গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৫

স্বপন দেব

 হোমওয়ার্ক 

ইউ এস এ থেকে মহুল আর অরিত্র যখন দেশে ফিরলো, অরিভের বয়েস তখন মাত্র ছয়। অ্যামেরিকায় জন্মেছে বলে জন্মসূত্রে অরিভ   ইউ এস এ এর নাগরিক। তবে আঠারো বছর বয়েস হলে অরিভ ই ঠিক করবে ও কোন দেশের নাগরিকত্ব নেবে। তবে মহুল আর অরিত্র দুজনের ই ইচ্ছে অরিভ ইউ এস এ তেই সেটল করুক। আর সেইজন্যেই ওকে ছোটো থেকেই তৈরি করছে মহুল আর অরিত্র। অরিভের বয়েস এখন এগারো। মহুল পেশায় সফটওয়্যার  ইঞ্জিনীয়ার আর অরিত্র ম্যানেজমেন্টে আছে। দেশে ফিরে কোলকাতায় ওদের চাকরি মেলেনি। জুটেছে গুজরাটের গান্ধীনগরে।  আপাতত দুজনেই আছে অরিভ কে নিয়ে। অরিভ কে গান্ধীনগরের  একটা ইন্ট্যারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। অরিভের গরমের ছুটি শেষ হতে আর মাত্র তেরোদিন বাকি। সারা ছুটিটা গুজরাটে    কাটিয়েকাল ওরা যাবে কোলকাতায়। মহুলের মা আর অরিত্রের মাও থাকে কোলকাতায়। সেখানে দিন চারেক থেকে ওরা যাবে লেহ। ফিরবে ফ্লাইটে। গত তিন মাসে কাজের চাপে মহুল একটা দিনও ছুটি নিতে পারেনি। অরিভ গরমের ছুটিটা বন্ধুদের সাথেই খেলে কাটিয়েছে। বেড়াতে যাবার অন্যতম আকর্ষণ প্যাকিং। মহুল খুব উৎসাহ ভরে তিনজনের জামা কাপড়, ব্যাগে ভরল। নানারকম ড্রাই ফুডস এর প্যাকেট ভরা হলযার অনেকগুলোই ও জানে পরে  গুজরাটে ফিরে এসে খোলা হবে বা ফেলে দেওয়া হবে। তবু সঙ্গে  খাবার-দাবার না নিলে ইন্সিকিউর লাগে। কাজু, চিপ্স, টুনা সব  ঢুকলো। ব্যাস এবার বাকি রইল শুধু পেপারগুলো। এই  সাইডপকেটেই ঢুকে যাবে।” “পেপার!” - শুনেই অরিভ আঁতকে    উঠেছে। তোমরা ওখানে গিয়ে অফিসের কাজ করবে !  আমি যাব না  তাহলে  মহুল  ওকে আশ্বস্ত করল -  আমাদের পেপার না - তোমার সামার হলিডেজ এর এ্যাসাইনমেণ্ট শীটগুলো। হোমওয়ার্ক  শেষ করতে হবে না!” “সে তো এসেও করা যায়” – অরিভ  প্রতিবাদ করল। মহুল বলল – “যায় কিন্তু এসে অত সময় পাওয়া  যাবে না।  প্রোজেক্টটাও তো করতে হবে।শীটগুলো বার করো।  কোলকাতাতে বাবা যখন কাজে যাবে তখন আমরা দুজন মিলে  করে ফেলব। বেশীরভাগই তো ক্রসওয়ার্ড, ছবি আঁকা এইসব দেখ  মজা হবে।
অরিভ ব্যাজার মুখ করে এ্যাসাইনমেণ্ট শীট বার করতে গেল।কিন্তু   অনেক খুঁজেও কিছুতেই এই বছরের এ্যাসাইনমেণ্ট শীটগুলো পাওয়া গেল না। গত বছরের সমস্ত শীট, অরিত্রর যাবতীয় পুরোনো  অফিসের  পেপারস, মহুলের অফিসের মীটিংএর মিনিটস সব  পাওয়া গেল শুধু দরকারি শীটদের দেখা নেই। টেন্স হয়ে গেলেই  মহুল চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। আমি তো এইখানেই রেখেছিলাম  এই ড্রয়ারে কোথায় গেল!” – দাঁত কিড়মিড় করতে করতে মহুল ড্রয়ারের ভেতর থেকে, পড়ার টেবিল থেকে,  বুককেসের ভেতর থেকে দিস্তা দিস্তা আবর্জনা বার করে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে ঘরের চারদিকে।  