গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫

সুবীর কুমার রায়

উপনয়ন

জমিদারী প্রথা অনেকদিন আগেই বিলুপ্ত হলেও চৌধুরীদের তিনশ’ বছরের বিশাল বাড়িটা আজও মাথা তুলে অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষ বহণ করছে। বংশানুক্রমে শরিকের সংখ্যা বেড়েছে, তার সাথে বেড়েছে বাড়ির বাসিন্দার সংখ্যা ও ছোট ছোট ঘরের সংখ্যা।  যদিও অন্যের সুবিধা-অসুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখা তো দুরের কথা, কেউ কারো খোঁজও রাখেন না। অতিবৃদ্ধ, বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, যুবক, কিশোর ও শিশু মিলিয়ে চার পুরুষের বাস। আয়োজনে খামতি দেখা দিলেও এখনও সাবেকী ঐতিহ্য রক্ষার্থে বাড়ির জীর্ণ শিবমন্দিরে প্রতি সোমবার পুরোহিত এসে দায়সারা পূজা করে যান। রুটিন মাফিক এক এক মাসে এক-একজন শরিকের ওপর শিবলিঙ্গ পূজার ভার পড়ে। অন্য শরিকরা সেই মাসে শিবের বা পুরোহিতের সুবিধা অসুবিধার ব্যাপারে কোন খোঁজখবর রাখেন না। রাখার প্রয়োজনও বোধ করেন না। তবে এখন পর্যন্ত প্রতিবছর পুরাতন ঐতিহ্য মেনে, বাড়িতে দূর্গাপূজা হয়। পূজার চার-পাঁচটা দিন বাড়ির সবাই কোন মন্ত্রবলে কে জানে, একে অপরের সাথে রক্তের টান অনুভব করেন, একত্রিত হয়ে পূজার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।  
দরিদ্র পূজারী ব্রাহ্মণ, সাতকড়ি চক্রবর্তী এই বাড়ির সব পূজা করেন। সবাই জানে এই চক্কোত্তী বামুনের বিদ্যে চালকলা পর্যন্ত। তবু তিনিই এই বাড়ির কুলপুরোহিত, কারণ কথিত আছে সাতকড়ি চক্রবর্তীর অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ, এককড়ি চক্রবর্তীর আমল থেকে বংশানুক্রমে তাঁরাই এই বাড়ির পূজাপার্বন, জন্ম, মৃত্যু, উপনয়ন, বিবাহের কাজ, দায়িত্ব নিয়ে সুসম্পন্ন করে আসছেন। আমার উপনয়নও এই চক্কোত্তী বামুনই দিয়েছিলেন। অবশ্য এই হত দরিদ্র ব্রাহ্মণটিকে দিয়ে পূজা বা অন্যান্য কাজ করানোর পিছনে আরও একটি কারণ আছে। ইনি অহেতুক ফর্দের বহর বাড়ান না, চাহিদাও বিশেষ কিছু নেই। যাই দেওয়া হোক, ইনি তাতেই খুশী, তাই বোধহয় পুরোহিত মশাই সম্বধনটুকুও তাঁর কপালে জোটে নি। এ হেন কুলপুরোহিতটির খোঁজখবর কিন্তু কেউ রাখেন না, এমন কী তিনি কোথায় থাকেন, বাড়িতে তাঁর আর কে কে আছে, এ বাড়ির কেউ জানেন না। হয়তো ধমনীতে জমিদারী রক্ত বওয়ায়, গরীব চালকলা বিদ্যের পুরোহিতটির খোঁজখবর রাখার প্রয়োজন অনুভব করেন না।
গতবছর দূর্গাপূজার আগে চক্কোত্তী বামুন যথারীতি এসে পূজার ফর্দ দিয়ে গেলেন। পঞ্চমী থেকে নবমী, বাড়িতে বিরাট হৈ চৈ। একসাথে পূজার কাজ, দু’বেলা পাত পেড়ে খাওয়া, এমন কী রাতেও নিজের ঘর পরের ঘর বলে কোন ভেদাভেদ রইলো না। যে যেখানে পারলো গড়িয়ে নিয়ে রাতটা কাটালো। দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের পর গোটা বাড়িতে শ্মশানের নীরবতা।  
