) স্মৃতির পাতা থেকে)
নতুন স্কুলে সুখে-দুঃখে
বেশ দিন কাটছিল। কিন্তু
এই সুখ বেশি দিন
বিধাতার সহ্য হ’ল
না। বাবা ঐ রেলওয়ে
স্টেশন থেকে কলকাতায় বদলি
হয়ে গেলেন। মন খুব
খারাপ হয়ে গেল। বছরের
মাঝখানে বদলি,আমাদের স্কুল
নিয়ে কী হবে,তাই
নিয়ে বাবা-মা চিন্তায়
পড়লেন। হাওড়া স্টেশনের ঠিক
আগের স্টেশনে বাড়ি ভাড়া
নেওয়া হ’ল। তখন
ই.এম.ইউ. কোচ
চালু হয়নি। এখনকার মতো
অত ট্রেন চলাচলও করতো
না। মা তবু জেদ
ধরলেন, ছেলের একটা বছর
কিছুতেই নষ্ট করা ঠিক
হবে না। তার জন্য
এই বয়সে আমাকে অতগুলো
স্টেশন কাঠের গাড়িতে যাতায়াত
করতে দিতেও, তাঁর আপত্তি
ছিল না। তখন আমি
ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি।
কয়েকদিন
পর থেকেই,শুরু হ’ল আমার নতুন
স্কুল যাওয়া। বাড়ি থেকে
সকালে বেড়িয়ে প্রায় আধ
কিলোমিটার পথ হেঁটে স্টেশনে
এসে, সেখান থেকে সাড়ে
আটটা-ন’টা নাগাদ
ট্রেন ধরে সাতটা স্টেশন
দুরে যাওয়া। এর পরের
ট্রেনে গেলে, স্কুলে পৌঁছতে
অনেক দেরি হয়ে যেত।
নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে, মাইল
দু’-এক পথ হেঁটে
স্কুলে যাওয়া। আবার স্কুল
ছুটির পর, একইভাবে ঘরে
ফেরা। মা স্কুল ব্যাগে
টিফিন দিয়ে দিতেন, তবে
অধিকাংশ দিনই সে টিফিন,
স্কুল পর্যন্ত পৌঁছত না।
তার অনেক আগেই সেগুলো
আমার উদরস্থ হ’ত।
স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে,
সন্ধ্যা পার হয়ে যেত।
প্রায় রোজই দেখতাম মা
বা অন্য কেউ বাড়ির
কাছাকাছি লেভেল-ক্রসিং এর
কাছে, আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে
আছেন।
স্কুল
থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি
হওয়ার একমাত্র কারণ ট্রেনের
অভাব। স্কুল ছুটির পর
স্টেশনে এসে যে ট্রেনটা
পাওয়া যেত, সেটা বাড়ির
কাছের স্টেশনে দাঁড়াতো না।
তার পরের ট্রেন ছিল
অনেক পরে। ফলে বাড়ি
ফিরতে অনেক দেরি হ’ত। স্কুল ছুটির
মিনিট দশ-পনের আগে
স্কুল থেকে বেরতে পারলে,
আগের ট্রেনটা স্বচ্ছন্দে পাওয়া
যেত। কিন্তু সেই ট্রেনটা
কোনদিন আমার কপালে জোটেনি।
হয়তো বারমাস বাতাসা আর
জল একপাত্রে অন্যান্য দেবদেবীর
সাথে ভাগ করে খেয়ে
খেয়ে, সরস্বতীর কোপ আমার
ওপর পড়েছিল। ঝিকে মেরে
বৌকে শেখানোর মতো, ছেলেকে
কষ্ট দিয়ে বাবা-মা’কে শেখানো।
স্কুলে
প্রতিদিন শেষ পীরিয়ডটা ছিল
ভূগোলের ক্লাশ। ধুতি, সাদা
সার্ট, কেডস্ জুতো পরে
সাধুবাবু ভূগোল পড়াতে আসতেন।
পড়াতে না বলে, পড়া
ধরতে বললেও খুব অন্যায়
হবে না। তাঁর বাড়ি
ছিল স্কুলে আসার পথে,
স্কুলের কাছেই রাস্তার ঠিক
পাশে। ছোট্ট বাড়ি, অনেক
গাছপালা দিয়ে ঘেরা। তাঁর
জমি ও রাস্তার মাঝে,
নয়নজুলির মতো খাল জাতীয়।
জল না থাকলেও গাছপালার
পাতা আর আগাছায় ভরা।
একটা পাতলা, ইঞ্চি আষ্টেক
লম্বা, ইঞ্চি ছয়েক চওড়া,
ভূগোল বই আমাদের শ্রেণীতে
পড়ানো হ’ত। বেশ
মনে আছে আমার ভূগোল
বইটা “বেতার জগৎ” নামে
