অনেকদিন পরে সেদিন সিনেমা হলে একটা
সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। কলকাতার একটা নামীদামী
বাতানুকুল সিনেমা হলের নরম তুলতুলে চেয়ারে বসে সিনেমা দেখতে দেখতে কোন সুদুর অতীতে
হারিয়ে গেলাম। আজ সিনেমাহল প্রায় অবলুপ্তির পথে। দু’চারটে হল আজও কোনমতে অস্তিত্ব
রক্ষার্থে বেঁচে থাকলেও, আসন্ন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। মনে হ’ল অনেক টাকার
টিকিট কেটে বিলাসবহুল এই হলে বসে অনেক আরাম, অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে সিনেমা দেখা গেলেও,
সিনেমা হলের প্রতি আগের সেই টান এখানে নেই। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ভাঙ্গাচোরা নড়বড়ে
হলগুলোর সাথে স্কুল বা কলেজ জীবনে যেরকম একটা আত্মার টান অনুভব করতাম, সেই টান
এখানে কোথায়? এখানে আরাম আছে, বিলাসিতা আছে, স্বাচ্ছন্দ্য আছে সত্য, কিন্তু সেই মানসিক
সুখ কই? এ যেন মাটির পৈত্রিক ভিটে ছেড়ে, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট বাড়িতে গিয়ে বাস করা।
স্কুল জীবনে দুপুরে স্কুল পালিয়ে,
সন্ধ্যায় টিউশন পড়তে যাবার নাম করে, প্রাণের বন্ধু সন্তু আর আমি কত সিনেমা দেখতাম।
পয়সার বড় অভাব ছিল। যাও বা কিছু পয়সা জোগাড় হ’ত, সিনেমা দেখে খরচ হয়ে যেত। আমার
অনেক দিনের ইচ্ছা মতো, ওতে আমাতে একটা ব্যাঙ্ক তৈরী করলাম। নিজেরা আলাপ আলোচনা করে,
সুবিধা অসুবিধা বিবেচনা করে, নিয়ম কানুন তৈরী করা হ’ল। ঠিক হ’ল জমানো টাকা পয়সা
তুলতে হলে, সাত দিন আগে জানাতে হবে। এই সাত দিনের নোটিশের পিছনে অবশ্য একটা কারণ
ছিল। আমাদের উভয়ের বাড়ির কাছেই “শ্যামলী” সিনেমা হল ও আশেপাশের সমস্ত সিনেমা হলে,
প্রতি শুক্রবার ছবি বদল হ’ত। আশপাশের কোন সিনেমা হলে ভাল কোন ছবি আসলে যাতে সিনেমা
দেখে পয়সার অপব্যবহার করা না যায়, তাই এই এক সপ্তাহের নোটিশ। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা
পয়সা তোলার সুযোগ আসার আগেই, সিনেমা হলের ছবি বদল হয়ে যাবে। সিনেমা দেখতে অবশ্য
ঊনিশ পয়সা, আর একটু ভাল সিটে বসলে, বোধহয় চল্লিশ পয়সা হলেই চলতো। কিন্তু এটাই
আমাদের পক্ষে জোগাড় করা দুষ্কর ছিল। একমাত্র আমরা দু’জনেই ব্যাঙ্কের কাষ্টোমার কাম
চেয়ারম্যান কাম জেনারেল ম্যানেজার হলেও, এবং ব্যাঙ্কের সঞ্চিত টাকা পয়সা আমাদের
নিজেদের কাছে থাকলেও, ব্যাঙ্কের সংবিধানের প্রতি আস্থা ও সম্মান রক্ষার্থে, যত ভাল
সিনেমাই আসুক বা যত লোভনীয় প্রয়োজনই হোক, সাত দিনের আগে এক পয়সাও তোলা হ’ত না।
ব্যাঙ্কে টাকা পয়সা জমা দেবার জন্য
হাতে লেখা পেয়িং স্লীপ তৈরী হ’ল। স্লিপের মাঝখান দিয়ে সুচ দিয়ে ফুটো ফুটো করে,
দু’টো ভাগ করা হ’ল। একটা নিজের, অপরটা ব্য্যঙ্কের। তখন টাকা তো দুরের কথা, পয়সাও
হাতে পাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। ঠিক হ’ল নানা ভাবে, নানা কায়দায়, নানা অছিলা
অজুহাতে, যা জোগাড় হবে, তাই জমানো হবে। সন্তু কিছু পয়সা জমাও রাখলো। ব্যবস্থায় কোন
খামতি ছিল না, খামতি ছিল মনোবলের। সপ্তাহ কয়েক মাত্র ব্যাঙ্কের আয়ু ছিল। তারপর
নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে, ব্যাঙ্কের পবিত্র সংবিধানকে অসম্মান করে, সব পয়সা
সিনেমা দেখে বাজে খরচ হয়ে গেল। যুক্তি ছিল একটাই— আমাদের দু’জনেরই তো টাকা, আমরা
যদি দু’জনেই ঠিক করি টাকা তুলে নেব, তাহলে অন্যায় বা অসুবিধা কোথায়?
