গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০১৪

আরিফুল ইসলাম

ইন্টার্ভ্যূ


জরুরী একটা কাজে বেরিয়েছি। পথে-প্রান্তরে মানুষে-মানুষে, গাড়িতে-গাড়িতে গাদাগাদি অবস্থা। অতীব তাড়ার সময়েও এদেশে জ্যামের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া দায়। আর লোকাল বাসে চড়ে কোথাও যাওয়া চরম সর্বনাশের চেয়েও দারুন ক্ষতিকর। সময়ের চেয়ে এদের কাছে টাকার মূল্য অনেক বেশী। সময় কাজে লাগানোর উপকরণ খুঁজছে দুচোখ আগ্রহভরে। দূরে একটা কমবয়সী ছেলেকে পত্রিকা হাতে চিৎকার করতে দেখলাম। হাত উচিয়ে তাকে ডাকলাম। কাছে এসে ছেলেটা জানতে চাইল, কী দেব দাদা ? একটা দৈনিক পূর্বকোণদিতে বলে পকেটে হাত দিলাম। ১০টাকার নোট বের করে দিয়ে তাকে বললাম বাকীটা তুমি রেখে দাও। অমনি ছেলেটা বলল, ভিক্ষে করবনা বলেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলছি । নেন বাকী টাকাটা

ছেলেটার কথাশুনে ভাল লাগল । ওকে আমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে বললাম, কেন জানি মনে হচ্ছে আগামীকাল তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন হবে। এই টাকাটা রাখ, কাল যে কোন সময় একটা রিং দিও । ওর মুখ থেকে কথা সরার আগেই বিকট বিশ্রী শব্দ তুলে গাড়ি ছুটা আরম্ভ করল । এই ছুটা বড়ই অদ্ভুত। হাঁটার ছেয়েও ধীর । পত্রিকার পাতায় চোখ চালছি । উল্টে পাল্টে অনেক খবরই পড়লাম । শেষে একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি মনোযোগ কাড়ল । পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তরুণ দক্ষ সাংবাদিক/লেখক চাইছে। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন । সাংবাদিকতায় আমার অভিজ্ঞতা শূণ্যের কোটায় । বেকারত্বের চাদর মুড়িয়ে ঘুরছি অনেকদিন ধরে । মানুষের কাদা ছুড়াছুড়িতে চাদরের বেহাল দশা । হৃদয়ের এক কোনে চাদরটার জন্যে মায়া অনুভব করলাম। অন্তত তাকে মুক্তি দেওয়ার নিমিত্তে অন্দর মহলে জোরালো দ্বন্দ্বের আবহ সৃষ্টি হচ্ছে। সে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর জন্যে পত্রিকার সম্পাদক বরাবর একটি দরখাস্ত ও যোগ্যতা যাচাই মূলক লেখা পাঠাতে মন চাইল ।

নির্ধারিত সময়ের বিশ মিনিট পর গন্তব্যে পৌছলাম। বন্ধুরা সবাই মিলে আড্ডা দেওয়ার মতো জরুরী কাজ আমার মতো বেকার যুবকের আর কী হতে পারে ? বন্ধুদের রাগ অভিমানের পাহাড় কেটে তবেই মূলপর্ব শুরু করলাম। হাসি তামাসাই কেটে গেল ৫টা ঘন্টা। রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরলাম। এখানেও নিত্য নৈমত্তিক পাওনা ( বকা, গালি ) চুকিয়ে ঘুমুতে গেলাম। বিজ্ঞপ্তিটা মাথায় ঝেঁকে বসে আছে। অনেক কথা ভাবলাম। উন্মুক্ত কোন পথই নজরে এলোনা। শেষে আজগুবি একটা সিদ্ধান্তে মত জেদ ধরে বসে আছে। এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নেই শেষ পর্যন্ত নামতে হবে। অনেক সাক্ষাৎকার আমার পড়া হয়েছে । সবকটি ছিল বিখ্যাত মনীষীদের কাছ থেকে নেওয়া সাক্ষাৎকার ।

