোর্ট আছে। লোকে রামনগরের প্রধান ফোর্টটাকেই জানে। সে তিন হাজার বছরেরও আগের কথা--গোন্ড রাজাদের তৈরি ছিল এ সব ফোর্ট। তদানীন্তন গোন্ড রাজা, যদুরাই নাকি রাম নগরের এ দুর্গ তৈরি করিয়ে ছিলেন। সে সব ষোল-সতের শতকের মাঝামাঝির কথা।
আবার বেশ সময় ধরে দুজনেই চুপচাপ বসে ছিল। শুধু গাড়ি রাস্তা কেটে ছুটে চলেছিল। এবার ঘুঘুয়া মোড় পার করে কাঁচা রাস্তা ধরেছে গাড়ি। এখানে চারদিকের স্তব্ধতা ভেঙে ঝিঁঝিঁপোকা ডেকে চলেছে সে সঙ্গে জ্বলে উঠছে নিভে যাচ্ছে জোনাকপোকার দল। আর ঠিক তখনই হঠাৎ সুব্রতকে ড্রাইভার ভয়ার্ত কণ্ঠ নিয়ে সেই দূরের ছায়া মূর্তিটাকে দেখাল—ছায়া রাস্তার পাশটাতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু গাড়ি পাঁচ সাত মিনিট চলার পরেও সেই ছায়ামূর্তির কাছে পৌঁছাতে পারলো না। সব মিলিয়ে সে সময়টায় ওদের মনে হল ওরা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে--কোন রহস্যময় জাগায় ভুল করে এসে পড়েছে।
--সার
! ড্রাইভারের চাপা গলা শোনা গেলো।
সুব্রত চমকে সামনের দিকে তাকাল, ও দেখল এবার গাড়ির স্পীডের সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্য ছায়া এগিয়ে আসছে। আর বেশী দূরে নেই—তখন এক শ হাতের মত দূরত্বে এসে গেছে--সুব্রত ও ড্রাইভার ভয় ও উৎকণ্ঠায় সে দিকেই দিকে তাকিয়ে আছে। কি ধরনের ভয় ?
কি ধরনের সংশয় তাদের জীবনে আসতে চলেছে ?
মুহূর্তের মাঝে এ প্রশ্নগুলি তাদের মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো।
আর কয়েক মুহূর্ত, ওর পাশেই ওরা এসে পড়লো বলে। তবে মাত্র একজন,
একজন লোক, তার হাতেও অস্ত্রশস্ত্র কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। অবশ্য পিস্তল বা ছুরি থাকলে তা নজরে নাও আসতে পারে। লোকটা এক হাত তুলে গাড়ি থামাবার ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে কি লোকটা কোন বিপদে পড়েছে ? জঙ্গলের জন্তুজানোয়ারের কিম্বা অন্য কোন কিছুর কবলে পড়েছে ? তাই ওদের কাছে লিফ্ট চাইছে ? ড্রাইভার
কি করবে ভেবে পাচ্ছে না--সে ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে লোকটা একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে--কিন্তু কি ব্যাপার ?
গাড়ি ওকে পার করে যেতে পারছে না কেন ?
এবার জোরে জোরে হাত নাড়ছে লোকটা, ওকে একেবারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও একটা মানুষের চেহারা আর মাঝে মাঝে তার মুখ চোখ যেন সামান্য আলোকিত হয়ে আবার অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই এই আলোছায়া অন্ধকারে স্পষ্ট ভাবে মানুষের চেহারা ছবি ফুটে ওঠার কথা না। গাড়ি চলছে, তার মধ্যে লোকটা এবার গাড়ির কাঁচের সামনে এসে ভেতর দিকে তাকাল। ড্রাইভার তার চেহারা মূর্তি দেখে নিজের অজান্তেই হবে চীৎকার করে উঠলো, কোন হো তুম ?
সুব্রতর মুখে কোন কথা নেই--লোকটার মুখটা গাড়ির কাঁচে যেন চিপে আছে, কেমন থেবড়ে লেপটে আছে ! ওর মুখ খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। ও কিছু একটা বলে চাইছে হবে, কিন্তু সুব্রত বা ড্রাইভের কানে তা ধরা পড়ছে না।
দরবাজা...খু... এমনি অস্পষ্ট কথা কিছু কানে আসছিল।
ব্যাস, ক্ষণকালের মধ্যে আবার নতুন চমক--লোকটার ছায়ামূর্তি আর ছায়া নেই--একটা লম্বা মত লোক--লোকটা যেন ইতিমধ্যে তার পাঁচ ছ ফুট দেহ থেকে সাত আট ফুট লম্বা হয়ে গেছে ! আর তার পোশাক ঈষৎ মলিন হলেও রয়েল, কোন রাজ ঘরানার পরিচ্ছদ, আবছা আলোতেও তা ঝলমলিয়ে উঠছে !
আর পারছিলো না। সুব্রত নিজেকে বাঁচাবার জন্যেই হবে, সে গায়ের জোরে হঠাৎ চীৎকার দিয়ে উঠলো, কে, কে তুমি ?
ঠিক এমনি সময় কি ভাবে যেন ড্রাইভারের পা গাড়ির এক্সেলটারে গিয়ে পড়লো। আর গাড়ি যেন এক লাফ দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুট দিলো। কিছুটা রাস্তা ছাড়িয়েই ছিল বিপদজনক মোড়, ভাগ্যই
ভাল বলতে হবে ড্রাইভার কোন মত গাড়িকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিল নতুবা সে দিন সেখানেই দুটো জীবনের অবসান ঘটত।
ভিজোলী গাঁয়ে রাত প্রায় সারে বারটায় গিয়ে ওরা পৌঁছল।
--কে ছিল সেই রাজবেশধারী লোকটা ? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর স্থানীয়রা কেউ দিতে পারেনি। কেউ কেউ বলেছে, আমরা শুনেছি সাব ! একজন বলেছিল, এক রোজ ম্যায় ভী উসকে সামনে আয়া গয়া থা। গাঁয়ের এক থুরথুরে শ বছরের ওপরের বুড়ো তাঁর শরীর কাঁপিয়ে বলেছিল--বেটা...উ ওই...কিলা থেকে...আসে--রামনগর কা...কিলা সে...আতা হায় !