গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫

ঝর্না চট্টোপাধ্যায়

দ্বিতীয়া


শালা...হারামখোর! রাগে, ঘেন্নায় মাটিতে থুক্‌ করে একদলা থুতু ছড়িয়ে আবার তেড়ে যায়  বাবুলাল। নানকী অবাক হয়ে দেখছে তার মরদকে। নয় নয় করেও পাঁচ সাল শাদী হয়েছে তার, ঘর করছে সে এই মানুষটার সাথে। তারও কিছু আগে থেকে আগে  মেলামেশা, জানা-চিনা । সেই পুরানো বাজারে রেললাইনের ধারে যখন সবজির ব্যবসা করত নানকী, তখন থেকে।  কিন্তু এতদিন ধরে দেখছে বাবুলালকে, এত রাগতে দেখেনি। মাঝে মাঝে নানকীর উপর চড়াও যে হয়না তা নয়। দারু খুব একটা খায় না, খেলে জ্ঞান থাকে না বাবুলালের। পয়সা না থাকলে নানকীর যা আছে  দু/এক টুকরো রুপো, সব বেচে দিতে চায়, দিয়েওছে। লোক খুব ভালো নয়, কিন্তু বাবুলাল তার আদমী আছে, সে কি তাকে ছেড়ে চলে যাবে, থাকতেই হবে তাকে! হায় রাম! এই মানুষটা এমনি হইয়ে গেলো কি করে? কেউ কি গুণ কোরলো!    

ভয়ে ভয়ে দু-হাত এগিয়ে এসে বাবুলালের হাতটা ধরতে যায় নানকী। উদ্দেশ্য, ঘরে নিয়ে গিয়ে চারপাইয়ে শুইয়ে দেওয়া। মাথা ঠান্ডা হোবে, তারপর খেতে দিবে।  কালকের বাসি রোটি আছে, পাঁচখানা। তাদের ঘরে ঘি তো নেই, কিন্তু তেল দিয়ে ভেজে রেখেছে সে। আর আলু চোখা ভাজা আছে, লঙ্কা আর পিঁয়াজ আছে, আর কি চাই! খুশি হবে বাবুলাল। কিন্তু কোথাকার কে এক সুরজলাল  সাত সকালেই এসে মাথা গরম করে দিয়েছে। লোকটাকে কোনদিন দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না  নানকী। এই তো কদিন আগেই পরব গেল, বাবুলালের যত ইয়ার-বন্ধুর দল  সব এসেছিল লেকিন সে  সুরজকে দেখেনি । সেদিন মুরগা, রোটি আর দারু, যত খুশী। বাপ্‌ রে বাপ্‌! কি দারু খেতেই পারে সবাই। বাবুলালও খেয়েছিল।  নেশাভাং খুব একটা করে না  বাবুলাল, করলে মাথার ঠিক থাকে না। সেদিন নেশায় চুর হয়েছিল বাবুলাল।  

এক ঝটকায় হাতটা  সরিয়ে দেয় বাবুলাল। তারপর হন্‌হন্‌ করে এগিয়ে যায় সুরজলালের দিকে। সুরজও  বাবুলালকে ভয় পাচ্ছে এখন। বছর তিনেক আগে শাদী করবে বলে সুরজ   বাবুলালের কাছে দু-হাজার টাকা নিয়েছিল। কাম করে শোধ দেবে, তেমনই কথা ছিল। সেই টাকার জন্যই আজকে বাবুলাল সুরজকে ডেকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু সুরজ বেমালুম  অস্বীকার করে দিতে। তার বক্তব্য  সে নয়, বাবুলালই তার কাছ থেকে রুপেয়া নিয়েছিল। তিন সাল আগে তার যখন শাদী হল, তখন  বাবুলাল রুপেয়া নিয়েছিল। সুরজ টাকা দিতে নারাজ। বাবুলালের টাকা সে কেন দেবে, তারই তো পাওয়া উচিত। এই নিয়ে কথা  কাটাকাটি, রাগারাগি, শেষে গালিগালাজ...এবার বুঝি মারামারি না শুরু হয়!

