গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৫

প্রদীপ ভূষণ রায়

   
  বদল

         নিস্তব্ধ রাতের আকাশটাকে বড়ই কাছের মনে হয় দিপ্তেশের । দূরে দূরে ছটফট করতে থাকা   তারাগুলো যেন ওর মতই অস্থির । কোথায় যেন একটা মিল আছে । সব তারাগুলোই যেন ওর মত একাকিত্বের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে পরস্পরকে কাছে আসার ইঙ্গিত জানাচ্ছে । চোখের সামনে দিয়ে পালিয়ে যাওয়া সময় বড় দ্রুত বদলে দিয়ে যাচ্ছে চারপাশ । তাল মেলানো যাচ্ছে না । দিপ্তেশ ভেবেই পায় না নিজেকে মেলাবে কীভাবে । সবার কাছেই ও বড় বেশি ব্যাকডেটেড । সুব্রততো বলেই ফেলল ,‘তোর মত আনস্মার্ট ক্যালাস ক্যাবলাকান্ত আমি জীবনে দেখিনি । রিয়ারা তোর কান্ড দেখে মুখ টিপে হাসছিল । এক ঢোক মুখে দিয়েই ছুটলি বাথরুমে !’ কেমন করে বোঝাবে ওদের ,এসব ওর ভালো লাগে না । ড্রিংক্সের গন্ধে ওর গা গুলিয়ে ওঠে । চোখের সামনে ভেসে ওঠে কয়েকটা ছবি । বড় কষ্টের বড় যন্ত্রণার সে সব । কেমন করে ভুলবে চোখের সামনের পরিচিত মানুষটা বদলে গিয়ে হয়ে যায় কত দূরের অচেনা অজানা । অথচ অন্যসময় সেই মানুষটা একদম অন্যরকম । একই মানুষের দুটো রূপ । ছোটবেলার সেই রাতগুলো যেন বিভীষিকার । উন্মত্ত নেশাগ্রস্ত বাবার তখন আর কোনও হুঁশ নেই । অশ্রাব্য গালিগালাজ ভাঙ্গচুর মা’র গায়েও হাত দিতেও পিছপা নন । আলমারির পেছনে দিপ্তেশ তখন ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে । অতকিছু বোঝবার বয়সও ছিল না । শুধু ঠাকুরকে বারবার ডাকত ,‘ তাড়াতাড়ি রাতটা পার করে দাও । তাহলে বাবা আবার আগের মত হয়ে যাবে ।’ তখন বুঝত না এখন বুঝতে পারে ,বাবা সন্দেহ করত মা’কে । বাবা সোনাকাকুর নামে উলটোপালটা বলে যেত । মা’ও রুখে দাঁড়াত । দুজনের ঝগড়া চরমে উঠে হাতাহাতিতে পৌঁছে যেত । ভেতর থেকে থাকতে না পেরে ছুটে আসত বড়পিসি । বড়পিসিকে ওরা দুজনেই খুব মানতো । তাই বড়পিসিকে দেখে ঝগড়া থামালেও গজরাত দুজনেই । দিপ্তেশকে নিয়ে বড়পিসি চলে যেত । বেশির ভাগ রাতই কেটে যেত পিসির নরম বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে । কত নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয় ।
         এখন বুঝতে পারে পিসি যদি না থাকত তাহলে এই সংসারটা কবেই অতলে তলিয়ে যেত । সংসারটাকে বাঁচাবার জন্য নিজের সমস্ত সুখ আহ্লাদকে দূরে সরিয়ে রেখে অবিবাহিত থেকে জীবনটা কাটিয়ে দিল বড়পিসি । করবেই বা কে ! মাথার ওপরে তো কেউ ছিল না । দায়দায়িত্ব যে ছিল অনেক বেশি । পিতৃমাতৃহীন ছোট ছোট ভাইবোনেদের মানুষ করা তাদের সংসারী করা । হাসিমুখেই সবকিছু করে গেছেন । রাশভারী ব্যক্তিত্বের আড়ালে স্নেহশীল অন্তরের