গঞ্জ থেকে খানিকটা দূরে একটা গ্রাম
ভেটকিমারী। নদী ভাঙ্গনের শিকার জনার্দনরা। গড়াই নদীটার ভাঙনে তাদের বাড়িঘর জমিজিরেত
শেষ হবার পর এক সময় তারা নদীর পাড়ে নতুন বসত গড়ে তোলে। জনার্দন আর শিবানী এক রকম লড়াই
করেই অতি কষ্টে সংসারটা দাঁড় করায়। তাদের একমাত্র ছেলে বিধানকে লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা
কম করেনি। জনার্দন চেয়েছিল তার ছেলে বিধানকে উত্তরপাড়ার সনাতন খুড়োর নাতি সদানন্দের
মতো অফিসার বানাবে। কিন্তু সেগুড়ে বালি। বিধানের লেখাপড়া হলো না। ওকে সংসারী করার জন্যে
বিয়ে দেওয়াই ভাল বিবেচনা করে জনার্দন ও শিবানী তাদের ছেলে বিধানকে বিয়ে দেওয়ার কথা
ভাবলো। নদীর ওপারের পাঁচবাড়ে গ্রামের জুড়োন মোড়লের বড় মেয়ে কমলার সঙ্গে একদিন বিধানের
বিয়ে হয়ে গেল। বিধান বেজায় খুশি। সে ঘরসংসারে মন দিল। সে সংসারের হাল পাল্টে দেওয়ার
চেষ্টায় ওঠে পড়ে লাগলো।
বিয়ের দু’বছরের মধ্যে কমলার কোল আলো করে একটা
ছেলে জন্মালো। জনার্দনের স্বপ্ন ছিল নিজের ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করার, কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ না
হওয়ায় সে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো তার নাতিকে নিয়ে। বড়তলার বাবুরা তাদের ছেলেমেয়েদের
সুন্দর সুন্দর নাম রাখে। সে তার নাতির নাম রাখলো বিধানের নামের সাথে মিলিয়ে বিজয়। জনার্দন
তার নাতি বিজয়ের কাছ থেকে বিজয় দেখতে চায়। নাতিকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা ভরসা। এবার সে
নাতিকে উত্তরপাড়ার বাঞ্ছারামের ছেলের মতো বড় অফিসার বানাবেই। কিন্তু
তার সে স্বপ্ন বেশি দিন স্থায়ী হলো না। হাইস্কুলের পাঠ চুকিয়ে নাতি বিজয় কলেজে ভর্তি
হবার পর থেকেই বিজয়ের মতিগতি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে জনার্দন দিনে দিনে বুঝতে পারছিল।
একদিন বিজয় সত্যি সত্যি জনার্দনের স্বপ্নটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিল।
জনার্দন চোত মাসের ঠাঁ ঠাঁ রোদ্দুরে
চিতা সাজিয়ে শ্মশানের সান বাঁধানো ভাঙা পিলারে ঠেস দিয়ে বসে নাতি বিজয়ের চিতার দিকে
চোখ নিবদ্ধ করে আছে। উত্তমকুমারের মতো চেহারার আঠারো বছরের একটা জোয়ান ছেলের লাশ চিতার
আগুনে পুড়ে খাঁক হয়ে যাবার দৃশ্যের দিকে জনার্দন ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছে।
সে কোনদিন ভাবতেও পারেনি তার একমাত্র নাতির লাশ তাকেই দাহ করতে হবে।
জনার্দন জীবনে কম মরা পোড়ায়নি। ভারত
ভেঙে দু’টুকরো হওয়ার পর দেশে কলেরার
মড়ক লাগে। রাতে কয়েকবার ভেদবমির পর সকাল হতে না হতেই মৃত্যু , একই পরিবার থেকে একটা পর
একটা মানুষ মরায় লাশ সৎকার করার লোক কোথায়! কে কাকে সান্তÍনা দেবে। জনার্দনের অসীম
সাহস কলেরায় সাবার হওয়া মরাগুলোকে চিতায় তুলে আগুনে পুড়িয়ে ছাই
করে দিতে সে ছিল আগের কাতারে। মরা পোড়ানোর সময় তার গায়ের রক্তে যেন নাচন লাগতো, সে উচ্চকন্ঠে‘বলো হরি, হরি বোল’ ধ্বনি দিতে মনটা যেন নেচে
উঠতো। আজ সেই জনার্দনের মুখ থেকে ‘বলো হরি, হরি বোল’ ধ্বনি একবারের জন্যও বের হয়নি চোত মাসের ভর দুপুরে ঠা ঠা রোদ্দুরে--নিজের হাতে একমাত্র নাতির