একটা পত্রিকার কভার পেজ
দিয়ে মলাট দেওয়া ছিল।
চারপাশে হলুদ রঙের মধ্যে
একটা সবুজ টিয়াপাখির ছবি।
প্রতিদিন শেষ পিরিওডে সাধুবাবু
ক্লাশে এসেই নিয়ম করে
পড়া ধরতেন। ভূগোলের প্রতি
একটা ভীতি আমার চিরকালই
ছিল, আজও আছে। ফলে
পড়া বলতে পারতাম না।
পড়া না পারলেই তিনি
কান ধরে দাঁড় করিয়ে
দিতেন। কয়েকদিন এইভাবে কাটার
পর, এই শাস্তি যথেষ্ট
নয় বুঝে, কান ধরে
বেঞ্চের ওপর দাঁড় করাতে
শুরু করলেন। তিনি অবশ্য
কথা দিয়েছিলেন যে, যেদিন
আমি পড়া বলতে পারবো,
সেদিনই আমাকে স্কুল ছুটির
আগে ছেড়ে দেবেন। তিনি
আমার ভাল চেয়েছিলেন, মঙ্গল
চেয়েছিলেন ঠিক কথা, তবে
শুধু পড়া ধরে আটকে
রেখে আমার মঙ্গল না
করে, পড়ালে এবং ভাল
করে বোঝাবার জন্য একটু
সময় ব্যয় করলে, অনেক
ছেলের মঙ্গল হতে পারতো।
সাধুবাবুর ক্লাশের পড়া কিন্তু
তৈরি করবার আন্তরিক চেষ্টা
করতাম। এরপর থেকে যেটুকু
সময় পড়বার জন্য পেতাম,
ভূগোল নিয়েই কাটাতাম। ফলে
উপকার হ’ল এই,
যে অন্যান্য বিষয়ের হাল
ভূগোলের মতোই হ’ল।
কিন্তু দুঃখের বিষয় ভূগোল
পড়াটা কোনদিনই দিতে পারলাম
না। কিন্তু সাধুবাবু
তাঁর একমাত্র কাজ, আমাদের ক্লাশে এসেই আমাকে
পড়া ধরা, আর পড়া
বলতে না পারলেই কান
ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড়
করিয়ে দেওয়া
অব্যাহত রাখলেন। শেষের দিকে সাধুবাবু
ক্লাশে ঢুকলে, পড়া ধরার
আগেই আমি নিজে থেকেই
কান ধরে বেঞ্চের ওপর
দাঁড়িয়ে, তাঁর কাজটা অনেক
কমিয়ে দিয়েছিলাম। অথচ ভূগোল
পড়া তৈরি করার জন্য,
আমার কিন্তু চেষ্টার কোন
ত্রুটি ছিল না।
গাব,
পেয়ারা, ফলসা ইত্যাদি গাছ
থেকে ফল পাড়ার সুযোগটাও
আমার একদম কমে গেছিল।
বিশেষ করে রবিবাবুর সাথে
রিক্সা করে স্কুলে যাওয়া
ছিল, এই সব কাজের
প্রধান অন্তরায়। একদিন, তখন
সবে নতুন বাসস্থান থেকে
যাতায়াত শুরু করেছি, গরম
কাল, রবিবাবুর সাথে রিক্সাভ্রমন তখনও
শুরু হয় নি। স্টেশন
থেকে হেঁটে স্কুল যাওয়ার
পথে, সাধুবাবুর বাড়ির কাছে
এসে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম,
সাধুবাবুর বাড়ির একটা আম
গাছ থেকে একটা লম্বা,
বেশ বড়, সামান্য লাল
রঙের আম, গাছ তলায়
একটু দুরে পড়ে আছে।
শুকনো পাতার মধ্যে চট্
করে আমটা চোখে পড়ছে
না। কিন্তু আমার শকুনের
দৃষ্টি সেটাকে ঠিক খুঁজে
বার করলো। সামনে পিছনে
অনেক ছাত্রছাত্রী স্কুলে যাচ্ছে।
এখন আমটা নিলে অনেককে
ভাগ দিতে হবে। তার
ওপর সাধুবাবুর কানে খবরটা
যাবেই। কাজেই স্থির করলাম
টিফিনের সময় এক ফাঁকে
এসে আমটা নিয়ে যাব।
ওটা এমন জায়গায় পড়ে
আছে যে, ওটার ওপর
কারো নজর পড়বে না।
টিফিনের সময় অকুস্থলে এসে
অনেক খুঁজেও আমটা সেই
জায়গায় আর খুঁজে পেলাম
ন। সম্ভবত শ্রীমতী সাধু
আমটা তুলে নিয়ে গেছেন।
একেই বোধহয় রাজযোটক বলে।
স্বামী-স্ত্রী দু’জনের
কেউ এতটুকু শান্তি আমাকে
দেন নি।
স্কুলের
আর এক বিভীষিকা ছিলেন