পরিচয়তো ছোট থেকেই পেয়ে আসছে এখন অনুভব করতে পারে একটা চাপা কষ্ট কত সযতনে বুকের মধ্যে চেপে রেখেছে বড়পিসি । কমল জ্যেঠু প্রায়দিনই বিকেলে একবার করে আসেন । পিসি চা করে দেয় । বৈঠকখানার ঘরে বসে দুজনে চা খেতে খেতে গল্প করেন । পরপর কয়েকদিন না এলেই পিসি ব্যস্ত হয়ে পড়ে । বারবার দিপ্তেশকে তাগাদা দিতে থাকে । ‘ যা না বাবা একবার কমলদার খোঁজ নিয়ে আয় ।’ ছোট থেকেই দিপ্তেশ লক্ষ্য করত কমল জ্যেঠু এলেই পিসির চোখ মুখের চেহারাটা বদলে যেত । একটা অদ্ভুত খুশির ছোঁয়া পিসির আচরণে প্রকট হয়ে উঠত । না এলেই অভিমান আর উতকন্ঠায় ছটফট করে । একটা অজানা ভয় আর আশঙ্কায় নিষ্পেষিত হয়ে বারবার ছুটে আসে দিপ্তেশের কাছে । মনের মধ্যে প্রশ্ন একটাই , মানুষটার শরীর খারাপ হয়নি তো । অনুযোগ করেন ‘ বয়স হয়েছে একদম শরীরের যত্ন নেয় না । কতবার বলেছি ডাক্তারকে দিয়ে প্রেসারটা মাঝে মাঝে চেক করিয়ে নিতে , কোনও কথাই কানে তোলে না । ঠিকমত ওষুধপত্র খায় কিনা কে জানে ! সকাল সন্ধে সবসময় ক্লাব নিয়েই ব্যস্ত । ছোট থেকেই
                                                (২)

তো দেখছি আজ এখানে খেলা কাল ওখানে খেলা , কে খেলবে কে খেলবে না , কোন প্লেয়ার আসেনি সব মাথায় নিয়ে দৌড়চ্ছে । রিটায়ারমেন্টের পর ব্যস্ততা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে । এখন আবার তার সঙ্গে জুটেছে সমাজসেবা । কোন মেয়ের টাকার জন্য বিয়ে হচ্ছে না চাঁদা তোলো । কার চিকিৎসার টাকা নেই কার রক্ত দরকার , এ বয়সে কি এত দৌড়ঝাঁপ শরীর নিতে পারে !’ দিপ্তেশ কোনও উত্তর দেয় না । মনে মনে ভাবে কমল জ্যেঠুর মত কিছু মানুষ আছে বলেই মানব সমাজে মনুষ্যত্ব এখনও কিছুটা টিঁকে আছে । পরদিন যখন কমল জ্যেঠু এসে হাজির হন তখন বড়পিসির সারা শরীরে যেন সদ্য কিশোরীর উচ্ছলতা ।
          আচমকাই একদিন ওদের দুজনের কথোপকথন শুনে ফেলেছিল দিপ্তেশ । কৌতুহলে পা-দুটো আটকে গিয়েছিল বারান্দার প্যাসেজে । বুঝতে পেরেছিল কমল জ্যেঠুও কেন বিয়ে করেননি । অবাক হয়ে গিয়েছিল ওদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসে । কমলজ্যেঠু তখনও বলে চলেছেন ,          ‘ নিজেকে অপরাধী ভাবছো কেন ? তুমি তো  কোনও অপরাধ করোনি । তুমি যা করেছো তা ক’টা মানুষ করতে পারে । তোমার এমন নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ আমার বুক ভরিয়ে দিয়েছে । তোমাকে ভালোবেসে আমি গর্বিত । তোমার ভালোবাসা আমার অহঙ্কার । এই পৃথিবীতে কেঊ একজন আমার কথা ভাবছে এটা যে কতখানি তৃপ্তির তা বলে বোঝাতে পারবো না ।
- আমার না হয় উপায় ছিল না । তোমার তো তা নয় কমলদা । সন্ন্যাসীর মত জীবনটা কাটিয়ে দিলে এটা কি ঠিক ?