অরিভ ক্যাচ প্র্যাক্টিস করতে করতে বলল   – “তুমি রাখার পর ম্যাম আবার দেখতে চেয়েছিল। আমি তাই স্কুলে  নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিনই আবার কুট্টি মাসী এসেছিল দেখতে চাইল আমি দিলাম তারপর থেকেই আর পাচ্ছি না।” “মানে!  তুমি জানতে যে ওটা হারিয়ে গেছে? তাহলে আগে বলনি কেন?” “আমি ভাবলাম কুট্টি মাসী বোধহয় তোমাকে দিয়েছে। ট্যাক্টফুলি  বলটা মহুলের কোর্টে চালিয়ে দিল অরিভ।  কুট্টিমাসী অর্থাৎ মহুলের অফিসের বান্ধবী।  অরিভ  চাইছে ফোকাসটা ওর ওপর থেকে মাসীর ওপর শিফট করতে। অরিত্র পুরো ব্যাপারটায় ইনভল্ভড হতে   চাইছে না। ও মহুলের ছুঁড়ে ফেলা কাগজের গাদা থেকে কিছু নোটস  বেছে বেছে রাখছে। গত মাসেই একটা কাজের জন্য এই  নোটগুলো  খুঁজেছিল ও পায়নি বলে আবার বানাতে হল।এখন দেখছে  বানিয়ে ভালোই করেছে এগুলো একটু ব্যাক-ডেটেড হয়ে যেত।  ওর আবছা মনে পড়ছে কোথায় যেন দেখেছে এ্যাসাইনমেণ্ট শীটগুলো কিন্তু মনে করতে পারছে না। এরকমuseless  ইনফরমেশন দিলে মহুল আরো খেপে যাবে এখন।
মহুল গজগজ করছে – “প্রত্যেক বছর একই জিনিষ। কেন আগে  থেকে শেষ কর না তুমি হোমওয়ার্ক?” জবাব অরিভের তৈরীই ছিল  – “তোমাদেরই তো সময় ছিল না মা ! শীটের একদম ওপরেই  লেখা ছিল যে কাজগুলো করতে হবে With active involvement of parents – ভুলে গেছ?” মহুলকে চুপ করতে বাধ্য করে অরিভ।  প্রায় একঘণ্টা বৃথা খোঁজাখুঁজির পর ওরা ঠিক করে যে কোন বন্ধুকে ফোন করে তার থেকে শীট এনে জেরক্স করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই এখন। মহুল তখন রোহনের মাকে ফোন করে বলে যে  ও অরিভ কে নিয়ে আসছে শীটগুলো নিয়ে জেরক্স করে তখনই ফেরত দিয়ে আসবে।
শীট তো জোগার হলো। কিন্তু দেখা গেল যে রোহন তার মধ্যে  অনেকটাই লিখে ফেলেছে।  অরিত্র বুদ্ধি দেয় – “চল আমরা দুজনে  মিলে পুরোটা টাইপ করে ফেলি। মহুল আঁতকে ওঠে – “ক্রসওয়ার্ড  টাইপ করা চাট্টিখানি কথা নাকি! তার চেয়ে আমি হ্বোয়াইটনার মেরে আবার জেরক্স করে আনি।
কোলকাতা যাত্রার প্রাককালে শীট তৈরী হল মহুল মনে মনে  প্রতিজ্ঞা করল এর পরের বছর থেকে শীটগুলো পেয়েই ও লকারে রেখে দেবে 
মহুলের মায়ের ঘরে বসে বসে শীট উদ্ধার করল মহুল আর অরিভ।