সুরজলাল লোকটা তাগড়াই জোয়ান আছে, তার মরদকে উপর থেকে নিচে তুলে ফেলে  দিতে পারে। একবার বাবুলাল, একবার সুরজের দিকে চাইল নানকী, তারপর কি ভেবে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। বিছানার তলায় একেবারে এক কোণে তার এক পায়ের  রুপোর মল ছিল। বিছানা আবার কি! একটা পাতলা  কাঁথার উপর একটা ছেঁড়া চাদর পাতা, ওহ ভি চাটাই কি উপর! একটা আগেই গেছে, বাবুলালই বেচে দিয়েছে। পাছে এটাও যায়, মলটা নিয়ে সে তার কোমরের খাঁজে কাপড়ের মধ্যে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখল। কোন বিশ্বাস  নেই। এদের এই ঝগড়া, এই মারামারি, তারপর একসঙ্গে দারু চলবে। তখন পয়সা  না থাকলে এটাই বেচে দেবে। আছেটাই বা কি! যা দু/একটা লোকের বাড়ি কাম করে নানকী করেছিল, সব বেচে দিতে হয়েছে। এখন কাম ভি নাই, বাবুলাল দিবে না কাম করতে। লেকিন পয়সার দরকার হোবে, তো নানকীর জেবর বেচবে। মনে মনে  গালাগাল দিল নানকী। বাবুলাল ভি খারাব আদমী আছে, বহুত খারাব,  কিন্তু মুখে কিছু বলল না। এটা সে দেবে না, কিছুতেই না। বাইরে এসে দেখল সুরজ একদিকে দাঁড়িয়ে আছে আর বাবুলাল যা মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছে তাকে। সুরজ জোর গলায়  কিছু বলতে গিয়েছিল, বাবুলাল আরো জোরে গালাগাল শুরু করল। এই খেল কতক্ষণ চলবে সে জানে না, নানকী ঘরের দোর গোড়ায় বসে পড়ল।

(২)

সন্ধ্যেবেলায় ঘরের সামনে একটা পুরনো বটগাছের নিচে চারপাই মেলে শুয়ে ছিল বাবুলাল। মহল্লাতে এই একটাই বড় গাছ আছে, বহুতদিনের পুরানা। সন্ধ্যেবেলায় গরমের দিনে এখানে অনেকগুলো চারপাই পড়ে। মরদরা এখানেই শোয়। সারাদিন গরমের হলকা বয়ে যাবার পর সন্ধ্যেটা এখানে বসে থাকতে আরাম লাগে। ফুরফুরে বাতাস দেয়। ঘরের বাইরে মরদরা শুয়ে থাকে, গল্প ভি করে। মেয়েরাও ঘরের দরজায় বসে এর-তার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করে, ঘর-গেরস্থালির কথা বলে, বাচ্চা সামলায়। খানিক রাত পর্য্যন্ত এখানে থেকে মেয়েগুলো ভিতরে শুতে যায়, কারো বাচ্চা কাঁদে তো কারো ঘরে বড় জোয়ান বিটি আছে। মায়েরা বাইরে থাকে না। কয়েকটা বুড়ো-বুড়ী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মরদগুলার আশে পাশে এদিক-ওদিক শুয়ে থাকে। লেকিন যেদিন খুব জোরসে দারু, খানা-পিনা হয় সেদিন তারাও থাকে না। দারুর নেশায় সেদিন মরদরা কি যে বলে আর কি যে করে ! আবার সুবহ সে সব ঠিকঠাক, মালুম ভি হোবে না কি কাল এইসা ভি হোয়েছিল।