- ঠিক বেঠিক আমি বুঝি না । তোমার জায়গায় যে আমি কাউকে বসাতে পারি না । বিয়ে করলে আরেকজনের প্রতি অবিচার করা হত । নিজের বিবেকের কাছে  আমার উত্তর দেওয়ার জায়গাও থাকত না । এই জীবনটা নাহয় এইভাবেই কেটে গেল । এইভাবে পাশাপাশি পথ চলাটাও তো কম আনন্দের নয় ।  
       দিপ্তেশ অনুভব করে বদলে যাওয়া সময় বদল করে দিয়ে যাচ্ছে মানুষের বোধ সত্ত্বা । তাই বোধহয় এখনকার জেনারেশন বড় বেশি অস্থির অনেক বেশি স্বার্থপর । সেইজন্যই দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট থাকতেই তারা বেশি পছন্দ করে । হয়তো সেই কারণেই বিবাহ নয় লিভ-টুগেদার ব্যাবস্থাটাই ক্রমশ মানুষের মধ্যে স্থান করে নিচ্ছে । অসহায় বৃদ্ধ মা বাবার স্থান হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে ।
      মা যেদিন দিপ্তেশের কথা একটুও না ভেবে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল সেদিন থেকেই একটা রাগ আক্রোশ ঘৃণা জন্মে গেছে মায়ের ওপর । প্রথম প্রথম কাঁদত খুব । তারপর সেটা জেদে পরিণত হল । বাড়িশুদ্ধু সকলেই ব্যতিব্যস্ত । একমাত্র বাবা চুপচাপ । কারও সাথেই বিশেষ কথা বলে না । একটা অদ্ভুত শূন্যতা দুটো চোখে । এক ভোরবেলায় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে থাকা বাবার মৃতদেহটা পালটে দিয়ে গেল ওর সমস্ত শৈশবটাকে । মায়ের ওপর জমে থাকা ঘেন্নাটা রাগ হয়ে নরম বুকটাকে কুরে কুরে খেত । যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একদিন আড়াল থেকে ঢিল মেরে সোনাকাকুর মাথা ফাটিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করল । সেদিন মনে হয়েছিল সোনাকাকুর জন্যই ও বাবা মা’র সঙ্গ থেকে বঞ্চিত । বড় হয়ে যেদিন জানতে পারল ওর বাবা মা পরস্পরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল , তখন থেকেই একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে ওকে অস্থির করে তোলে ,ভালোবাসাটা তাহলে কেমন ছিল ? এখনও জানতে ইচ্ছে করে সোনাকাকুর সঙ্গে মা ভালো আছে তো ? সুখী কি ?  রোমা যদি সত্যি বলে থাকে তাহলে তো উলটো ছবিটাই দেখছে এখন । ক্লাব পার্টি হুল্লোড় করে মা যখন অনেকরাতে বাড়ি ফেরে
                                              (৩)

তখন নাকি নিজের পায়ে ভর দিয়ে হাঁটার শক্তিটুকুও থাকে না । ড্রাইভার অতনু ধরে ধরে মা’কে ঘরে পৌঁছে দেয় । লাইব্রেরীরুমে তখন পরদিন হাইকোর্টের কেসটার সওয়ালের জন্য সোনাকাকু গভীর মনোযোগে আইনের সুক্ষ্য প্যাঁচগুলো নিয়ে ব্যস্ত । ইংলিশ মিডিয়মে পড়া রোমা এ সবেতেই অভ্যস্ত ।
       মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেও রোমাকে নিজের বোন বলে ভাবতে কোনওদিনই দ্বিধা করেনি দিপ্তেশ । যতই হোক একই মায়ের পেটের বোন তো । বাবা আলাদা তো কি হয়েছে । তবু শাসন  করতে সাহস পায় না । কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে মিনি স্কার্ট পরে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে যেভাবে বাইকে চেপে ঘুরে বেড়ায় , রাগে দিপ্তেশের ইচ্ছে হয় একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিতে । দু-একবার শান্তভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল । রোমা ঠান্ডা চোখে সটান বলে দিয়েছিল ,‘ দ্যাখ সম্পর্কে দাদা বলে আমার ওপর দাদাগিরি ফলাবার চেষ্টা করিস না ।’ ওর কথা বলার ভঙ্গিমায় বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠেছিল , একটা কথাও আর বলতে পারেনি । একটা দমবন্ধ করা কষ্টকে বুকে চেপে চুপচাপ ফিরে এসেছিল ।
      রোমার জন্মদিনে সকালবেলায় ওর মোবাইলে বার্থডে উইশ করার পর দুপুরে একবার দেখা করতে চেয়েছিল পার্কস্ট্রিটে । ইচ্ছে ছিল টিউশনির টাকায় কেনা শাড়িটা উপহার দিয়ে একটা ভালো রেস্তরাঁয় বোনকে লাঞ্চ করায় । সময় দিতে পারেনি রোমা । ওর নাকি দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখার প্ল্যান । তারপর বাড়িতে সন্ধেবেলা জন্মদিনের পার্টি । দিপ্তেশকে বাড়িতে আসার জন্য বলেনি । কেননা রোমা জানে বললেও দিপ্তেশ আসবে না । অনেক বলার পর পাঁচমিনিটের জন্য সময় দিয়েছিল দেখা করার । বাইপাসের ধারে নতুন গড়ে ওঠা বিগবাজার মাল্টিপ্লেক্সের করিডোরে । দিপ্তেশ হাতে করে শাড়িটা দেবার পর হেসে উঠেছিল রোমা । শাড়িটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলেছিল ‘ এটা তুই তোর বৌয়ের জন্য তুলে রাখ । এইসব ব্যাকডেটেড শাড়িটারি আমার চলে না ।’ ওর কথাগুলো যেন বুকের মধ্যে জ্বালা ধরিয়ে দেয় । বিস্ময়ে নড়তে পারে না ,পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে । হাতের মধ্যে ধরে থাকা শাড়িটা নাড়িয়ে দিয়ে যায় সমস্ত চেতনাকে । নাই বা পরল শাড়িটা , ফিরিয়ে দেবার দরকার ছিল কি ! একটুও বুঝলো না দিপ্তেশের সেন্টিমেন্টটা । অভিমানে চোখদুটো জলে ভিজে ওঠে । 
        ছোট ছোট বুদবুদের আকারে মনের মধ্যে উঠতে থাকা প্রশ্নগুলো বারবার ধাক্কা দিয়ে চলে । সম্পর্কটা কী ? কেন ? ভালোলাগার রঙ মাখানো ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে পালটে ফেলাই কি আজকের সময়ের একমাত্র কাজ ! নিজের সুখ নিজের স্বার্থ কেরিয়ার নিজের উচ্চাশাই কেবল বড় হয়ে ওঠে । বদলে যাওয়া চিন্তা ভাবনায় স্থান পায় না ছোট ছোট অনুভূতি ব্যাথা বেদনার কথা । হয়তো সেই জন্যই সুভাষকে ফিরে যেতে হয় বিদেশে আর ওর বৃদ্ধা মা’র স্থান হয় ওল্ড এজ হোমে । স্বামীহারা বৃদ্ধার নিঃসঙ্গতা বোঝার মত মানসিকতা এদের নেই । এরা ভাবে মাঝে মাঝে ফোনে খবর নেওয়া আর খরচের টাকা পাঠালেই সব কর্তব্য শেষ । বোঝে না পুত্র পুত্রবধু নাতি নাতনিকে নিয়ে কাটানো সময়গুলোর মূল্য কত । দিপ্তেশ এই জেনারেশনের ছেলে হলেও অন্যরকম । গুরুজনদের এখনও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে । সুব্রত রিয়ারা হাই আঙ্কেল হাই মেসো বলেই খালাস । পৃথিবীটাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাও একদম আলাদা । শরীর মনের শুচিতাকে ওরা পাত্তাই দিতে চায় না । শুচিতা শব্দটাই বোধহয় ওদের অভিধানে নেই । রিয়ার উগ্রতা দিপ্তেশের পছন্দ নয় তবুও কী এক অমোঘ আকর্ষণে দিপ্তেশ বারবার এগিয়ে যায় রিয়ার দিকে । রিয়া নির্লিপ্ত , ছোটখাটো কোনও ঢেউও ওঠে না ওর মনের মধ্যে ।