পরদিন চক্কোত্তী বামুনের সাথে তাঁর বাড়ি যাওয়ার জন্য আমি বায়না শুরু করলাম। গরীব ব্রাহ্মণের বাড়িতে আমার থাকাখাওয়ার কষ্ট হবে, পড়াশোনার ক্ষতি হবে, সর্বপরি গৃহশিক্ষক এসে ফিরে যাবেন, এইসব নানা কারণ, প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালো। চক্কোত্তী বামুন সকলকে আশ্বস্ত করে বললেন, “কোন অসুবিধা হবে না, আমি লক্ষ্য রাখবো”। আমার বয়স এখন তিরাশি, আজ থেকে প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগে, তখন আমি মোটেই ছেলেমানুষ ছিলাম না, তবু বাড়ির অভিভাবকদের রাজী করাতে অনেক সময় গেল। শেষে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে দুপুরের দিকে চক্কোত্তী বামুনের সাথে তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।  
আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা রেলওয়ে স্টেশন পার হয়ে আমরা নামলাম। চক্কোত্তী বামুন জানালেন আগে তার পূর্বপুরুষদের, আমাদের বাড়ি আসার জন্য এই পথটা হেঁটে অথবা গরুর গাড়িতে আসতে হ’ত।  যদিও আজ এত বছর পরে এত উন্নতির পরেও স্টেশন থেকে হেঁটে ও ভ্যান রিক্সায় অনেকটা পথ পাড়ি  দিয়ে, সন্ধ্যার দিকে আমরা তালডুংড়ি গ্রামে এসে পৌঁছলাম। চারিদিক আম কাঁঠলের গাছে ঘেরা একটা বড় বাগান পার হয়ে, কিছুটা পথ গিয়ে একটা মাটির দোতলা ছোট্ট বাড়ি। আমরা আসবো এদের জানার কথা নয়, তাই ঝকঝকে উঠোন দেখে বোঝা গেল এরা আমাদের থেকে অনেক বেশী পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। চক্কোত্তী বামুনের হাঁকডাকে ও পায়ের আওয়াজে দু’তিনজন মহিলা বেরিয়ে এলেন। চক্কোত্তী বামুন আমাদের পরিচয় দিয়ে ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিছানা পাতা একটা চৌকিতে বসালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক বৃদ্ধা ঘটি করে জল নিয়ে এসে হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে আরাম করে চৌকিতে উঠে বসতে বললেন। না, ঠিক বললাম না,   বসতে অনুরোধ করলেন বললেই ঠিক বলা হবে। চক্কোত্তী বামুন পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানালেন, ইনি তাঁর স্ত্রী। আমরা সেইমতো হাতমুখ ধুয়ে পরিস্কার হয়ে কাপড় বদল করে চৌকিতে আরাম করে গুছিয়ে বসলাম। চক্কোত্তী বামুন কিন্তু ঘর ছেড়ে কোথাও গেলেন না।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ভদ্রমহিলা দুই হাতে দুই থালা মুড়ি নিয়ে এলেন, সঙ্গে কিছু ভেজানো ছোলা, বাদাম ভাজা, নারকেল টুকরো আর অতি সুস্বাদু খানিকটা তাল পাটালি। সবে দূর্গাপূজা শেষ হয়েছে, কাজেই ঠান্ডা না পড়লেও গরম কিন্তু সেরকম নেই। ভদ্রমহিলা তবু একটা হাতপাখা নিয়ে আমাদের পাশে বসে হাত নাড়তে নাড়তে তাঁর স্বামীকে বললেন, “আমি বসছি তুমি জামাকাপড় বদলে এসে এনাদের পাশে বসে একটু বাতাস করো। আমি বরং ঐ দিকটা একটু দেখি”।