লাশ সৎকার করতে এসে।
জনার্দনের মনের কোণে ভেসে উঠলো সে সময়ের
কথা। তাদের পাশের গ্রামের জমিদার বাড়িতে পক্সের মড়ক লাগলো। একটা পাড়া পক্সে সাবার।
পক্সের মরা পোড়াবার জন্য লোক কোথায়! জমিদার বাড়ির পক্সে মরা লাশ দাহ করার ভয়ে গ্রাম থেকে জোয়ান লোকেরা পালালে
জনার্দন, পেহ্লাদ, রসু আর কেশাকে নিয়ে পচাগলা লাশ পোড়াতে লেগে গেল। জমিদারীর নয় আনি শরিকের মধু ডাক্তার তিনটা ছেলে দেশভাগের সময় কলেরায়
মারা গেলে মধুবাবু পাগল হয়ে গেলেন। তিনি ডাক্তারী করা ছেড়ে দিয়ে সকাল -সন্ধে শ্মশান ঘাটে বসে থাকেন
। শবদাহ করতে এলেই তিনি শববাহকদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন‘ পুড়িয়ে কোন লাভ নেই! আমি তিনতিনটা ছেলেকে পুড়িয়ে
দেখেছি একটাও বাঁচেনি। তোরা খামাখা কেন ওকে পোড়াতে চাস ! যতই পেড়াস্ ও কিন্তু বাঁচবে না।’
সেবার পক্সে মধুবাবুর একমাত্র নাতি
অমল মারা গেলে তার লাশ সৎকার করতে গিয়ে জনার্দন বেজায় বিপত্তিতে পড়লো। মধুবাবু কোনক্রমেই
নাতির লাশ দাহ করতে দেবেন না। তার এক কথা, ‘ আমি কলতাকার ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুল
থেকে পাশ করা ডাক্তার, নাতিতে আমি বাঁচিয়ে তুলবেই। তোরা এখান থেকে কেটে পর।’ জনার্দন মধুবাবুদের বাড়ির
নেমক খেয়েছেন অনেক। সে বাবুর দুর্দিনে কোন মতেই চুপ করে থাকতে পারে না। সে অমলের লাশ
দাহ করার জন্য এগিয়ে গেলে মধুবাবু জনার্দনের ওপর অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন,‘ তুই বেটা মরা মানুষ বাঁচানোর
ব্যবসা ধরেছিস,
তোকে লাঠি
পেটা করে তাড়ারোই, দাঁড়া তোদের---’ তিনি কথা শেষ না করে দোতলার দিকে হাঁটা দিলেন।
জনার্দনের মনে পড়লো কলেরা -পক্সের মহামারীর দিন আজ
আর নেই। চিকিৎসার শাস্ত্রে উন্নতির ফলে প্রাণঘাতী এই দুটো ব্যাধি নির্মূল হয়েছে। উত্তরপাড়ার
বাঞ্ছারামের নাতি আজ মস্ত বড় অফিসার। নাতি বিজয়কে তার মতো অফিসার বানানো আর হলো না
জনার্দনের।
চোত মাসের শেষ, গাঙে জল তলানিতে ঠেকেছে।
সে কাঠফাটা দুপুরে একমাত্র নাতিকে চিতার কাঠের আগুনে পুড়ে যেতে দেখছে শ্মশানের ভাঙাচোরা
গাঁথুনির পাশে বসে। সে জীবনে শত শত মরা পুড়িয়েছে। একদিনের জন্যে তার চোখে একফোঁঁটা
জল দেখা দেয়নি। সে এত সময়ও সে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করে এসেছে। কিন্তু আর ঠিক রাখতে
পারলো না। সে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। সে অনেক সময় ধরে কাঁদলো। কাছে পিঠে কেউ নেই তাকে
সান্ত¦না দেবার জন্যে। সবাই চিতার কাছে মাঝ গাঙে বালির চরে। এক সময় জনার্দন
কান্না থামিয়ে ভাবলো, এখন তো কলেরা পক্সের মহামারী লাগে না তবে কেন শ্মশানে এত পোড়া চিতা
সে দেখতে পাচ্ছে। সে বেশ কিছু সময় নিশ্চুপ মেরে থেকে এক সময় মাঝ গাঙের দিকে তাকিয়ে
ভাবলো, গাঙের আজ আর জোয়ানকী নেই, বালির চর পড়ে এখন গাঙে জল
ন্যাতানির মতো বইছে। মাঝ গাঙ থেকে ‘বলো হরি, হরি বোল’ ধ্বনি শুনতেই সেদিকে সে কান পাতলো। তার মনটা আবার হাহাকার করে উঠলো।
