গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫

সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

 বই নিয়ে বৈঠক
   
    ভোলানাথ সমাদ্দার, মানে আমাদের ভুলোদার বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঁচাত্তর যা খুশি হতে পারে। ভারি ফিটফাট শৌখিন মানুষ। উত্তর কোলকাতার বসত বাড়ির তিনতলায় একটা মস্ত হলঘরে তাঁর আস্তানা, নিচের দুটো তলা ভাড়া দেওয়া আছে। পাড়ার ছেলে-বুড়ো থেকে বাইরের পরিচিত চৌহদ্দিতে ভুলোদা বলেই সমাধিক প্রসিদ্ধ। একা মানুষ, পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রির টাকা থেকে যা সুদ পান তাতে ভালো রকমই চলে যায়, তাই অর্থোপার্জনের জন্য না দৌড়ে জ্ঞানার্জনের নেশাতেই মজে আছেন। অসম্ভব স্মৃতিশক্তি ভুলোদার, এবার যা পড়েন বা দেখেন তা মগজের বিশেষ মাইক্রোচিপে সঙ্গে সঙ্গে অটোমেটিক সেভ হয়ে যায়। এত বিদ্যে কিন্তু জাহির নেই, বহু সাধ্য-সাধনা মানে সোজা কথায় তেল মেরে মুখ খোলাতে হয়। আমরাও ছাড়বার পাত্র নই! নিত্য নতুন ছক কষে ভুলোদাকে খুঁচিয়ে ওঁর মুখ খোলাতে কসুর করি না। তবে একবার মুখ খুললে আর দেখতে হয় না!   
   