চক্কোত্তী বামুন ফিরে এসে আমাদের পাশে এসে হাতপাখা নিয়ে বসলেন। কোনমতে তাঁকে বাতাস করা থেকে বিরত করা গেল। একজন মহিলা এসে চা দিয়ে গেলেন। আমরা চৌকিতে বসে তাঁর গ্রামের কথা শুনতে লাগলাম। হ্যারিকেনের স্বল্প আলোয় এই একটা ঘরের অবস্থা দেখেই এঁদের অর্থনৈতিক অবস্থাটা জলের মতো পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। যতই চালকলা বিদ্যার ব্রাহ্মণ হোক, তাঁর বিনয় ও ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে সারা বছর শিব পূজা, অন্যান্য অনুষ্ঠান, ও দূর্গাপূজায় যৎসামান্য প্রণামী দিয়ে বিদায় করাটা আমাদের বাড়ির কত বড় অন্যায়, কত বড় প্রবঞ্চনা এখন বুঝতে পারছি। আমাদের বাড়ির কোন পরিবারই খুব অবস্থাপন্ন নয় ঠিক কথা, কিন্তু কারো খাওয়াপরার অভাব নেই। এঁদের দুবেলা যথেষ্ট আহার জোটে কিনা সন্দেহ। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর গৃহকত্রী এসে আমাদের কিছু লাগবে কী না, আমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে কী না, খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন।
ক্রমে রাত বাড়তে আমাদের খেতে ডাকা হ’ল। মাটির দালানে পিঁড়ে পেতে বসতে দেওয়া হয়েছে। কলাপাতায় খাবার ব্যবস্থা। আমরা তিনজন খেতে বসলাম। খাবার আয়োজনও অতি সাধারণ। লাল চালের ভাত, ডাল, একটা চচ্চোড়ি আর ছোট ছোট মাছের ঝোল। চক্কোত্তী বামুন বললেন “আপনারা দয়া করে গরীবের বাড়িতে কষ্ট করে এসেছেন বলে, গিন্নী পাশের পুকুর থেকে জাল ফেলিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা করলেন। খেতে নিশ্চয় আপনাদের কষ্ট হবে”।  
খাওয়া শেষ হলে আমাদের দু’জনের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটায় আমাদের নিয়ে গিয়ে চক্কোত্তী বামুন বললেন, “আজ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে নিশ্চয় আপনারা ক্লান্ত। বিছানা করে দেওয়া আছে আপনারা বিশ্রাম করুন। রাতে ওঠার দরকার হলে ডানদিকের একবারে শেষে বাথরুম। বাইরে ছোট করে হ্যারিকেন জ্বালা থাকবে। আপনাদের ডানপাশের ঘরটাতেই আমি থাকি, কোন প্রয়োজন হলে আমায় ডাকবেন। বিছানা করাই ছিল, আমরা দুই বন্ধু অনেকক্ষণ গল্পগুজব করে শুয়ে পড়লাম।
রাত তখন কত বলতে পারবো না, আমার একবার বাথরুমে যাবার প্রয়োজন দেখা দিল। ঘর থেকে বেরিয়ে লম্বা একটা বারান্দা মতো। পর পর তিনটে ঘর, তারপরে বাথরুম। আমাদের ঘরের বাঁপাশের ঘরটা বন্ধ দেখেছিলাম। চক্কোত্তী বামুন বলেছিলেন আমাদের ডানপাশের ঘরটায় তিনি থাকেন। রাত অনেক হয়েছে, স্বাভাবিক ভাবে ঘরটা অন্ধকার। কিন্তু বাঁপাশের ঘরটার দরজা সামান্য ফাঁক, এবং তার ভিতর থেকে হাল্কা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। তাহলে কী চক্কোত্তী বামুন বাঁপাশের ঘর বলতে গিয়ে ভুল করে ডানপাশের ঘর বলেছিলেন? কৌতুহলবশত বাঁপাশের ঘরটার আধভেজানো দরজাটার কাছে গিয়ে চমকে উঠলাম। ছোট একটা জলচৌকির উপর একটা বই নিয়ে পাশে কুপি জ্বালিয়ে তার পিছনে দরজার দিকে মুখ করে বসে চক্কোত্তী বামুন একমনে বই পড়ছেন। ঘরের মেঝের অধিকাংশ জায়গাই লাল সালুতে মোড়া বোঁচকা দখল করে রেখেছে। আসবাবপত্র বলতে বোঁচকা ছাড়া ঘরে ঐ একমাত্র জলচৌকিই শোভা পাচ্ছে।
আমি দরজাটা খানিকটা খুলে দরজার সামনে দাঁড়ালাম, তিনি কিন্তু টেরও পেলেন না। আমি দু’-দু’বার  তাঁকে ডাকার পর তিনি মুখ তুলে চাইলেন। দরজার বাইরে আমাকে দেখে তিনি বললেন “বাথরুমে যাবেন? ডানদিকে আপনাদের পরের ঘরটা আমার ঘর, তার পরেরটা বাথরুম”।
“কিন্তু এত রাতে আপনি এ ঘরে বসে কী পড়ছেন? শুতে যাবেন না”?