সকাল থেকে বাবুলালের মুখে রা নেই, গুম মেরে আছে, রাগে ফুঁসছে। সেই যে সাতসকালে সুরযের সঙ্গে রাগারাগি, ঝগড়া হয়েছে, তারপর থেকে যেন একেবারে অন্য  মানুষ। কি যেন ভাবছে...ভেবেই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে উঠে বসে কিছু একটা হিসাব করছে আবার শুয়ে পড়ছে। দুপুরে কোনরকমে পাঁচটা রোটির মধ্যে দুটো রোটি চিবিয়েছিল একটা লঙ্কা আর একটুকরো পেঁয়াজ দিয়ে আর এক লোটা পানি, ব্যস ! তারপর বাকি খানা থালা সুদ্ধ নানকীর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। পানি ভি না দেখল, গন্ধা আছে, কি সাফা আছে। নানকী রোটি খাবে কি খাবে না ভেবে খেয়েই নিল, খিদেও পেয়েছিল খুব। রাতে খানা বনাবে, গরম গরম চাউল, ঔর পোড়া মরিচ দিয়ে আলুভাতে। কিন্তু বাবুলাল খাবে তো,  বাপ রে...যা মিজাজ !
ঘরের দোরগোড়ায় বসেছিল নানকী।  টুকটাক কথা বলছিল আরো পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে। হঠাৎ চারপাই ছেড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে বাবুলাল এক হ্যাঁচকায় টান মারে নানকীকে। টাল সামলে কোনরকমে উঠে দাঁড়ায় নানকী। অবাক হয়ে গেছে সে। এ আবার কি! সারাদিনের পর এখন কি তার পেয়ার উথলে উঠল নাকি, তাও আবার সন্ধ্যাবেলায়! তার আদমীর কি  মাথা খারাপ হল নাকি? বাবুলালের মুখের দিকে চেয়ে রইল সে। কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল বাবুলাল---
 শা...,নাচনেওয়ালী ...বহ পায়ল কিধার, নিকাল...নিকাল জলদি, নহী তো লাগাউঁ এক ঝপ্পড়...! চল্‌...নিকাল...অভি নিকাল
এবার বুঝল নানকী। তার এক পায়ের মলের খোঁজ পড়েছে। সারাদিন ধরে তাহলে সেটা খুঁজেছে বাবুলাল, পায়নি। তাই এখন আরো মেজাজ চড়েছে। কিন্তু কেন দেবে সে? তার জিনিস হাতছাড়া করবে না কিছুতেই...। বেওফুক, বেইমান মরদ! যা ছিল সব একে একে বেচেছে। কাম করবে, ফির ভি গিরভি রাখবে সব। দুবেলা ঠিকমত ভাত দিতে পারে না।  তাই না আগের বৌ ভেগে ছিল, নানকীকে দুসরা সাদী করল! হ্যাঁ, নানকী বাবুলালের দুসরা বউ আছে । আরো কিছু মনে মনে ভাবছিল নানকী, কিন্তু বাবুলাল চাপা গলায় হিসহিস করে----উ আমার চাই...অভি নিকাল, নহী তো চির কে রখ দুঙ্গা...নিকাল... একটা জঘন্য গালি দেয় বাবুলাল।
--উ আমার আছে, কেনো দিব?’--নানকী মুখের উপর বলে, কিন্তু গলা জোরে নয়, ধীরে। জানে গলা তুললে বাবুলাল মেরেই ফেলবে তাকে। তার ভয় করছে এখন বাবুলালকে। 
--এক ঝপ্পড়...তুর আছে? কে দিল তুকে, চল্‌ নিকাল...তুরন্ত নিকাল...
--ওহ, সুরজ কি গুণ করল নাকি? ইত্‌না গুসসা...আগে তো কভি...কথা শেষ হবার আগেই এক ঝটকা নানকীকে। একটা হাত পিছনে টেনে নিয়ে দুমড়ে দেয় বাবুলাল। যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে নানকী।  
- উ তুর আছে... বেইমান, উ হামার জরুর আছে, আমি দিইছি তুকে... বহ মুংলির আছে, মুংলি মেরা জরু...তুঝে ক্যায়া...নিকাল, নহি তো জিন্দা গাড় দুঙ্গা... প্রায় ঠেলে মাটিতে ফেলে দেয় নানকীকে বাবুলাল।
--আমি কি করে জানব কুথায় আছে--জেদের বশে বলে নানকী।  হামি কি জরু নাই আছি? খালি মুংলিই তুমার জরু আছে, তো ভাগল কেনো...জরু আছে...হুঃ  এতগুলো কথা  বলে হাঁপায় নানকী।
--চল্‌ সাঙা করছি তুকে, মুংলি জরু  আছে হামার... বলে বাবুলাল। আমি জরু আছি...  নানকীর গলা নকল করে মুখ ভ্যাঙ্গায় বাবুলাল। চোখে জল আসে নানকীর। হায়, কোথায় যাবে সে! আজ পাঁচ সাল বাদ মুংলি, যে ভেগে গেছে, সে জরু আছে আর নানকী সাঙা করা মেয়েছেলে ! সে কি...র...আছে, বাবুলালের কাছে থাকে, তাকে কি সাদী করে নি নিয়ে আসেনি বাবুলাল। এতো বড় কথা বাবুলালের মুখে! ঘেন্না হল নানকীর।  সুরজ ঠিক কথাই বলেছিল, সুরজের টাকা মেরে দিয়েছে বাবুলাল। ধোঁকেবাজ...! কোমরের খাঁজ থেকে পায়ের মলটা বার করে জোরে বাবুলালের মুখে ছুঁড়ে মারে সে। হয়ত জোরেই লেগেছিল বাবুলালের। চীৎকার করে উঠল বাবুলাল।  
--লে যা...জরু কি গুলাম ! নানকী তেরা  জরু নহী তো নানকী তেরা  রখেল ভি নহী। ভির কভি মুহ মত্‌  দিখানা ...বেইমান মরদ...জানওয়ার কঁহি কি! বলে মাটিতে থুঃ করে থুতু ছিটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায় নানকী।

বাবুলাল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে...দুস্‌রা মে ইত্‌না জোর..., তো জরু কৌন ?