দুদিন ধরে অরিভকে অনেক ভুজুং ভাজুং দিয়ে মহুল কাজ প্রায় শেষ  করে এনেছে।  কাল ওরা অরিত্রের মায়ের বাড়ি যাবে। মেণ্টালি প্রিপেয়ারড থাকার জন্য প্রোজেক্ট গুলোতে একঝলক চোখ বুলিয়ে নিল অরিত্র আর মহুল। একটা ম্যাগাজিন বানাতে হবে।মহুল বলল  ওটার দায়িত্ব ও নেবে। ইঞ্জিনীয়ার হলেও সাহিত্য ওর প্রিয়  বিষয়।   অরিত্র দায়িত্ব নিল কেমিষ্ট্রি প্রোজেক্টের। বাড়ীতে ইণ্ডিকেটর বানাতে   হবে রেড ক্যাবেজ দিয়ে।  ওয়াটার হারভেষ্টমেণ্টের ওপর একটা রাইট-আপ বানাতে হবে। কথা হল ওটা অরিভ নিজেই ওয়েব সার্চ   করে বানিয়ে ফেলবে। মহুল আরেকবার খেপে গেল – “তা এতদিন  বানাওনি কেন?ম্যাগাজিনের জন্যই বা কখন লিখবে, রাইট আপই বা কখন করবে!অরিত্র তাড়াতাড়ি মধ্যস্থতা করল – “থাক না হয়ে  যাবে। অত টেন্স হবার কিছু নেই। সব প্রোজেক্ট সাবমিট করতে হবে   এরকম কোন মানে নেই!” “মানে?” অরিত্র আর মানেটা সবিস্তারে বলল না ! এর পর ওরা গেল লেহ তে।
লেহতে ওরা ছিল পাঁচদিন। সিন্ধু নদীর জলে সূর্যাস্তের স্বর্ণালী রং  রোজ বিকেলে আগুন ধরায়। বিশ্বের উচ্চতম সড়ক ধরে, খার দুংলা  ক্রস করে ওরা গেল ডেসকিটের কোল্ড ডেজার্টে। দেখে এল বরফের পাহাড়ের কোলে কোলে ভারত থেকে তিব্বত চলে গেছে অপরূপ সবুজ-নীল লেক প্যানগং - পলিটিকাল সীমার ধার ধারে না সে। এছাড়াও অজস্র গুম্ফা, ফ্রেসকো, মিউজিয়ম পাঁচটা দিন হুশ করে কেটে গেল।
ফেরার পথে ফ্লাইটে অরিত্র অরিভকে বলল – “লিখে ফেল লেহর  ওপর ট্রাভেলগ লিখে ফেল।  কালার ছবি দিয়ে তোর ম্যাগাজিনটা দেখবি না কি দারুণ বানিয়ে দেব!অরিভ গাঁইগুঁই করে  ম্যাগাজিনটা ওর দায়িত্বে ছিল না।  অরিত্র বলে লেখা তো সবাইকে   লিখতে হবে।  ও ম্যাগাজিনের এডিটর কাম প্রিণ্টার!   
অতঃপর গুজরাট।  হাতে রয়েছে দুটো দিন। প্রথম দিন সকালে   অরিভ চেষ্টা-চরিত্তির করে একটা ভ্রমণকাহিনী লিখে ফেলল  আধপাতার মধ্যে। একলাইনে রইল কি কি দেখা হয়েছে। দু লাইন  লাঞ্চ আর ডিনারের মেনু। তারপর রয়েছে বরফে কাবু হবার কথা।   বাকিটা ওর জীবনের ট্র্যাজেডির ওপর যে বেড়াতে গিয়েও ওকে হোমওয়ার্ক করতে হয়েছে !  তার পরেই ওর মনে হল যে শুধু  ভ্রমণকাহিনীতে ম্যাগাজিনটা ঠিক জমবে না।তাই অরিভ একটা  ডিটেকটিভ গল্প লেখার দিকে মন দেয়।আধপাতার মধ্যে গল্প শেষ  করে ও মহুলকে ফোন করে দিল যে মা যেন অন্তত একটা কবিতা  লিখে ফেলে তাহলে ব্যাপারটা বেশ সর্বাঙ্গ-সম্পূর্ণ হবে। ছেলের ফোন পেয়েই সফ্টওয়্যার কন্সালট্যান্ট মহুলের মাথায় ছড়া গুনগুন  করতে শুরু করল।অচিরেই একটা ছড়া দাঁড়িয়েও গেল। নিজের  সৃষ্টি ব্যাগে বন্ধ করে বেশীক্ষণ বসে থাকা যায় না।  