ক’টা বাজে? বলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন “সর্বনাশ, সাড়ে তিনটে বেজে গেছে? কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। চলুন শোয়ার ঘরে যাওয়া যাক”।
আমাকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিয়ে তিনি শুভরাত্রি জানিয়ে আমাদের ঘরের ঠিক ডানপাশে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
পরদিন সকালে চক্কোত্তী বামুনের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটা বড় থালায় করে দু’কাপ চা নিয়ে তিনি মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের উঠে বসতে দেখে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কাল রাতে ঘুম হয়েছিল? নতুন জায়গা, কোন কষ্ট হয় নি তো”? আমাদের রাতে কোন কষ্ট হয় নি এবং ভালো ঘুম হয়েছে শুনে তিনি আশ্বস্ত হয়ে চা খেয়ে মুখ হাত ধুয়ে তৈরী হয়ে নিতে বলে, চলে গেলেন। বন্ধুকে বললাম “আমার এখানে থাকাখাওয়ার অসুবিধা হবে ভেবে বাড়ির লোক চিন্তা করছিল, বিশ্বাস কর, আমার আঠারো-ঊনিশ বছরের জীবনে এই প্রথম বেড-টি খাওয়ার সুযোগ হ’ল”।  
হাতমুখ ধুয়ে চক্কোত্তী বামুনের কথমতো তৈরী হয়ে নিলাম, যদিও কেন তৈরী হতে বলা হ’ল বুঝলাম না। গৃহকত্রী ছোট ছোট থালায় করে গরম গরম রুটি ও তরকারী নিয়ে এলেন, সঙ্গে কালকের মতো তালপাটালি। চা ও দিয়ে গেলেন। এই তালপাটালি জিনিসটা ভারি সুন্দর খেতে। যাহোক্, খাওয়া শেষ হলে চক্কোত্তী বামুন আমাদের নিয়ে গ্রাম দেখাতে বেরলেন। অল্প জমির ওপর ছোট্ট বাড়ি, ছোট বাগানে সুন্দর ফুলের ও সবজীর গাছ। বাড়ির পিছন দিকে ছোট একটা পুকুর। সম্ভবত এই পুকুর থেকেই গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের জন্য মাছ ধরা হয়েছিল। চক্কোত্তী বামুনের গোটা বসত বাড়ি ও বসত বাড়ি সংলগ্ন এলাকা ছবির মতো সাজানো। গতকাল সন্ধ্যায় হঠাৎ আমরা এসে হাজির হয়েছি। আমরা আসার পর পরিস্কার করার কোন সুযোগ ছিল  না, অর্থাৎ এটা স্বীকার করতেই হবে যে, চক্কোত্তী বামুন ও তাঁর বাড়ির লোকজন খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।
গোটা গ্রামটা চক্কোত্তী বামুন ঘুরে দেখালেন। গোটা গ্রামটায় আর যাই থাক, তালগাছের অভাব নেই। তালগাছের আধিক্যের কথা চক্কোত্তী বামুনকে বলতে উনি বললেন “এখানে প্রচুর তালগাছ থাকায়, তালগুড়ের পাটালি প্রচুর হয়। চেষ্টা করে দেখবো আপনাদের যদি কিছুটা জোগাড় করে দিতে পারি”। শুনে খুব আনন্দ হ’ল, কারণ কাল এবং আজ তালপাটালি খেয়ে দেখেছি, সন্দেশের থেকেও ভালো খেতে।
ফেরার পথে চক্কোত্তী বামুনকে জিজ্ঞাসা করলাম কাল অতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে রাত জেগে কী পড়ছিলেন। উত্তরে তিনি শুধু বললেন, “কয়েকটা দিন পূজা নিয়ে কেটে গেল। যাবার আগে জর্জ বার্নার্ড শ্যয়ের একটা বই কিছুটা পড়ে চলে যেতে হয়েছিল। এইকটা দিন মনটা ওতেই পড়েছিল। ভেবেছিলাম কাল রাতে শেষ করে দেব। কিন্তু শেষ করতে পারলাম না। শুনে তো আমার ভিরমি খাবার উপক্রম। চক্কোত্তী বামুন বর্নার্ড শ্য পড়ছেন?
দুপুরে খাবার পর, চক্কোত্তী বামুনের সাথে গতকালের ঘরটায় গেলাম। উনি অবশ্য আমাদের বিশ্রাম নেবার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন। ঘরে ঢুকে উনি একটা মাদুর পেতে আমাদের বসতে বললেন। উনি নিজে গতকালের মতো জলচৌকির পাশে বসলেন। জলচৌকির ওপর উল্টো করে রাখা খোলা বইটা দেখে আমি ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম। SOCIALISM FOR MILLIONAIRES BY BERNARD SHAW, PUBLISHED & SOLD BY THE FABIAN SOCIETY, PRICE ONE PENNY.
