গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৫

ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী

রিঙ্কির কান্না

আমার বাড়ীর নিচের তালাটা ভাড়া দিলাম। এক অল্প বয়সী স্বামী স্ত্রী ওখানে ভাড়া থাকেন । তাঁদের একটি মেয়ে নাম ‘রিঙ্কি’ । বাবা মা দুজনেই অফিসে চলে যাওয়ার সময় মেয়েটি রোজ চিৎকার করে কাঁদে । মেয়েটিকে তার বাবা মা এক পরিচারিকার কাছে রেখে অফিস যেতে বাধ্য হন। পরিচারিকাটির নাম ‘মিতা’ । মিতা সকাল ৮ টার মধ্যে চলে আসে যায় রাত ৭ টায় । ও , ঘরের সমস্ত কাজ ; রান্নাবান্না ,মেয়েকে দেখা , তাকে খাওয়ান , কাপড় চোপড় কাচা ইত্যাদি সব কাজ করে । মিতা কেষ্ট-পুর থেকে আসে । ও বলে , ওর ঘরে ওর স্বামী, এক ছেলে ‘রাহুল’ সে নাকি গাড়ি চালায় , আর ছেলের বৌ ‘সোমা’আছে। মিতার বরটা পাঁড় মাতাল । ওর চেয়ে বয়েসে নাকি অনেক বড় । এ কথা অবশ্য মিতা বলেনি , আমাদের বাড়ির কাজের মহিলা মঞ্জু বলে। সে নাকি ইলেকট্রিকের মিস্ত্রী । এ সব কথা বলার উদ্দেশ্য ,মিতা প্রায় আমাদের ওপরের তালার ঘরে রিঙ্কিকে নিয়ে আসে । ওর মুখেই সব সোনা ।

আমি ভেতরের ঘরে থেকে আমার স্ত্রী আর মিতার কথোপকথন শুনতে পাই । কানে তুলো দিয়ে ত রাখতে পারিনা । কানে যা আসে সেটাই লিখলাম ।