রবিবাবু। তাঁর নাম রবি
ঘোষ হলেও, বাস্তবে তিনি
চিত্রাভিনেতা রবি ঘোষের মতো
মজাদার, আমুদে মানুষ মোটেই
ছিলেন না। বরং সব
সময় অন্য মেরুতে বিচরণ
করতেই তিনি বেশি পছন্দ
করতেন। কলকাতার কোথায় যেন
তিনি থাকতেন। তিনিও আমার
সাথে একই ট্রেনে স্কুলে
যেতেন। তিনি ছিলেন ইংরাজী
শিক্ষক। সাধুবাবুর মতো তাঁরও
ক্লাশে এসে পড়া ধরার
একটা বদ রোগ ছিল।
তবে পড়া না পারলে, তাঁর আবার
শুধু কান ধরে বেঞ্চের
ওপর দাঁড় করানোর মতো
নিরামিষ পদ্ধতির ওপর গভীর
অনাস্থা ছিল। তাঁর পছন্দের
আমিষ ও কন্টিনেন্টাল মেনুতে
ছিল, রাক্ষুসে চিমটি, কানের
লতি নিয়ে খেলা করা,
জুলফি ধরে ওপর দিকে
টানা, ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ
পদ।
নির্দিষ্ট
স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমেই,
তিনি আমাকে পাকড়াও করতেন।
তারপর আমাকে সঙ্গে করে
রিক্সা স্ট্যান্ডে এসে, রিক্সা
করে স্কুলে নিয়ে যেতেন।
বাধ্য হয়ে আমি এক
এক দিন, এক এক
কামরায় উঠতে শুরু করলাম।
কিন্তু তিনি বোধহয় আগের
স্টেশন থেকেই আমার খোঁজে
ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা
করতেন। স্টেশনে ট্রেন থেকে
নেমে সটকে পড়ার আগেই,
তিনি চিৎকার করে অদ্ভুত
সুরে ডাকতেন—“সু-উ-উ-বী-ঈ-ঈ-র”।
তারপর রিক্সা স্ট্যান্ডে গিয়ে
আবার প্রায় সেই একই
সুরে—“রিক্সো-ও-ও-ও”। রিক্সাকে সাহেবরা
কী বলে জানিনা, তবে
তিনি রিক্সো বলতেন। আর
তারপর? তারপর ঐ প্রায়
দুই কিলোমিটার পথ তিনি
আমায় পাশে বসিয়ে, ইংরাজী
গ্রামার ধরতেন। তার সাথে
স্যালাড হিসাবে—নখ কাটিস
নি কেন? চুল আঁচড়াস
নি কেন? ভাল করে
দাঁত মাজিস নি কেন?
ইত্যাদি ইত্যাদি। অধিকাংশ দিনই
পড়া বলতে পারতাম না।
পারবো কী করে? যার
জীবনে সরস্বতী বিরূপ ও
সাধুবাবুর মতো একজন শিক্ষক
কপালে জুটেছে, সে আর
যাই পারুক, পড়া বলতে
পারবে না। কিন্তু এত
কিছুর পরেও আমার একটা
মহা সুবিধা ছিল এই, যে রবিবাবু
রিক্সোয় বসে চিমটি কাটতে,
জুলফি ধরে টানতে পারতেন
না, বা অপছন্দ করতেন।
কিন্তু স্কুলের ক্লাশে আর
নতুন করে পড়া ধরতেন
না। ফলে আর সকলে
যখন স্কুলের ক্লাশে রবিবাবুর
আমিষ খাবার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, আমি
তখন প্রতিদিন অনাহারে থেকে
নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতাম।
সেইসব কড়া শাসন, হয়তো বা কিছু অন্যায় শাসন সত্ত্বেও, আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তাঁদের ভুলতে পারলাম কই? ভুলতে পারিনি কারণ সেদিন না বুঝলেও, সেদিন চরম
রাগ ও কষ্ট হলেও, আজ পরিণত বয়সে এসে বুঝি, সেদিনের সেই শাসন ন্যায় বা অন্যায় যাই হোক না কেন, তার পিছনে একটা মঙ্গল কামনা ছিল, একটা
আন্তরিক ভালোবাসার টান অবশ্যই ছিল। আজ নিশ্চই তাঁরা আর ইহ জগতে নেই, কিন্তু তবু আজ তাঁদের অন্তরের শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাতেই এই স্মৃতি
চরণা।