দুল
দুল ঝুমকোজবার গাছের লাল সবুজ আকাশের ফাঁকে ফাঁকে উকি দেয় হলদে রঙের কুমড়ো ফুল।
কুমড়োর লতাটা উঠেছে শশাঙ্কদের পাকা কোঠার ভেতর-পাঁচিল থেকে,
কিন্তু তাতে কি? ফুল তো বেশী ফোটে এই
ঝুমকোজবার গাছের উপরেই, এই গাছটার সাথে খুব ভাব যে,
তাই সব ফুল ওরই গায়ে। শেষ রাতের দিকে গরমে ঘরের তলায় থাকতে না
পেরে তাই প্রায়ই বনরাজ এসে বসে থাকে এই জবা গাছের ভেতর ডালে আর গরম ভুলে মুগ্ধ হয়ে
দেখে কেমন করে ছাই রঙা অন্ধকারের ভিতর থেকে লাল হলুদ সবুজ আর সোনা মেশা নীল রঙের
দিন শুরু হয়ে যায়। জবা গাছটায় একবার চড়ে বসলে বাইরে থেকে ঠাহর হয় না মানুষ আছে বলে,
মানুষ আসে ফুল নিতে তবে তা বাইরের দিকেই এত ফোটে যে কেউ তেমন
ভেতরে খোঁজে না। একবার শুধু দত্ত বুড়ো ভোর রাতে ফুল তুলতে এসে দাঁতকপাটি লেগে
পড়েছিল ভুত মনে করে, বনরাজই শেষটায় ধরে বাড়ি তুলে দিয়ে
আসে, লাভের লাভ একটাই, দিন পাকা
না হলে কেউ আর বড় জ্বালাতে আসে না।
তা
বলে জ্বালার অভাব নেই কিছু, রোজ রাত্তিরে উঠে আসার
কারণ জানতে চায় রাই, কি এমন গরম যে ফি-রাতে ঘরের বাইরে
যেতে হয়? পাঁচ জনে শুনলে রাই মুখ দেখায় কিকরে?এই কৈফিয়ত দিয়ে আসতে হচ্ছে আজ পাঁচ মাস যাবৎ, সেই
অঘ্রাণের নতুন ধানের সাথে যেবার বাড়িতে আলতা মাখা পা রাখল রাই, দিদিমা ভেবেছিলেন একটা বিয়ে দিলে হয়ত ঘরে মন বসবে মা-বাপ হারা ছেলের,
আর হয়ত নিশিদিন জলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে না। তা সত্যিই বেশ কিছুদিন
ঘর চিনল বনরাজ, দেখে শান্তি পেলেন দিদিমা। সেই কবে
থেকে যমকেও ঠেকিয়ে রেখেছেন শুধু এই নাতির কথা ভেবে, মেয়ে
জামাই হারানোর শোক বুকে পাথর চাপা দিয়ে তিল তিল করে বড় করে তুলেছিলেন বনরাজকে তবু
মানুষের মুখ বন্ধ করতে পারেন নি, কত লোকে বলেছে- তেমন
যত্ন পায় না বলেই না ছোট থেকে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। আজ তারা এসে দেখুক কেমন
সংসার করছে নাতি তার, দেখে যাক এসে। দুঃখ পেলে মানুষ সুখ
পাবার কামনায় বেঁচে থাকে কিন্তু সুখ পেলে ভবিষ্যতে দুঃখ পাবার মত উদারতা প্রায়ই
দেখাতে পারে না, তাই মনপ্রাণ খুলে উদ্বাহু হয়ে আনন্দ করে
আর তাতেই বিপদ আসে অতর্কিতে, ওই হঠাৎ বেশী ভোল্টেজ
বিদ্যুৎ এসে যাওয়ার মত। বুড়িও আনন্দের হাতে পরাজিত হল, বয়সও
হয়েছিল বেশ, পৌষ কাটল না, আর
ফাল্গুনের থেকে শীতেও লাগাম লাগলে পুরনো নেশায় পেয়ে বসল বনরাজকে।
যে
বছর আবাদের কাজে গিয়ে ঈশ্বর ফিরল না আর, সঙ্গের
লোকেরা বলেছিল সাপের কামড়ে মরেছে, ভবানী মানতে পারে নি সে
কথা, শীতের দিনে সাপে কাটে এমন কথা কে কবে শুনেছে?কাজ শেষে ফেরার পথে সাথে টাকা থাকত বেশ কিছু, সংসারের
কথা ভেবে লোকটা কখনো একটা টাকাও বেশী খরচ করত না। সেই টাকার লোভেই হয়ত
প্রাণ গেছে মানুষটার, বনরাজ তখন তিন বছরের
ছেলে, তাকে নিয়ে বাপের বাড়ি এসে উঠতে হয়েছিল। আর সব ঠিক
ছিল কিন্তু কপালের সিঁদুরের টিপের গোলটা বড় বড় হতে হতে শেষে কপালজোড়া হল, কথাবার্তাও অসংলগ্ন হয়ে উঠল, তারপর একদিন
ভবানীকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সেই কোন ছোটবেলা থেকে বনরাজ শুনে আসছে তার মায়ের কথা দিদিমার মুখে,
কখনো শোনে মা আছে তারা হয়ে কখনো নাকি শিউলি ফোটা ভোরে লুকিয়ে আসে
বনরাজকে দেখতে। রোজ
রাতে ঘুমোতে যাবার সময় মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করে সে,
ঘুম জড়িয়ে আসে যখন তখন জেগে থাকে সূর্যের মত লাল টিপ আর ধোয়া
কাপড়ের গন্ধ।