এই পয়সা খরচ করার ব্যাপারে অসংযম ও
লুকিয়ে সিনেমা দেখার হ্যাপা নিয়ে কয়েকটা ঘটনা বেশ মনে পড়ে। সাম্ রেস্, অর্থাৎ
দৌড়ের মাঝে একটা অঙ্ক কষে, কে আগে দৌড়ে নিশানায় পৌঁছতে পারে, প্রতিযোগিতায় আমি বেশ
কয়েক বার সফল হয়েছিলাম। একবার আদর্শ সঙ্ঘ নামে একটা বড় ক্লাবের স্পোর্টস্-এ আমি
সাম্ রেসে দ্বিতীয় হয়ে, একটা বেশ ভাল কিট্-ব্যাগ পেয়েছিলাম। মৌমাছি যেমন তিল তিল
করে মধু সংগ্রহ করে সঞ্চয় করে, আমিও সেইভাবে পয়সা ম্যানেজ করে করে, দশ টাকা
জমিয়েছিলাম। একদিন, এক প্রবল বর্ষণ মুখর সন্ধ্যায়, খুব ইচ্ছে হ’ল “করকাফে” নামে
বাড়ির কাছেই এক রেস্তরাঁ থেকে কিছু চপ, কাটলেট কিনে খাই। কিন্তু বার বার মন বাধা
দিল—“পয়সাগুলো নষ্ট কোরনা”। একবার খেতে যাব, একবার যাবনা, এই ভাবে ঘন্টাখানেক
যুদ্ধ করে, খরচা করার প্রবণতাকে আরও প্রশমিত করতে, খুচরো পয়সাগুলো কিট্-ব্যাগ থেকে
নিয়ে বাইরে গিয়ে, একটা চকচকে দশ টাকার নোট বদল করে নিয়ে এলাম। নোটটা হাতে নিয়ে
নিজেকে বেশ বড়লোক বড়লোক মনে হ’ল। টাকাটা খরচ করার ইচ্ছাও যেন বেশ কমে গেল। নোটটা
কিট্-ব্যাগে তুলে রেখে বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। আরও প্রায় ঘন্টাখানেক পরে সব বাধা
উপেক্ষা করে, ব্যাগ থেকে চকচকে নোটটা নিয়ে, ছাতা হাতে এক হাঁটু জল ভেঙ্গে করকাফেতে
গিয়ে, মন ভরে, পেট পুরে, টাকার সদ্ব্যবহার করে, মনোকষ্টে বাড়ি ফিরলাম। আবার আমি
আমির থেকে ফকির বনে গেলাম।
একদিন সন্ধ্যার সময় টিউশন পড়তে
যাবার নাম করে বাড়ির কাছের “শ্যামলী” সিনেমা হলে “রাম ধাক্কা” নামে একটা হাল্কা
হাসির সিনেমা দেখতে গেলাম। একাই গেছি। সেই বয়সে ছবিটা খারাপও লাগছিল না। মনের
আনন্দে আধো অন্ধকারে ছবি দেখছি, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আমার ঠিক বাঁ পাশের চেয়ারটায়
সাধনদা বসে সিনেমা দেখছে। সাধনদা আমাদের বাড়ির দোতলারই মুখমুখি বাঁপাশের
ফ্ল্যাটটায় থাকে। ঐ ফ্ল্যাটের নিতাইদা, সেজদা, মেজদার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঠিক
আত্মীয়র মতোই। সাধনদা এই মেজদার শালা, মেজদার কারখানায় কাজ করার সুত্রে, তখন
মেজদার কাছেই থাকতো। সাধনদা আমার থেকে বয়সেও অনেক বড়।
যাহোক্ আধো-অন্ধকারে সাধনদাকে
এতক্ষণে দেখে যখন পরিস্কার চিনতে পারছি, তখন এটা নিশ্চিত যে, সেও তার ডানপাশে বসা
আমাকে এতক্ষণে দেখে ও চিনে ফেলেছে। অর্থাৎ রাম ধাক্কা দেখে বাড়ি ফিরে, ঘাড় ধাক্কার
