মরিচিকা
বশির সাহেব রিটায়ার্ড মানুষ।
ষাটের উপর বয়স। সারাদিন পেপার পড়ে আর টিভি দেখেই তাঁর সময় কাটে। আজ পঁচিশে মার্চ। পঁচিশে মার্চ, ষোলই ডিসেম্বর, এই
সব দিন গুলি আসলে, বশির সাহেবের খুব কষ্ট হয়।
পুরোনো ক্ষত টা তাঁকে খুব কাঁদায়। যে কান্নার শব্দ কেউ শুনতে পায় না।
বশির সাহেব পাকিস্তানীদের
মনে প্রানে খুব ঘিন্না করে। পাকিস্তানীদের নাম পযন্ত সে সহ্য করতে পারেনা। বশির
সাহেব খেলা দেখার খুব পাগল। সে পাকিস্তানের খেলা কখনই দেখে না। সাপোর্ট করার তো
প্রশ্নই উঠে না।
বশির সাহেব পাকিস্তানীদের
ঘিন্না করার কারণ আছে। যুদ্ধের সময় বশির সাহেবের চোখের সামনে পাকিস্তানীরা তাঁর
বাবাকে আর বড় ভাইকে উঠানে দাঁর করিয়ে গুলি করে মারে।
একটা মাত্র যুবতী বোন ছিলো, তাঁকে টানতে টানতে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। দেশ
স্বাধীন হওয়ার মাত্র দুইদিন আগে, বোনটাকে
ওরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে। এরপর থেকেই বশির সাহেব
পাকিস্তানীদের মনে প্রানে ঘিন্না করে।
বশির সাহেবের দুই ছেলে এক
মেয়ে। সোহেল,
রুবেল আর পারুল। পারুলের বিয়ে হয়ে গেছে, জামাই সরকারি অফিসে চাকরী করে। ছোট ছেলে রুবেল বিবিএ
পড়ছে। আর বড় ছেলে সোহেল, আজ প্রায় পাঁচ বছর ধরে জার্মানির মিউনিখে আছে। সোহেল
পড়ালেখার উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়ে এখন সেখানে পার্মানেন্ট হয়ে গেছে।
এই পাঁচ বছরে সে একবারের
জন্য দেশে আসেনি। বহুদিন পর পর ইচ্ছা হলে ফোন দেয়, না হলে নাই। আর টাকা পয়সা? দেড়
বছর আগে পারুলের বিয়ের সময় একবার এক লাখ টাকা পাঠিয়েছিলো আর কোন খবর নাই।
সোহেলের জন্য বশির সাহেবের
কষ্ট হয়। এদিকে বশির সাহেবের স্ত্রী আলেয়া বেগম খুব অসুস্থ। ডায়াবেটিকস, হাঁপানি, এজমা, আলসার,
এইগুলি তো লেগেই আছে। তাঁর উপর আবার হার্টের সমস্যা। এর মধ্যে আজ কয়দিন ধরে পেটে
খুব ব্যেথা। তাঁর লিভার ফুলে গেছে।
আলেয়া বেগম হাসপাতালের বেডে
শুয়ে আছে। তাঁকে জরুরী অপারেশন করতে হবে। দুই জন নার্স এসে আলেয়া বেগমকে অপারেশনের
ড্রেস পড়ায়। দরজার বাইরে পারুল, পারুলের
জামাই, রুবেল আর বশির সাহেব দাঁড়িয়ে।
বশির সাহেব, রুবেল, পারুল
বার বার করে সোহেলকে ফোন দেয়। সোহেল ফোন ধরে না। কাল রাত থেকে বশির সাহেব অনেক বার
সোহেলকে ফোনে ট্রাই করেছে। কোন রেস্পস নাই।
-তুমি আমার কলিজা, আমার
জান। আই লাভ ইউ জান।
-লাভ ইউ টু জানু। জানু আমি খাইয়ে দেই। আর একটু ওয়াইন নাও
ভালো লাগবে। তুমি তো কিছু খাচ্ছই না জানু।
-খাচ্ছি তো জান। অ্যাঁয়ই সোহেল তোমার ফোন বাজে।
-আরে রাখো তো ফোন। এখন কোন ফোন টোন নাই। শুধু তুমি আর
আমি। তুমি শুধুই আমার পৃথিবী, আমার
সারা জীবনের সব টুকু সময়।
-থ্যাংকইউ জান। আই লাভ ইউ। উউম্মমআআহহহ...