                                               (৪)

          দিপ্তেশকে বোঝে একমাত্র বড়পিসি । ওর মনের সব অনুভূতি সব অস্থিরতা কোনও কিছুই তার চোখ এড়ায় না । এতবড় বাড়িটার নিঃসীম শূন্যতা দিপ্তেশের মত পিসিকেও ছুঁয়ে থাকে । সময় যেন আর কাটতেই চায় না । যতদিন স্কুলের চাকরিটা ছিল পিসির সময়টা কেটে যেত বেশ । স্কুলের খাতা , বোর্ডের খাতা , স্কুলের মিটিং , ডি আই অফিসে যাওয়া ফুরসত ছিল না একদম । সময় যেন গড়গড়িয়ে গড়িয়ে চলত । হেডমিস্ট্রেস হিসেবে দায়ীত্ব তো কম নয় । রিটায়ারমেন্টের পর সময়টা যেন গড়ের মাঠের মত গড়াগড়ি খাচ্ছে । এতবড় বাড়িতে দু’জন মাত্র লোক । কাজ আর কতটুকু । রান্নাবান্নাতেও কতটুকুই বা সময় যায় । কেবল টিভির সিরিয়ালগুলোই তাই মাঝে মাঝে এখন সঙ্গ দেয় পিসিকে । কখনও সখনও পাড়ার লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পালটে আনা । সময় সময় কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে কাছাকাছি নতুন গজিয়ে ওঠা শপিং মলে গিয়ে ডিসকাউন্টে সাংসারিক জিনিষপত্র কেনা । দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর নিজের হাতে নানান রকমের ডালের বড়ি দেওয়া । এইভাবেই দিনগুলো পার করে দেয় পিসি । দিপ্তেশ পিসিকে কমপিউটার চালানো শিখিয়ে দিয়েছে । পিসি নিজে নিজেই এখন ইন্টারনেট সার্ফ করতে পারে । রাতের দিকে আমেরিকায় থাকা ছোটকাকা বা মুম্বাইতে থাকা ছোটপিসির সঙ্গে চ্যাট করতে বসে । দিপ্তেশ একটা ওয়েবক্যামও লাগিয়ে নিয়েছে কমপিউটারে । ফলে ওরাও দিপ্তেশ আর বড়পিসিকে দেখতে পায় । আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও মুখোমুখি কথা বলা । মাঝে মাঝে যখন ছোটকাকা বা ছোটপিসিরা এখানে আসে সেই ক’টা দিন খুব হই হই করেই কেটে যায় । মাঝে মাঝে তৃপ্তির স্বাদ শুধু এইটুকুই বাদবাকি সবটাই একটা বিরাট শূন্যতা । পিসি দিপ্তেশকে বলে তুই চাকরি পেলেই বিয়ে দিয়ে দেব । যদি কাউকে পছন্দ হয় তো আগেভাগে বলে রাখিস । পিসি দিপ্তেশের শুধু নয় সকলেরই পছন্দ অপছন্দের মর্যাদা দেয় । দিপ্তেশ শুনে যায় শুধু কোনও উত্তর দেয় না । উত্তর দেওয়ারই বা কি আছে । রিয়াকে ভালো লাগলেও রিয়া তো দিপ্তেশকে চায় না । আদৌ যে কী চায় সেটাই ঠিকমত বুঝে উঠতে পারে না দিপ্তেশ ।
       সেবারের দীঘার অভিজ্ঞতা দিপ্তেশকে বড় ধাক্কা দিয়ে ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেছে । উইক এন্ডের ছুটি কাটানোর জন্য দীঘায় গিয়েছিল ওরা । ছ’জন ছেলে আর চারজন মেয়ে । উঠেছিল নিউ দীঘায় হোটেল সি ভিউতে । ওদের উদ্দামতায় অবাক হয়ে গিয়েছিল দিপ্তেশ । স্নান করার আগেই ঝাউবনে বোতল খুলে বসেছিল ওরা । রিয়া ,শিরিন,পৃথা , শর্মিষ্ঠাও বাদ যায়নি । কয়েক পেগ পেটে যাওয়ার পরেই আর নিজেদের ঠিক রাখতে পারেনি । শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরেই সুব্রত ,রিয়াজ ,মনিময়দের সঙ্গে জলে নেমে পড়েছিল । চারপাশে লোকজন, কারও দিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই । ওরা তখন নিজেদের নিয়েই মত্ত ।  