ভাবলাম কয়েকটা ইন্টারভ্যু নিয়ে একটা গল্প সাজাবো । তবে বিখ্যাত মনিষীদের নয়, ঝরে-পড়া পথ শিশুদের । যাতে থাকবে তাদের অপরিসীম কষ্ট আর গভীর নিনাদের অনুরনন । কাক-ডাকা ভোরে ঘুম ভঙ্গল । খালি পায়ে বেরুলাম । হাতে কলম ও ছোট নোট খাতা। ভোরের হিমেল বাতাস মনে সতেজতার আমেজ সৃষ্টি করছে। পাক-পাখালির মিষ্টি সূর খুব ভাল লাগছ। উদাস মনে হাঁটছি। অনেক্ষন হাঁটার পরও কারো কাছে ইন্টারভ্যু নেওয়া হলো না । নিজেকে অনেকটা হিমুর মতো লাগছে । মনে হচ্ছে হিমুর চেয়েও মধুর এবং অদ্ভুদ। মোবাইল ফোন বেজে উঠল। অপরিচিত নম্বর। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করলো- স্যার এতো সাত-সকালে রেল স্টেশনে খালি পায়ে হাঁটছেন ? আমি উত্তর না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলাম কে ?
-আমি মাহিরু, গতকাল যাকে নাম্বার দিয়েছিলেন।
 - ও তুমি
- আমি এখানে থাকি। মুখ ধুইতে বের হতেই আপনাকে দেখলাম। তাই রিং দিলাম।
- ভালই করেছ। তুমি এখনই আমার সাথে দেখা কর।
- ঠিক আছে আসছি । মাহিরুর ইন্টারভ্যু নিব । জীবিকার তাগিদে জীবনের প্রথম কর্ম করতে যাচ্ছি । মনে কে যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে । তবু মনকে শক্ত করলাম । আমাকে পারতেই হবে । একটু দূরে লক্ষ করলাম । মাহিরু হাসিখুশি মনে হাঁটছে । তবে প্রতিটি পদক্ষেপে দৃপ্ততার ছাপ স্পষ্ট । দুজনে বসে চা-খেতে খেতে আড্ডায় মেতে উঠলাম। ছেলেটা জবরদস্ত আড্ডা জমাতে পারে। অনেক কিছু জানলাম । তার জীবনের ছোট্ট গন্ডি কতো রসালো মাল-মসলায় টইটম্বুর তার সাথে কথা না বললে বুঝতামই না । মোটামুটি একটা ইন্টারভ্যু নিলাম । একটা শিরোনাম দিয়ে নোট খাতায় সাজালাম। শেষে একটা প্রশ্ন বের করে আনল বেদনার নীলে আচ্ছাদিত একটা মুহুর্ত ।
-
আচ্ছা এই বয়সে তোমার পড়া লেখার করার কথা । কিন্তু তুমি তা করছনা । কেন জানতে পারি।
-
করতাম। ইদানিং পড়া-লেখা ব্যাপারটা বিষিয়ে উঠেছে। দুকানে এ শব্দগুলো ঢুকলেই মাথা রোদেলা দুপুরের টিনের ছাদের চেয়েও উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
-নিশ্চয় কোন কারণ আছে। কারণটা জানালে খুশি হবো।
-হ্যাঁ । আমি খুব গরীব ঘরের ছেলে । নুন আনতে পান্থা ফুরায় অবস্থা ছিল । মা-বাবা অনেক চড়াৎ-উৎরায় পেরিয়ে আমার পড়া-লেখার খরচ জোগাত। তবে তারা কখনও ব্যথিত হননি। যা চেয়িছি হাসি-মুখে তাই দিতেন । এই যে মোবাইল । এটাও তাদের দেওয়া । কারণ প্রতিবার স্কুলের সেরা ছাত্র নির্বাচিত হতাম। কিন্তু এস. এস. সি. তে এসে আমার সর্বনাশের বিসমিল্লাহ পাঠ। আমার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু একটা মেয়েকে পছন্দ করতো । সারাক্ষণ মেয়েটার পেছনে ঘুঘুর মতো ঘুরে বেড়াতো । স্কুলে যতক্ষণ থাকতো ততক্ষণই মেয়েটার পেছনে লেগে থাকতো। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতো । মেয়েটা ভুল বুঝল। মেয়েটার পরিবার এসে স্কুলে বিচার দিল আমার নামে । আমার মা-বাবাকে ডেকে এনে যা নয় তাই বলেছে স্কুল পরিচালনা কমিটি। মা-বাবা টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। নিরবে সয়ে গেছে সব অপমান। রাত্রে বাসায় এসে আমার সাথে কোন কথা বলেনি। কিছু খায়নি। আমিও খেতে পারিনি। বাবা-মার ঘরে অনেকবার নক করেছি। দরজা খুলেনি। সারারাত দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সারারাত কেদেঁছি। সকাল হতেই মাকে ডাকলাম। কোন সাড়া-শব্দ নেই। অনেক্ষন ডাকলাম। দরজা খুলছে না। শেষে একটা জোরে ধাক্কা দিতেই ঘুনে ধরা দরজা মেড়মেড় করে পড়ে গেল। ভেতরে যা দেখলাম। বর্ণনা করতে পারছিনা বলে ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল । নিজের অজান্তে আমার চোখেও অশ্রুবিন্দুর দেখা মিল্ল। ভাবতে পারিনি তারা নিজেদের এভাবে শেষ করে দিবে। তাদের নিস্পাপ মুখদুটো এখনো ভুলতে পারিনি । কখনো পারবোনা জানি । তাদের শেষ ইচ্ছা পূরনে ব্যস্ত আমি।
-
কীভাবে?

পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল । আত্মহত্যার আগে তারা এই নোটটি লিখে গেছিলো । সারাদিন আমি পকেটে নিয়ে ঘুরি । আমি খুলে দেখলাম।তুই কখনও স্কুল-কলেজের বারান্দা মাড়াবিনা । পড়া-লেখা করবি না । এর যোগ্য তুই নয়। মা-বাবার আত্মাকে শান্তি দিতে চাইলে কথাগুলো মনে রাখবি.....লেখাটা ওর পকেটে গুজিয়ে দিয়ে। ভালো থাকিসবলে, সিক্ত আখি মুছতে মুছতে বেরিয়ে পড়লাম দিগন্তহীন খোলা আকাশের নীচে। শুরু করলাম খালি পায়ে হাটা ।

আর কারো ইন্টারভ্যু নেয়ার মতো মানষিক শক্তি আমার নেই। ইচ্ছে করে নিজের কাছে নিয়ে আসতে চাওয়া কর্মব্যস্ততাকে আবার পেছনে ঠেলে দিলাম। স্বাধীন হৃদয়ের আবেগের টানে সাড়া দিয়ে যোগ দিলাম বন্ধুদের আড্ডায়..........