বেড রুমে বড় প্লাজমা টিভি
তে রক মিউজিক চলে। ফ্লোরে দামি দামি ওয়াইনের বোতল। বিয়ার, চিকেন ফ্রাই, বিফ
ফ্রাই, কম্পিস, ফ্রেন্স
ফ্রাই, আরও কতো কি।
সোহেল এখন সারাকে নিয়ে খুব
ব্যস্ত । সারা সোহেলের পৃথিবী। সারা পাকিস্তানী মেয়ে। অতচ বাবা পাকিস্থানিদের ঘিন্না
করে। সোহেল মিউনিখে সারা কে নিয়ে লিভ টুগেদার থাকে। সারার সাথে সোহেলের পরিচয় হয়
তিন বছর আগে। তিন বছর ধরেই ওরা স্বামী স্ত্রীর মতোই বসবাস করে। এখনো বিয়ে করেনি।
এদিকে হাসপাতালে সব আত্মীয়
স্বজন এসে ভির করে। আলেয়া বেগমের ছোট বোন নাসরিন, তাঁর মেয়ে নিতু, নিতুর
বাবা, সবাই আসে। বারান্দার বেঞ্চে ঝিম মেরে পারুল আর রুবেল
বসে থাকে। ওদের চোখ দিয়ে পানি পড়ে। মুখে কোন কথা নাই।
-সোহেলকে পেলা পারুলের বাপ?
-না, আমারা
সবাই অনেক ট্রাই করছি, ওতো ফোনই ধরে না।
-মনে হয় খুব পরিশ্রম করছে। ছেলেটা আমার ঠিক মতো খাওয়া
দাওয়া করে কিনা আল্লাই জানে। এতো কাজ করলে ছেলেটার শরীর খারাপ হবে তো।
-পারুলের মা, আল্লার
রহমতে সোহেল ভালই আছে। তুমি আর ওকে নিয়ে আর চিন্তা করো না। ও ফ্রী হলে ফোন দিবে।
-শুনো, সোহেল
এবার দেশে আসলে,
ওকে নিতুর সাথে বিয়ে দিবা।
নাসরিনকে আমার কথা দেয়া আছে। ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে।
-এসব কথা এখন থাক পারুলের মা। সময় আছে পড়ে দেখা যাবে।
-না, আমার
মনে হচ্ছে, আমার সময় শেষ। এতোটা বছর তোমার সাথে সংসার করেছি। কতো
কারনে অকারনে কতো বকা ঝকা করেছি। আমাকে মাফ করে দিয়ো পারুলের বাপ। মনে কোন রাগ
রেখোনা।
-এই সব অলুক্ষনে কথা বোলোনা আলেয়া। তুমি আবার সুস্থ হয়ে
যাবা। অপারেশনের পর তুমি আরও ভালো হয়ে যাবা।
-জানি না। আল্লাই ভালো জানে। তুমি খুবই ভালো একটা মানুষ
পারুলের বাপ। আমার ভাগ্য যে, তোমার
মতো একটা স্বামী পেয়েছিলাম। তুমি খুব একা হয়ে যাবা। সোহেলের বিয়ে দিয়ে নিতুকে ঘরে
আনবা। নিতু তোমার দেখাশোনা ভালো করে করতে পারবে। সোহেলের সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছা
ছিলো, হোল না। ছেলেটাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
দুই জন নার্স এসে আলেয়া
বেগমকে, অপারেশনের জন্য অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। সবাই তাকিয়ে
থাকে আলেয়া বেগমের দিকে। সবার চোখে পানি। পারুল আর রুবেল চিৎকার করে কাঁদে।
-অ্যাঁয়ই জানু, তোমার
মোবাইল টা বন্ধ করবা? মজাটাই তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
-এই যে দিলাম বন্ধ করে। উৎপাত ভালো লাগেনা। এখন শুধু
তুমি আর আমি।
সোহেল মোবাইল টা বন্ধ করে
দেয়, তাঁর এখন কোন উৎপাত ভালো লাগেনা। ভালো লাগে শুধু সারাকে।
সোহেল সারাকে নিয়ে কাটিয়ে দেয় সারাটা রাত।
পরদিন দুপুর দুইটার সময়
সোহেলের ঘুম ভাঙ্গে। সুড়সুড়ি দিয়ে সারাকেও জাগায়।
-অ্যাঁয়ই, দু
কাপ বেডটি বানিয়ে আনো না?
-আনছি জানু। তুমি শুয়ে থাকো। আমি নিয়ে আসছি।
সোহেল সারার জন্য বেড টি
বানিয়ে আনে। দুজনে আয়েস করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বেডটি খায়। সোহেল বালিসের নিচে থেকে
মোবাইলটা নিয়ে অন করে।
নেটওয়ার্ক আসার পর দেখা যায়, বিরানব্বই টা মিস কল, নয়টা এস এম এস আসে। সোহেল শেষের এস এম এস টা ওপেন করে।
-বাবা সোহেল, তোর
মা আর নাই। আমারা তোর জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি। তোর মোবাইল বন্ধ। অপারেশনের আগে
তোর মা তোর সাথে খুব কথা বলতে চেয়েছিলো। তাঁর শেষ আসা পূরণ হোলনা। এই মাত্র তোর
মাকে আমরা আজিমপুর গোরস্থানে কবর দিয়ে আসলাম। দোয়া করি সব সময় ভালো থাকিস বাবা।
সোহেল মোবাইলটা হাতে নিয়ে
বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সোহেলের মনে পড়ে। মা তাঁর সমস্থ গয়না গাটি বিক্রি করে তাঁকে
জার্মানি পাঠিয়েছিলো।