আমার সামনে বসে এ কোন চক্কোত্তী বামুনকে দেখছি? আমাদের বাড়ির সকলের পরিচিত চালকলা বিদ্যের সেই চক্কোত্তী বামুন তো ইনি নন। ইনি যে বার্নার্ড শ্য পড়ছেন, তাও আবার অনুবাদ নয় অরিজিনাল। কৌতুহল বশত তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “সারা ঘর জুড়ে এই লাল সালুর বোঁচকাগুলোতে কী আছে”?
উনি খুব লজ্জিত হয়ে বললেন “কী করবো বাবা, বাড়িতে এগুলো রাখার মতো ভালো জায়গার বড় অভাব। একটা বড় আলমারীর খুবই প্রয়োজন, কিন্তু তাও কেনা হয়ে ওঠে নি। ওগুলো সব বই। বাবার কেনা, আমার কেনা। ঠাকুদার সংগ্রহের কিছু বইও ওতে আছে, তবে যত্নের অভাবে সেগুলো নষ্ট হতে বসেছে”।
আমি একটু কিন্তু কিন্তু করেই বললাম, “আমি একটু খুলে দেখবো”? উনি মৃদু হেসে বললেন, “দেখবেন? তা  দেখুন, তবে খুব সাবধানে। একবারে পাঁপড় ভাজা হয়ে গেছে। আমার পড়তে খুবই অসুবিধা হয়”। এক এক করে যত লাল সালুর গাঁটরি খুলি, বিষ্মিত হওয়ার সাথে সাথে বুকের না মনের ঠিক বলতে পারবো না, কোথায় যেন একটা যন্ত্রণা শুরু হ’ল। মনে হ’ল কোন হাস্যকর অহমিকা বা পাপবোধই এই যন্ত্রণার উৎস। কাশীরাম দাসের মহাভারত, রামায়ণ, উপনিষদ, বেদ, চাণক্য শ্লোক, বিভিন্ন মঙ্গল কাব্য, বিভিন্ন পৌরানিক কাব্য, ইতিহাস তো আছেই, আর আছে বিবেকানন্দ, রামমোহন, রবীন্দ্র নাথ এমন কী কোরাণ পর্যন্ত। বিদেশী ইংরাজী বইয়েরও অভাব নেই। JOHN KEATS, WILLIAM BLAKE, WILLIAM WORDSWORTH, SHELLEY, LORD BYRON, H.G.WELLS, ALEXANDRE DUMAS, WILLIAM SHAKESPEARE, কে নেই?  
ধীরে ধীরে আবার যত্ন করে সব আগের মতো সাজিয়ে, সালু জড়িয়ে রেখে দিয়ে এসে নিজের জায়গায় বসে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার সংগ্রহে এত বই, কে পড়েন, কখনই বা পড়েন? চক্কোত্তী বামুন হেসে বললেন, “তিন পুরুষের সংগ্রহ। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ করে এম.এ. পড়তে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। ওখান থেকে পাশ করে বেরিয়ে কতবার চাকরী করবো ভেবেছি। অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় সংসার আর চলতো না, অবশ্য আজও ভালভাবে চলে না। কিন্তু এই হতচ্ছাড়া বইগুলো আমায় সে সুযোগ দিল কই? ওদের নিয়েই তো এতগুলো বছর কেটে গেল, কিছুই করা হ’ল না। পয়সার অভাবে কত বই এ জীবনে পড়তে বাকী রয়ে গেল। সে যাহোক্, আপনারা তো আজ বিকালেই চলে যেতে চান। ইচ্ছা করলে দু’দিন থেকে যেতে পারেন।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম। আমার উপনয়ন এই চক্কোত্তী বামুনই দিয়েছিলেন, আজ তিনিই আবার চক্রবর্তী পন্ডিতমশাই হয়ে, আমার আর একবার উপনয়ন দিলেন। বললাম, “না জ্যাঠাবাবু, আমরা আজ বিকেলেই চলে যাব। পরে আবার আসবো”।
বিকেলে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বিদায় নিলাম। জীবনে এই প্রথম তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। স্টেশন পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দেবার জন্য তিনি সঙ্গে একজনকে পাঠালেন। সঙ্গে তালপাটালি দিয়ে দিতেও ভুললেন না। ভ্যান রিক্সায় বসে যাওয়ার পথে একটা কথাই মনে হ’ল, চাকরী পেলে প্রথম মাসের মাইনের টাকা থেকে তাঁকে একটা সুন্দর মজবুত বইয়ের আলমারী তৈরী করে দেব।