তাই বিকেল সাড়ে-চারটেতেই মহুল অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। ফেরার পথে   ডিপার্টমেণ্টাল স্টোর থেকে রেড ক্যাবেজও নিয়ে নিল। ইণ্ডিকেটর  বানাতে হবে।অরিভ ইতিমধ্যে ওয়াটার হার্ভেষ্টমেণ্ট নিয়ে বসে।   ইণ্টারনেট থেকে কয়েক প্যারাগ্রাফ, ছবি ইত্যাদি একটা ফাইলে কাট-পেষ্ট করে অরিত্রকে মেইল করে বলে দিল ফরম্যাট করে যেন  প্রিণ্ট-আউট নিয়ে নেয়। ওর কাজ শেষ করে অরিভ খেলতে চলে গেল।
বাড়ী ফিরে অরিভের সাহিত্যকর্ম দেখে মহুল  আর অরিত্রের মাথায় হাত। তিন পাতার ম্যাগাজিন বার করতে অস্বীকার করল এডিটর অরিত্র ! পেরেণ্টস ইনভল্ভমেণ্ট বলে দেবার ফলে এটা একটা প্রেষ্টিজের ব্যাপার হয়ে গেছে ওদের। তাই তিনজনে মিলে এবার  লেগে গেল ম্যাটার তৈরী করাতে। অরিভকে বলা হল ওর প্রিয় বিষয় ক্রিকেট আর ক্রিকেটার নিয়ে লিখতে। এবার আর অরিভের কোন  আপত্তি রইল না। এক সন্ধ্যেতেই গোটা চারেক পাতা ক্রিকেটার,   তাদের টিম, রেটিং, রেজাল্ট, ছবি - সব নিয়ে ভালোই দাঁড় করাল। অরিত্র পড়ল ডিটেক্টিভ গল্পটা নিয়ে। অরিভের গল্পে চোর, তার চুরি,  কবে, কখন এবং কারা চোর ধরেছিল সবই ছিল কিন্তু সারমর্মের মতো। তাকেই টেনে হিঁচড়ে লম্বা করে দুপাতা করল অরিত্র। আগাথা ক্রিষ্টি, এনিড ব্লাইটনের জব্বর পাঞ্চ। অরিভ একটু   ক্ষুব্ধ ওর গল্পটা নাকি শার্লক হোমসের স্টাইলে ছিল আরেকটু ইণ্টেলেকচুয়াল। তবে অরিত্রের দাবড়ানিতে অরিভ খুব একটা সুবিধে   করতে পারল না।  লেহ ভ্রমণকাহিনী মহুলের হাতে পড়ে রঙ্গীন ছবি   সহ খুবই মনোগ্রাহী হয়ে উঠল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।
এরই মধ্যে ম্যাগাজিনের দপ্তর ছেড়ে মহুল আর অরিভ পৌঁছে গেছে রান্নাঘরে ইণ্ডিকেটর বানাতে। আধখানা রেড ক্যাবেজ সিদ্ধ করতে   বসানো হল। বাকি অর্ধেকটা ফ্রিজে ঢোকাল। আপাতত থাক -  শুকিয়ে গেলে ফেলে দেবে! মূ্হূর্তের মধ্যেই বাটির জল ঘোর তুঁতে বর্ণ লাভ করল।  বেশ রোমাঞ্চকর! সেই জল ঠাণ্ডা করে তাতে ড্রয়িং পেপারের স্ট্রিপ কেটে কেটে ডোবানো হল।কাগজের টুকরোগুলো  দিব্যি সবুজ হল। এবার এসিড টেস্ট।রান্নাঘরে গিয়ে সেগুলোর   ওপর ভিনিগার প্রয়োগ করা মাত্র কাগজগুলো গোলাপী হযে উঠল।  বাঃ ! এবার ক্ষার খোঁজার পালা। বাড়ীতে এ্যাসিড যত সহজে পাওয়া   গেছিল দেখা গেল ক্ষার অত সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাবান জল,  বেকিং সোডা,অ্যাণ্টাসিড সব রকম দ্রব্য নিয়ে চেষ্টা করা হল। কিন্তু বিশেষ সুবিধে হল না। সবুজ থেকে নীলের দিকে সামান্য রং  বদল দেখা যাচ্ছে কিন্তু তা চোখের ভুল না কাগজটা ভেজার ফলে সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। যাই হোক - সমস্ত কাগজের টুকরো  হাওয়ায় শুকোতে দিয়ে সেই রাত্রের মতো শুতে গেল তিনজন।