টোট্যালি ডেসপ্যারেট । কে কী ভাবলো কিচ্ছু এসে যায় না । দিপ্তেশ বেশ কিছুক্ষণ একাই বসেছিল বিচে । ওদের সঙ্গে ড্রিংকও করেনি জলেও নামেনি । ওদের অর্ধনগ্ন যৌবনের উচ্ছলতা ওকে স্পর্শও করেনি শুধু লজ্জায় ঢেকে দিয়েছিল । ধীরে ধীরে হোটেলে ফিরে এসেছিল মাথা নিচু করে । ওরা পিনচ্‌ করছিল , বিদ্রুপ করছিল । দিপ্তেশ কোনও উত্তর দেয়নি । সারাক্ষণ শুধু ঈশ্বরকে ডেকে গেছে যেন কোনওরকম বিপদ না হয় ।
      দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছিল দিপ্তেশ । হঠাৎই জানলা দিয়ে দেখতে পায় রিয়া একা একা হোটেল থেকে বেরোচ্ছে । তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে এসে কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞাসা করতেই রিয়া চটে যায় । অদ্ভুতভাবে বলে ওঠে ‘ এত কৌতুহল কেন ? কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি সব তোমায় বলে যেতে হবে ! বন্ধু ,বন্ধুর মতই থাকো কোনও অধিকার ফলানোর চেষ্টা কোরো
                                            (৫)

না ।’ কোনও কথাই আর বলতে পারেনি দিপ্তেশ । চুপচাপ নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়েছিল বিছানায় । কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল বুঝতেই পারেনি । ঘুম যখন ভাঙ্গলো দেখলো রোদ পড়ে গেছে । ঘরে কাউকেই দেখতে পায় না শুধু শুভ্র তখনও ঘুমোচ্ছে । রিয়াদের রুমেও কেউ নেই । পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বিচের দিকে , কাউকেই নজরে পড়ে না । ঘুরতে ঘুরতে ঝাউবনে ঢোকে । এদিক সেদিক ঘোরার পরে হঠাৎই একটা ঝাউগাছের আড়ালে রিয়া আর সুব্রতকে দেখতে পায় । দুজনের শরীরে একটাও সুতোর আড়াল নেই । সমুদ্রের দিক থেকে বয়ে আসা মিষ্টি হাওয়ায় এক অজানা নেশায় বুঁদ হয়ে পরস্পরকে নিষ্পেষিত করে একে অন্যের শরীরে মিশে যেতে চাইছে । দিপ্তেশের পা দুটো তখন বালির মধ্যে আটকে গেছে । দিপ্তেশ স্তম্ভিত ।
    মোবাইলের রিংটোনে ভাবনাটা ছিঁড়ে যায় । তাকিয়ে দেখে রোমার ফোন । একটু অবাকও হয় । কোনওদিন নিজে থেকে ফোন না করলেও নাম্বারটা লোড করে রেখে দিয়েছিল ! রিসিভ বাটন অন করে হ্যালো বলতেই ওধার থেকে রোমার উদ্বিগ্ন গলা ভেসে আসে ‘ দাদা বাবা যেন কেমন করছে । বুকের মধ্যে ভীষণ যন্ত্রণা । মা’ও বাড়িতে নেই ফোনেতেও যোগাযোগ করতে পারছি না । আমি একা কী করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না । তুই প্লিজ তাড়াতাড়ি চলে আয় ।’ দিপ্তেশের সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠল । কোনওদিন রোমাদের বাড়ি যায়নি । আজকে যেতেই হবে । রোমার আকুল ডাক অগ্রাহ্য করে কি করে । কোনওরকমে বলে ওঠে , ‘ ঘাবড়াস না ,আমি এক্ষুনি আসছি ।’
     আকাশের দিকে তাকায় দিপ্তেশ । ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছে আকাশটা হাসছে ।