ভুলদার বিশাল হলঘরটার চারদিকের দেওয়ালজোড়া তাকে কয়েক হাজার বই ঠাসা, বেশিরভাগই পুরনো। এদিকে-ওদিকে ছড়ানো প্রাচীন চিনেমাটির ফুলদানি, পুতুল, মান্ধাতার আমলের ডজন দুই সচল-অচল ঘড়ি, ধাতু ও টেরাকোটার কিম্ভুত মূর্তি, রঙ্গচটা ছবি, বিটকেল সব মুখোশ ইত্যাদি সব মহামূল্যবান বস্তু;  ঘরের মধ্যিখানে  সাবেকি বিরাট পালঙ্কের ওপরেও বই আর পাণ্ডুলিপির তাড়া। দাবার ছককাটা মেঝেতে একটা প্রমান সাইজের লেখার ডেস্ক। এই সব নিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন তিনি।  
    কাঁধে একটা মস্ত ঝোলা নিয়ে আমি যখন পৌঁছলুম, ভুলোদা তখন অত্যন্ত মনোযোগে চিমটে দিয়ে একটা ঝুরঝুরে পাণ্ডুলিপির পাতা ওল্টাতে ব্যস্ত। রিমলেশ চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে একনজর দেখে হাসি মুখে বললেন, ব্যাপার কি হে চাটুজ্জে, বড্ড ধকল গেছে মনে হচ্ছে আজ!    
--- তা আর বলতে! পাখাটা একঘর বাড়িয়ে দিয়ে বসতে বসতে বললুম, তুমি তো আর বিয়ের যাঁতাকলে পড়ে এই সংসারের চক্রব্যুহে ঢুকলেই না, তাই জানতেও পারলে না এই মায়া-প্রপঞ্চময় সংসার সমরাঙ্গন যে কি ভীষণ ... ইয়ে... মানে ভয়ঙ্কর...।  
--- থাক থাক! আর বলতে হবে না, আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দিলেন  ভুলোদা, যে রকম তপ্ত লাভার মত সাধুভাষা বেরুচ্ছে তাতে তুমি যে একটা আগ্নেয়গিরি হয়ে আছো তা বেশ টের পাচ্ছি। তা তোমার ও ঝোলায় কি আছে হে? বই বলে মনে হচ্ছে যেন!
-- তবে আর বলছি কি! ছেলে পাশ করেছে, নতুন বই-খাতা কিনতে হল। কি রকম ওজন দেখেছো! এ বই বইতে গেলে একজন ঝাঁকামুটে চাই। তার ওপর যা দাম!
--- অ! ও আর এমন কি! জ্ঞানলাভ করতে গেলে কি এই সামান্য ওজন আর দাম নিয়ে মাথা ঘামালে চলে! ভুলোদা পাত্তাই দিল না। 
-- বটে! ঝলা থেকে একখানা দশাসই বই বের করে দু-হাতে ধরে ভুলদার সামনে নাচিয়ে বললুম, ‘বুক’-টা দেখলেই ত বুক ধড়ফড় করে, ছেলে পড়বে কি১ বুকফোবিয়া হয়ে যাবে। আর দাম শুনলে তো...!
--- এটাও ত্যামন ধর্তব্যের নয়, নাকের ওপর থেকে মাছি তাড়াবার ভঙ্গীতে আমার উত্তেজনা নস্যাৎ করে দিয়ে বলল ভুলদা, বই সম্বন্ধে কটা তথ্য যদি তোমার জানা থাকত, তাহলে ছেলের ওই কটা পুঁচকে বই আর অত ভারী বলে মনে হত না, আর দাম নিয়েও অত উতলা হতে না।   
চশমার পিছনে চিকচিকে চোখ দেখে বুঝলুম, এ হল তুবড়ি জ্বলে ওঠার আগের অবস্থা, ফুলকি দেখা দিচ্ছে মনে হয়! এখন একটু উসকে দিলেই হবে। একটু বিরক্তি দেখিয়ে বললুম, সে তুমি যাই বল ভুলোদা, আমাদের সময়ে কিন্তু এমন পাহাড়প্রমাণ বইও ছিল না, আর বাপ-মাকেও বই কিনতে নাকের জলে চোখের জলে হতে হত না।   
 --- হুম! পাণ্ডুলিপির কাগজগুলো যত্ন করে গুছিয়ে রেখে, ধীরে সুস্থে রুপোর সিগারেট কেস থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে ভুলদা বলল, ‘কুধো দ্য’ বলে কোন বই-এর নাম শুনেছো?
আমি অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মত দুদিকে ঘাড় নেড়ে দিলুম।  
 --- বার্মা মুলুক, মানে এখনকার মায়ানমারে দক্ষিণ মান্দালয়ের প্যাগোডায় একটা সম্পূর্ণ বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ আছে যার ওজন হল আঠাশ টন। সাতশো ঊনত্রিশ পাতার সেই বইটার এক একটা পাতা পাঁচ ফুট লম্বা আর সাড়ে তিন ফুট চওড়া মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরী। এই গন্ধমাদন বইটা তৈরী হয়েছিল ১৮৬০ থেকে ১৮৬৮ সালের মধ্যে।
     --- বাপ রে! এর বেশি আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।  
--- ওজন তো হল, এবার বই-এর দাম নিয়ে বলছি শোন, মিটিমিটি হাসতে হাসতে ভুলোদা আবার শুরু করলেন, ১৯৮৩ সালের ৬ ডিসেম্বর লণ্ডনে সথবী কোম্পানির নীলামে দুশো ছাব্বিশ পৃষ্ঠার একটা হাতে লেখা বই বিক্রি হয়েছিল ৮৯ লক্ষ ৪০ হাজার টাকায়, আজকের হিসাবে তখনই দাম ছিল ষাট কোটি টাকারও বেশি, আর এখন তো ...! বইটার নাম ‘দ্য গসপেল অব হেনরী দ্য লায়ন’, হেরিম্যান নামে এক জার্মান সন্ন্যাসী ১১৭০ সালে লিখেছিলেন। শুধু তাই নয়, বইটার ৪১ টা পাতা জুড়ে অপূর্ব মিনিয়েচার ছবিও এঁকেছিলান। মহামূল্যবান এই বইটা লম্বায় সাড়ে তিন ইঞ্চি আর চওড়ায় ১০ ইঞ্চি।    