পরের দিন চোখ খুলেই মহুল ছুটেছে কাগজের রং দেখতে। দেখে তো ওর মাথায় হাত ! প্রায় সব কাগজই সাদা খুব সামান্য সবুজ  অথবা গোলাপী আভা আছে তবে তা বোধহয় নেহাত ও জানতো বলেই। অরিভের ওপর নির্দেশ হলো কেমিষ্ট্রি নোটবুকে প্রোসিডিউর   আর অবজার্ভেশন লিখে ফেলার এভিডেন্স দেওয়া যায় না সব কিছুর। গজগজ করতে করতে অরিভ রাজি হল। কিন্তু ওর ইচ্ছে ব্যক্ত করল যে মা যেন দ্বিতীয় প্রোজেক্টটাও একটু দেখে। সেটাতে  ছিল যে ফিটকিরির স্যাচুরেটেড সলিউশান বানিয়ে তাকে কৃস্টালাইজ করতে হবে। মহুল বলল – “ঠিক হ্যায় ওটাও হয়ে যাবে। 
সেদিন বিকেলে মহুল আবার অফিস ফেরত বাজারে গেল ফিটকিরি  কিনতে। দেখা গেল ব্যাপারটা ঠিক যত সহজ ভেবেছিল তা নয়। গান্ধীনগরের সুপারমার্কেটে ফিটকিরি কিনতে পাওয়া যায় না।তাই  দোকানদারদের নাক সিঁটকানোকে অগ্রাহ্য করে ও কাতর ভাবে  জানতে চাইল কোথায় পাওয়া যেতে পারে। দোকানদার বলল  রাস্তার পাশে যে নাপিতরা দাড়ি কাটে তাদের কাছে থাকতে পারে!” “তারা কোথায় থাকতে পারে?” – সেটা সঠিক কেউই বলতে পারল না। প্রায় দু ঘণ্টা ঘোরাঘুরির পর ফিটকিরি যোগার করে বাড়ী  ফিরেই সোজা রান্নাঘরে। ফিটকিরির কৃষ্টাল ব্যাপারটা ভাগ্যক্রমে বেশ   সহজেই তৈরী হয়ে গেল। কৃষ্টালদের প্যাকেটস্থ করে মহুলের ছুটি!  অরিত্র ব্যস্ত ম্যাগাজিনের প্রিণ্ট-আউট নিয়ে। কাউকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না।
মহুল অরিভকে বলল অন্যান্য সব জিনিস ব্যাগে ভরে ফেলতে। চেকলিষ্ট দেখে মেলাতে গিয়ে আবার মাথায় হাত। ম্যাথসের আসাইনমেণ্টটা কারুরই চোখে পড়েনি। একটু অদ্ভূত ধরনের  কাজটা। একটা কার্ডবোর্ডে হিসেবমতো নির্দিষ্ট দূরত্বে ফুটো করে সুতো দিয়ে সেলাই করে একটা প্যারাবোলা তৈরী করতে হবে।দায়িত্বটা খুব স্বাভাবিকভাবেই মহুলের।  হারিয়ে যাওয়া সেলাইয়ের ব্যাগ খুঁজে কমলা রঙের উল বার করে ওটাও তৈরী হল। রাত সাড়ে  এগারোটায় অরিত্র ওর ম্যাগাজিন পেশ করল। দুর্দান্ত কভার    অসাধারণ সব ছবি - প্রায় প্রোফেশনাল কোয়ালিটির ম্যাগাজিন দেখে অরিভ খুব খুশি। বিধ্বস্ত হয়ে তিনজন শুতে গেল যখন তখন রাত  প্রায় বারোটা।
পরের দিন সকালে অরিত্র অরিভকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এল গাড়ী  করে। বলল দুপুরে নাকি গিয়ে নিয়েও আসবে। আসলে দুজনেই  বেশ উত্তেজিত সামার হলিডেজ এর হোমওয়ার্কে তো যা দেখা যাচ্ছে বাবা-মায়েরই মূল্যায়ন হবে ! ছেলে যদি এসে ওদের বকাবকি  করে! প্রেস্টিজ একেবারে গ্যামাক্সিন হয়ে যাবে!