ব্যবস্থা পাকা। ইন্টারভ্যালের ঠিক আগে একটা বেল বাজতো। বেল বাজতেই আমি অন্ধকারে
হলের বাইরে চলে এলাম। কিছুক্ষণ পরে হল আবার অন্ধকার হ’ল। শুরু হ’ল নানারকম
বিজ্ঞাপন দেখানো। আমি হলের বাইরে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দুরু দুরু বক্ষে, অপেক্ষা
করছি। ছবি আরম্ভ হলে অন্ধকার হলের ভিতরে ঢুকে, হাতড়ে হাতড়ে নিজের সিটে এসে বসলাম।
এই রো এর একবারে ডানদিকে, ধারের সিটটা আমার। যতটা পারি ডানদিকে ফিরে বসে, ঘাড়টাকে
বাঁপাশে করে, চোখ বেঁকিয়ে, কোন মতে ছবি দেখতে শুরু করলাম। ছবি দেখবো কী, মনের ভিতর
তোলপাড় হচ্ছে—বাড়ি ফিরে কী হবে। হঠাৎ সাধনদা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস্ করে বললো,
“এই সোজা হয়ে বসে ভাল করে দেখ্, কাউকে বলবো না”। সাধনদা তার কথা রেখেছিল।
সেদিন স্কুল পালিয়ে “নবরূপম” নামে
একটা হলে “নায়িকা সংবাদ” নামে একটা সিনেমা দেখতে গেছি। নতুন মুক্তি পাওয়া ছবি, ফলে
অসম্ভব ভিড়। লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবছি টিকিট পেলে হয়। কী কারণে এতদিন পরে মনে নেই, তবে
সেদিনও আমি একাই সিনেমা দেখতে গেছি। অনেকক্ষণ পর যখন টিকিট কাউন্টারের প্রায় কাছে
এসে পৌঁছেছি, আমার সামনে আর মাত্র তিন-চারজন লাইনে আছে, পিছনে বিরাট লাইন, হঠাৎ
নজরে পড়লো, লাইনের একবারে প্রথমে যিনি টিকিট কাটছেন, টিকিট কেটে ঘুরলেই যাঁর নজর
সোজা আমার ওপর পড়বে, তিনি আর কেউ নন, স্কুলের শিব বাবু। তিনি স্কুল ছুটি নিয়ে
সিনেমা দেখতে এসেছেন, না আমার মতোই স্কুল যাবার নাম করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে, সিনেমা
দেখতে এসেছেন জানিনা, তবে এটা জানি যে, এইসময়
বই খাতা হাতে আমাকে সিনেমা হলে দেখলে, কপালে অনেক দুঃখ আছে। তাই এক মুহুর্ত সময়
নষ্ট না করে লাইন ছেড়ে বেড়িয়ে এসে, বাঘ জল খেতে এলে হরিণ যেমন আত্মগোপন করে থাকে,
সেইভাবে দুরে, আড়ালে দাঁড়িয়ে নজর রাখলাম। তিনি ওখান থেকে চলে গেলে, টিকিট কাটার
জন্য আবার বিরাট লাইনের পিছনে দাঁড়ালাম। শিব স্যার নিশ্চই দামী টিকিট কাটবেন, তাই
কোন ঝুঁকি না নিয়ে, সব থেকে কম দামী টিকিট কেটে, হল অন্ধকার হলে, গুটি গুটি পায়ে
ভিতরে ঢুকে ছবি দেখলাম।
লুকিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়ে কেউ দেখে
ফেলবে, শুধু কী এই একটাই বিপদ? কেউ যাতে দেখতে না পায় সেই ব্যাপারে সাবধানতা নিতে
গিয়েও যে কত রকম বিপদ আসে, তা আর আমার থেকে ভাল কে জানে? “যোগমায়া” সিনেমা হলে কী