বিজয় তার স্বপ্নটাকে এভাবে গুড়িয়ে দিল! তুই পড়ালেহা না করে আমতলার কেষ্ট গায়েনের মিয়্যার পিড়িতিতে পড়লি! সোন্দীর নাহাল মেয়ে কি দ্যাশগাঁয়ে
আর একডাও চ্যালো না। সন্দোরীর মদ্যি তুই কী দেহিছিলি! কেষ্ট তার মিয়্যাকে আর এ্যাকটা ছাওয়ালের
লগে বিয়্যে দিওয়ায় তোকে গলার দড়ি দিয়ে মরতি হবি ক্যানে! সোন্দরীর চাইতি শতেক গুন সোন্দর মিয়্যার
লগে তোর বিয়্যা দিদি কি পারত্যাম না। তোরে এনজি থিকে টাকা কর্জ্জ করে বাজারে দোহান
করে দিওয়ালাম তোর বাবাকে কয়ে, যহন আমি বুঝতি পারলাম তোর লিহাপড়া হবিনানে। আমি তহনই বুঝতি পারিছিলাম
তুই দোহানে মালটাল না তুলি ছবিওয়ালা মোবাইল কিনলি যহন! মাঝ গাঙের ভিতর থিকে আবার ‘বলো হরি, হরি বোল’ ধ্বনি ভেসে আসায় জনার্দনের
চিন্তায় ছেদ পড়ল।
সে হরি বোল ধ্বনি শুনে আবার বেশক্ষণ
ঝিমমেরে থাকে। আবার এক সময় তার মনের মধ্যে নাতির মুখটা ভেসে উঠে। আবার সে ভাবতে থাকে, তহনই আমি বুঝতি পারিছিলাম , তুই রাত্তিরে কার লগে সারারাত
ধরি কতা কোস। তোরে জিগালে তুই কইলি আমি কহন কতা কলাম। রাত্তিরি তো সুধোন্ন্যদাদু তার
বউর লগে ফিসফিসানি করে। বিজয়ের কতা শুনে আমি একদিন সুধোন্ন্যকে জিগালাম, “ শালা তুমার দেহি বুড়ো বয়সি
বউয়ের লগে রাতির ক্যানে ফুসফুসানি করো, সারা রাত্তি ধরি বউরির লগে এত্তো গপ্পো !”সুধোন্ন্য জনার্দনের দূর সম্পর্কে শালাই
হয়। গ্রাম্য ডাক্তার হিসেবে তার নামডাক ভালই। সে বলল, “ কী কইছো দাদা, সারাদিন রুগী নিয়ে ব্যস্ত
থাকি, রাত্তিবেলা জাগে থাকার সমুয়
কনে!”
“ এহন বুঝতি পারতিঝি তুই আমারে মিছে কতা
কইছিলি। জনার্দনের চিন্তায় ছেদ পড়ে পেছন থেকে ‘বলো হরি, হরি বোল’ ধ্বনি ভেসে আসায়। সে পিছনে তাকিয়ে দেখে
চারজন চারজন শববাহক দুটো খাটিয়য় দুটো লাশ নিয়ে মাঝগাঙের শ্মশানের দিকে আসছে। জনার্দন
ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে চেয়ে থাকে।
এক সময় শববাহকদের মাঝ থেকে দু’জন জনার্দনের পাশে বটগাছের
ছায়ায় এসে বসে। গোয়ালখালির আনন্দ মন্ডল আর সাধু বাইন ওখানে জনার্দনকে দেখতে পেয়ে অবাক
হয়। জনার্দন তাদের চেনে। জনার্দন সাধু বাইনকে জিজ্ঞাসা করে , ‘ তোমাগের ওহানে কি মড়ক লাগিছে, তা কলেরার মড়ক না পক্সের
মড়ক?’ সাধু বাইন জনার্দনের কথা
বুঝে উঠতে পারে না। আনন্দ জিজ্ঞস করে , ‘ সে কতা ক্যানে কইছেন জনার্দনদা?’ ‘ মড়ক না লগলি পারে এত মরা
কনথিকে আসতিছে?’
এবার সাধু
ও আনন্দ বুঝতে পারে যে জোয়ান নাতি গলায় দঁড়ি দিয়ে মরায় বুড়োটার
মাথা ঠিক নেই। সাধু এবার মুখ খোলে,‘ দাদা ঠিকই কইছেন, দ্যাশে মড়কই লাগিছে, তবে কলেরা – পক্সের মড়ক না, প্রেমপিড়িতির মড়ক! আপনি তো আমাগের গাঁওয়ের বিহারী মোড়লের চেনেন। তার নাতিনটা কল্যাজে পড়তি
পড়তি মসেখোলার এক ছাওয়ালের লগে পীরিত করিছিল, ওগেরে বাপরা বিয়ে দিতি রাজি না হওয়ায়
কাল রাত্তিব্যালা বিহারীর বাড়ির সামনের আম গাছের ডালে একদঁড়িতি ফঁস দিয়ে মরিছে। আপনেগের
বাড়িতিও এমনটা ঘটায় আপনি জানতি পারেননি।’ জনার্দন এবারবলে উঠে, ‘ এবার আমি বুঝতি পারতিছি এত মরা কনথিকে আসতিছে। দ্যাশগাঁওয়ে সত্যি সত্যি
মড়ক লাগিছে কলেরা -- পক্সের না, এডা পেমপিড়িতির মড়ক।