আমার স্ত্রী , রিঙ্কিকে কখন কখন ভাত খাইয়ে দেন । মেয়েটার ওপর আমাদের বেজায় মায়া পড়ে গিয়েছে । আমাদের বাড়িতে বাচ্চা নেই তাই ওকেই আমরা নিজেদের নাতনী ভাবি । সকালে ওর কান্না শুনলে আমার খুব রাগ হয় আবার দুঃখ হয় । ভাবি এরকম চাকরি কি ওর মা’র না করলেই নয় । তবে আমি কে এ কথা বলার ! ওটা ওদের ব্যাপার । নিজেকে বোঝাই ।
এখনকার চাকুরেজীবি মহিলারা প্রায় দেখি ছেলে মেয়েদের পরিচারিকার হাতে মানুষ করাচ্ছেন । এরা বাবা মা’র স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । জন্মথেকে রিঙ্কি মিতার কাছে আছে । ও , মিতাকেই ওর মা বলে মনে করে। মিতাও..রিঙ্কি অন্ত প্রাণ । বলা বাহুল্য মেয়েটা দিন দিন নানা রোগে ভোগে বিশেষ করে সর্দি কাশি আর জ্বরে । শুনেছি ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার নাকি লম্বা প্রেসক্রিপশন দিয়ে ওষুধের ফর্দ তুলে দেন রিঙ্কির বাবার হাতে । আমি দেখছি ওষুধে ওষুধে মেয়েটা দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে । যেটুকু আধো আধো কথা বলে সেটা প্রচণ্ড সর্দিতে অপরিষ্কার শোনা যায় । আমি বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা। মিতা বুঝিয়ে দেয় কি বলতে চাইছে ও । সব সময় মেয়েটি বলে, “মা আপিস গেছে এলে চকলেট আনবে” । এই চকলেটের আশায় মেয়েটা বসে থাকে । বড় আশ্চর্য লাগে শুনতে ; ও নাকি মায়ের আসার সময় ঠিক বুঝতে পারে । ঠিক সেই সময় দরজার কাছেই হামাগুড়ি দেয় । তখন মিতাকে পাত্তা দেয়না। ওর মা এলেই মা’কে আঁকড়ে থাকে । এ থেকে স্পষ্ট অনুমেয় মেয়েটি ওর মা’কে কতটা মনে প্রাণে খোঁজে । । মা বেচারিও মেয়ের খবর সারা দিন যখন সময় পায় মিতাকে ফোনে জিজ্ঞাসা করে। মিতা সমস্ত বলে কি হল না হল।
এটা খুঁটিয়ে দেখলে কাউকে দোষ দেওয়ার উপায় নেই কারন আধুনিক যুগে মহিলারা স্বাবলম্বী । তারা শিক্ষিতা । তাই তারাও সংসারের সাচ্ছল্যর জন্য চাকরি করেন । শুধু তাই নয় স্বামী স্ত্রী দুজনেই সংসারের সমস্ত নিষ্পত্তি নিয়ে থাকেন।এটা খুব ভালো কথা । কিন্তু যে মেয়েটি তার শৈশব হারিয়ে ফেলছে । তার নিজের মা’কে কাছে পাচ্ছেনা । মা’কে না পেয়ে কাঁদছে , যন্ত্রণা পাচ্ছে তার কি হবে ?এটাই কি আধুনিক যুগের ছেলে মেয়েদের মা বাবার কাছ থেকে পাওনা ! আমার মনে হয় রিঙ্কির ই সম্পূর্ণ ত্যাগ । সে পরিচারিকার কাছে না থাকলে তার মা কি চাকরিতে যেতে পারতো ? বোধ হয় না ! আমার কাছে এই ব্যাপারটা স্পষ্ট নয় । এখানেই আমি মনে করি একান্নবর্তী পরিবারের আবশ্যকতা । মা’ না থাকলেও কাকিমা ,পিসিমা , ঠাকুমা শিশুটিকে তার মায়ের অভাব অনুভব করার অবকাশ দিত-না । আমাদের যুগে তাই আমরা কত স্বচ্ছন্দে আনন্দে ধূলো বালিতে খেলতাম । এখনকার ছেলে মেয়েদের মত ঘরে বন্দী হয়ে থাকতাম না ।
এর মধ্যে এক দিন শুনি রিঙ্কির বাবা আমেরিকা চলে যাচ্ছে ছ মাসের জন্য । কাজের জন্য যেতে বাধ্য কি করবে ওই সফটওয়ারের চাকরিটাই ওই রকম । আমি ভাবলাম স্বামী স্ত্রী দুজনেই বোধ হয় যাবে ..কিন্তু না একা রিঙ্কির বাবাই যাবে । বোধ হয় রিঙ্কির মায়ের , মা বাবা এসে থাকবেন ওদের কাছে .. কিন্তু না সে গুড়ে বালি । পরে শুনি রিঙ্কির ঠাকুরদা ঠাকুমা আসছেন এই ছয়মাস ওদের কাছে থাকার জন্য । ভালোই হল রিঙ্কির এবার একটু আদর যত্ন হবে আর আমার এক সঙ্গী জুটবে কথা বলার । আমার ই বয়েসের হবেন বোধ হয় রিঙ্কির ঠাকুরদা । একসঙ্গে পার্কে যাবো । অনেক কথা জমে আছে শোনার লোক পাইনা । এবার তার সুরহা হবে ।



‘অরুণাভ’ রিঙ্কির বাবার নাম । আমেরিকা যাওয়ার আগের দিন আমাদের এসে দেখা করে গেল । খুব অমায়িক ব্যাবহার ছেলেটার । লম্বা ফর্শা দীপ্তিময় চেহারা । ধীর স্থির ভদ্র ছেলে। এরকম ছেলে আজকাল দেখা যায়না। প্রণাম করে বলল,“কাকু অনেকদিন আসবো আসবো ভাবি কিন্তু আসা আর হয়না । নানান কাজের মধ্যে থাকি বুঝতেই পাচ্ছেন । আমার স্ত্রী কন্যা আপনাদের হেফাজতে রইল আপনারা মাঝে মধ্যে একটু খোঁজ রাখবেন। রিঙ্কি কে নিয়েই চিন্তা ।