একটা সিনেমা দেখতে গেছি। হল অন্ধকার না হলে ভিতরে ঢোকায় যথেষ্ট ঝুঁকি আছে, তাই
বাইরে একপাশে দাঁড়িয়ে, চারিদিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে অপেক্ষা করছি। সবাই যখন হলের
ভিতর, তখন আমি নগদ পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে, চোরের মতো হলের বাইরে দন্ডায়মান। বই
আরম্ভ হবার ঠিক আগে, একটা বেল বাজতো। এসব সিগনাল আমার নখদর্পণে, অভিজ্ঞতার ফসল। বেল
বাজার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে টিউবওয়েল থেকে জল খেয়ে, হলের ভিতরে যাব। একছুটে
টিউবওয়েলের কাছে গিয়ে দেখি, একজন লোক একহাতে কলের মুখ চেপে ধরে, অপর হাতে পাম্প্
করে যাচ্ছে। একা একা জল খেতে হলে, এটাই করতে হয়। এভাবে আমরাও খেতাম, সম্ভবত এ
দেশের সবাই এই ভাবেই খায়। কিছুক্ষণ পাম্প্ করার পর, কলের মুখের হাতটা সামান্য ফাঁক
করে, কলে মুখ ঠেকিয়ে জল খেতে হয়। লোকটা পাম্প্ করা শেষ করে কলের মুখে সবে মুখ
ঠেকাতে যাচ্ছে, এমন সময় আমি দৌড়ে কলের সিমেন্ট বাঁধানো জায়গায় এসে, শেওলায় পা
পিছলে পড়ার উপক্রম। নিজেকে বাঁচাতে একহাতে টিউবওয়েলটা ধরতে গেলাম। কিন্তু বেসামাল
অবস্থার জন্য, হাতটা গিয়ে সজোরে লোকটার মাথায় লাগলো। কলের সাথে সজোরে মাথা ঠুকে,
“ওরে বাবারে” বলে লোকটা কল থেকে হাত সরিয়ে, মাথায় হাত দিয়ে বাঁধানো জায়গায় বসে পড়ে
যন্ত্রনায় কাতরাতে লাগলো। এদিকে আবার কল থেকে সজোরে জল পড়তে শুরু করায়, লোকটা পুরো
ভিজে গেল। আমি সরি বলে বোকার মতো লোকটার সুস্থ হবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি, আর মনে
মনে রামকৃষ্ণপুর না শিবপুর, কোন শ্মশানঘাটে আমায় নিয়ে যাওয়া হবে ভাবছি। লোকটা
নিশ্চই সুস্থ হয়ে আমায় এক হাত নেবে। ছুটে যে পালাবো, তারও তো উপায় নেই। পকেটে বহু
কষ্টে জোগাড় করা পয়সায় কাটা সিনেমার টিকিট। কিন্তু লোকটা ভীমের মতো চেহারা হলেও,
যুধিষ্ঠিরের মতো ভদ্র, তাই সে যাত্রা কোন মতে বেঁচে গিয়ে, মাঝখান থেকে সিনেমাটা
দেখলাম।
আজ পরিতক্ত ভুতুড়ে হলগুলোর পাশ
দিয়ে যাওয়ার সময় বুকের ভিতরটায় কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। এই হলগুলো একদিন সামান্য পয়সার
বিনিময়ে কত ঘন্টা আনন্দ দিয়েছিল। আজ ইতিহাস হয়ে গিয়ে রাতে রিক্সা রাখার জায়গা হয়ে
গেছে। খুব ইচ্ছা করে একবার হলের ভিতরে যেতে, পুরানো সিটগুলো আছে কী না জানিনা,
থাকলে কিছুক্ষণ বসে স্মৃতি রোমন্থন করতে। কিন্তু কাকে বলবো?