    ভুলোদার কথা শুনতে শুনতে  আমার মুখটা কখন যে হাঁ হয়ে গিয়েছে তা খেয়ালই নেই।
--- এতেই যে বাক্যি হরে গেল ভায়া! আর ছাপানো বই-এর দামের কথা যদি ধর, তাহলে ১৪৫৫ সালে জার্মানির মেইনজ শহরে ছাপাখানার আবিষ্কারক গুটেইনবার্গের প্রেসে ছাপা ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ এখনও সবার ওপরে। ১৯৮৭ সালে ২২ অক্টোবর নিউইয়র্কে ক্রিষ্টির নিলামে বইটা ৫৩ লক্ষ ৯০ হাজার পাউণ্ড, অর্থাৎ আজকের হিসাবে তখনই প্রায় ৪০ কোটি টাকার মত। কিনেছিল টোকিওর বই-এর ব্যবসায়ী মারুজেন কোম্পানি।  
ওরে বাবা! ভুলোদা এসব কি বলে যাচ্ছে! অথচ অবিশ্বাসও করতে পারি না। সঠিক প্রমাণ ছাড়া কোন কিছু বলার পাত্র তো ভুলোদা নয়!    
--- হ্যাঁ, তখন বই-এর সাইজ নিয়ে কি যেন বলছিলে? ভুলোদা এখন ফুল ফর্মে ক্রিস গেইলের ঢঙে চালাচ্ছে বোঝা গেল, দুটো খবর দিতে পারি, শুনলে তোমার মনটা হালকা হবে চাটুজ্জে। আইরিশ ইউনিভার্সিটি প্রেস ২৯৬৮ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চার বছর ধরে ১১১২ খণ্ডে ‘ব্রিটিশ পার্লামেন্ট পেপার’ নামে একটা তথ্যমূলক বই ছেপেছিল; ছাপতে খরচ হয়েছিল ৫০ হাজার পাউণ্ড। ১৯৮৭ সালে সেই বই-এর এক একটা খণ্ডের দাম ছিল ৪৯ হাজার পাউণ্ড করে। সব কটা খণ্ডের মোট ওজন ৩.৩ টন। হিসেব কষে দেখা গেছে সে সময় বইটা তৈরী করতে ৩৪ হাজার ভারতীয় ছাগল প্রাণ দিয়েছিল, আর ১৫০০ পাউণ্ড দামের সোনা লেগেছিল। ওই বইটা প্রতিদিন গড়ে দশ ঘন্টা করে পড়লে শেষ করতে ছ-বছর লেগে যাবে।
ভুলোদা আজ নির্মম, পরের ওভারের জন্য স্টান্স নিয়েছে। 
    আর একটা মস্ত বই হল ‘সুপার বুক’। এটা অবিশ্যি পড়ার বই নয়, দর্শকদের মন্তব্য লেখার বই। লম্বায় ১০ ফুট আর চওড়ায় ৯ ফুট। আমেরিকার কলরাডো শহরে ছাপা হয়েছিল এটা। ২৫২ কিলোগ্রাম ৬০০ গ্রাম ওজনের বইটাতে ৩০০ পৃষ্ঠা আছে।         
 --- আর পাণ্ডুলিপির কথা তো কিছু বললেনা! ভুলোদার দ্বিতীয় সিগারেট ধরানোর ফাঁকে একটু সামলে নিয়ে বললুম।
--- মোনালিসা ছবির অমর স্রষ্টা লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন এক আশ্চর্য প্রতিভাবান মানুষ জানো তো! একাধারে শিল্পী, বিজ্ঞানী, কবি, দার্শনিক।  ১৫০৭সালে তাঁর হাতে লেখা মাত্র ৩৬ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি ‘কোডেক্স লিসেস্টার’ ১৯৮০ সালে ক্রিষ্টির নিলামে ২২ লক্ষ পাউণ্ড মানে আজকের হিসেবে প্রায় ১৬ কোটি টাকায় কিনেছিলেন আরমান্দ হ্যামার নামে এক ধনকুবের সগ্রাহক। তাহলেই বোঝো!
    আমার বিপন্ন অবস্থা দেখে বোধ হয় মায়া হল ভুলোদার, বলল, একটা ছোট্ট বই-এর কথা বলে আজকের মত শেষ করছি; একদিনে এর বেশি বোধ হয় হজম করতে পারবে না তুমি! ১৯৮৫ সালে মার্চ মাসে গ্লেনিয়ার প্রেস থেকে ‘ওল্ড কিং কোল’ নামে বাচ্চাদের একটা বই মাত্র ৮৫ কপি প্রকাশিত হয়েছিল। বইটা লম্বায় চওড়ায় মাত্র এক মিলিমিটার করে। খুব সরু সূচ দিয়ে সাবধানে পাতা উল্টে আতশ কাঁচ দিয়ে পড়তে হয়। আজ অবধি পৃথিবীতে যত বই ছাপা হয়েছে তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে ছোট।  
    তিনতলার ঘরটা থেকে যখন নেমে এলুম তখনও আমার কান-মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। ভুলোদাকে ঘাটিয়ে লাভ হল না লোকসান হল জানি না, তবে টের পেলুম ছেলের বই ভর্তি ব্যাগটা এখন যেন বেশ হালকা লাগছে, আর বইগুলোর দামও এমন কিছু বেশী বলে মনে হচ্ছে না।   

[‘বই নিয়ে বৈঠক’ গল্পগুচ্ছতে সৌরেন চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম লেখা । লেখাটিতে বই বিষয়ক যে তথ্যগুলি আছে সেগুলো সবই ১০৯১এর গিনেস বুক অফ রেকর্ডস থেকে নেওয়া । এইরকম বিচিত্র তথ্য সম্বলিত একটি গ্রন্থ ‘জানা অজানা ১০০১’এর  লেখকও সৌরেন বাবু ।]