আমি বলি , কিছু চিন্তা করনা বাবা । আমি তোমার পিতৃ তুল্য । কি বল ? তুমি না বললেও আমার স্ত্রী তোমার পরিবারে খবরা খবর নিত, মানে রিঙ্কি কেমন আছে , খাচ্ছে কিনা এই সব । রিঙ্কিকে ও খুব ভালবাসে ত তাই । হ্যাঁ কাকু নিশ্চই ! তাই এলাম আপনাকে দেখা করতে । আমার মা বাবা এসে পড়বেন বোধ হয় আজ ই । কিন্তু ওনারা এখানে নতুন । তাই আপনাদের ভরসা । একটু দেখবেন কাকু ।

তুমি কেন চিন্তা করছ ? এটা ত আমার কর্তব্য , তা ছাড়া রিঙ্কি আমাদের এখানে রোজ আসে । ওর জন্য চিন্তা করনা । মিতা আছে ,তোমার কাকিমা আছেন । ও ঠিক হয়ে যাবে । তুমি নিশ্চিন্তে যাও । কাজে মন দিও । হ্যাঁ তুমি কবে ফিরবে বাবা?

প্রজেক্টের কাজ শেষ হলেই ফিরবো । তা ছ সাত মাস নিশ্চই লেগে যাবে । দেখি কি হয় !! একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে কথা গুলো বলে অরুণাভ ।

আমি বুঝি ওর দুঃখ হচ্ছে রিঙ্কিকে ছেড়ে যেতে । যেতেই হবে উপায় নেই।

সন্ধ্যার ফ্লাইটে অরুণাভর বাবা মা এসে পড়লেন । এক দিক দিয়ে নিশ্চিন্ত আমরা ।

পরের দিন অরুণাভ চলে গেল আমেরিকা । ওদের বাড়ির সব্বাই এয়ারপোর্টে গিয়েছিল সী অফ করতে ।

রিঙ্কির ঠাকুমা ঠাকুরদা আসার পর রিঙ্কি কত খুশি সে না দেখলে বোঝান যাবে না । ওর ঠাকুমা মেয়েটিকে স্নান করান,খাওয়ান,পার্কে নিয়ে গিয়ে অন্য ছেলে মেয়েদের সঙ্গে খেলাতেন। ওই পার্কে এখন রিঙ্কির অনেক দিদি হয়েছে । রিঙ্কির ওই প্রাণবন্ত চেহারা আমাকে অনেকটা নিশ্চিন্ত করেছে । অরুণাভ এলে দেখবে ওর মেয়ে ওর ঠাকুরদা ঠাকুমার কাছে কত ভালো আছে । এখন রিঙ্কি আর কাঁদেনা । কত ছড়া বলে আধো আধো গলায় । কেউ বাড়িতে এলে ছুটে যায় দরজার কাছে বলে ,“কে এলো”? সবাই এক সঙ্গে হেঁসে ওঠে ওর কথা শুনে । ঠাকুমা গান শিখিয়েছেন রিঙ্কিকে, লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া করেছে যে বায়না ...। ওর আধো আধো গলায় আমার গানটা শুনতে খুব ভালো লাগে । এগুলকি মিতা পারে ? ও বেচারির সময় কোথায় এ সব করার !!

আগে আমি নিজেকে কত অসহায় মনে করতাম ! কিছুই করার উপায় ছিলোনা, কিন্তু এখন ! এখন আমি নিশ্চিন্ত ! আমি অরুণাভ এলে ওকে সব বুঝিয়ে বলব , রিঙ্কির জন্য ওর ঠাকুমা ঠাকুরদার থাকা কত প্রয়োজন ।