স্কুল থেকে রিপোর্ট এল পরের দিন। অরিভ দারুণ উত্তেজিত।প্যারাবোলা পেয়েছে। তবে আসল খবর হলো ওর ম্যাগাজিনটা  দারুণ প্রশংসিত হয়েছে। ম্যাম বলেছে ওর ম্যাগাজিনটা ক্লাসের  ডিসপ্লে বোর্ডে লাগানো হবে সামনের মাসে।টেনশনে মহুল আজ হাফ-ডে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল এতক্ষণে। অরিত্র আলতো করে মনে করিয়ে দিল যে কৃতিত্বটা আসলে ওর। অরিভ ওর গলা জড়িয়ে ধরে আদর করে দিল। সাথে রাত্রে সেলিব্রেশন ডিনারেরও প্ল্যান হয়ে গেল।
খেতে খেতে অরিভ ওর প্রস্তাবটা সর্বসমক্ষে রাখল। বাবা তুমি কি ম্যাগাজিনটার আর কটা প্রিণ্ট-আউট দিতে পার?” “কেন স্কুলে চেয়েছে?” “না মানে বন্ধুরা পড়তে চেয়েছে। তাই ভাবছিলাম যদি  কয়েকটা কপি করে দিতে পার তাহলে ক্লাসে বিক্রী করতে পারি আমি। কত করে রাখা যায় বলতো?” “কি!গলায় ভাত আটকে  যায় মহুলের।  অরিত্র মহুলের পিঠে চাপড় মারতে মারতে খুব ঠাণ্ডা  গলায় বলল এক এক পাতা কালার প্রিণ্ট-আউটের কত খরচা জানিস? পনেরো টাকা! তাহলে হিসেব কর তোর পনেরো পাতার ম্যাগাজিনের দাম কত হবে?” “দ্যাটস টু এক্সপেনসিভ! কেউ কিনবে না” – অরিভ মুষড়ে পড়ে। আচ্ছা জেরক্স করে বিক্রী করা  যায়?” মহুল ভয়ে আর ভাত মুখে দেয় না। অরিত্র প্রবল আপত্তি  করে – “পাগল! কালার ছাড়া ওই লেহর ছবিগুলো খুলবে?” অরিভও  মাথা নাড়ে – “নাঃ জমবে না। মন খারাপ করে কোনমতে একটু  খেয়েই অরিভ উঠে পড়ে।পরক্ষণেই হাত ধুতে ধুতে হঠাৎ অরিভের  প্রবল চিৎকারে মহুলের হাত থেকে মাছের ঝোলের বাটি সোজা  ছিটকে অরিত্রের কোলে।মা একটা আইডিয়া! আমি তো  ম্যাগাজিনটা লেণ্ড করতে পারি বল বন্ধুদের! পার ডে দশ টাকা! লাইব্রেরির মতো। মহুল অরিত্রকে জিজ্ঞেস করে – “আচ্ছা ডারউইনের থিওরি কি ভুল ছিল? পড়েছিলাম এ্যাকোয়ারড ক্যারেক্টারিস্টিকস আর নট ইনহেরিটেড শুধু গুজরাটের হাওয়াতেই  এরকম পাকা ব্যবসাবুদ্ধি ও কি করে পেল?” মহুলের এই মধ্যবিত্ত মানসিকতায় অরিত্র হাঁসে। ও খুব খুশি - ছেলে এণ্টারপ্রিনিউর হবার  পথে পদক্ষেপ নিচ্ছে। অন্তত ওদের মত বাবা-মায়ের কথা শুনে বাধ্য  হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিঙ বা ম্যানেজমেন্ট  পড়বে না!