আমি তোমাদের ময়না
আমি ময়না, স্টেশনের ফুটপাথে তিন বোনকে নিয়ে মা রাত কাটায়। আমরা বোধহয় কোন বাবুর ভোগের ফসল,তাই
বাবার নাম ঠিকানা জানি না। সকাল হলেই যাত্রীদের কারও শাড়ীর আঁচল,কারও ওড়না
অথবা কোনও বাবুর পা ধ’রে হাত পেতে
ভিক্ষে করি । কারও ইচ্ছে হলে দেয়, কেউ বা মুখ ফিরিয়ে নেয় । মা স্টেশনের সামনে একটা হোটেলে বাসন ধোয় । সারাদিন তিন বোনের ভিক্ষের টাকায় যা পাই আর মায়ের রোজগারের টাকাতে বাবুর হোটেলে আমাদের চার জনের দু’বেলার
খাবার জুটে যায়। একটু একটু
করে যখন বড় হলাম, আমার সদ্য ফুটা কুড়ি’কে
রিকশাওয়ালা,হকার , এমন
কি শিক্ষিত চোখ গুলো গিলে খেত। ওড়না
তো দূরে থাক,
ছেঁড়া ফাটা জামাটাতেই কোনও রকমে নিজের লজ্জা ঢাকতাম ।
একদিন, হোটেলবাবু মা’কে ডেকে বড়,তোর
বড়
মেয়ে ময়না এবার বেশ ডাগর ডগর হয়েছে । শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাওয়ার আগে, ওর
জন্য পাত্র দেখেছি বিয়ে দিবি ? আমার মতো
পাপ’কে ঘাড় থেকে নামাতে মা এক কথায় রাজি হয়ে গেল । বিহারে এক পাত্রের সাথে ঠাকুর মন্দিরে সিঁদুর পরিয়ে আমার বিয়ে হয়ে গেল। স্বামীর সাথে রওনা দিলাম ট্রেনে । মাঝ পথে, ট্রেন থেকে নামিয়ে আমায় একটা হোটেলে নিয়ে গেল। বলল, অনেকটা রাস্তা, বিশ্রাম
নাও, কাল সকালে
আবার রওনা দেবো। আমার যৌবনের
প্রথম কুড়ি আমি যার পায়ে
সমর্পণ করলাম । কখনও ভাবতে
পারিনি যে,
সে দেবতা নয়, মানুষ নয়, একজন
দৈত্য । আমায় ভোগ করার পর আরও চার জন পুরুষ’কে
দরজা খুলে ভেতরে ঢোকাল । আমি
আঁতকে উঠলাম। চিৎকার করতে
গেলেই আমার দানব স্বামী বলল যে, সেই হোটেলের মালিকের কাছে টাকা দিয়ে কিনে এনেছে। আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে টেবিলে ঢাকা দেওয়া জল টা ঢকঢক করে খেয়ে, আমার শুকনো গলা ভেজালাম। ওরা আমার হাত দু’টো
খাটের সাথে বেঁধে দিল। বোধয়, জলের
সাথে কিছু মেশানো ছিল। সারা
শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে ঘোর লেগে
গেল। একজন একজন করে ছিল, শকুন গুলো আমার দেহের মাংস গুলো টুকরো করে খাচ্ছে। তৃতীয় জন যখন ধর্ষণ করছে, আমি
সহ্য
করতে না পেরে তার মুখে এক লাথি দিলাম । অসহায় চোখে স্বামীর দিকে তাকাতেই, ও
চেয়ার
থেকে উঠে এসে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকা দিল উরুতে। আমার ভিক্ষের টাকায় কেনা সদ্য পরা শাখা জোড়া ওদের হাতের চাপে মটমট করে ভেঙ্গে গেল । আমার কপালের সিঁদুর বিবর্ণ হয়ে অস্ত গেল। আমার রঙিন স্বপ্নটাকে যেন কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল। আমি ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে পরে যখন জ্ঞান ফিরল , আমি
চোখ খুলে দেখলাম, আমার বাসস্থান শ্বশুরবাড়ি
নয়
পতিতালয়ে । ওখানকার মাসিরা সযত্নে গ্রহন করলো । আমি হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। মাসিরা সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলল । আমি বাড়ি ফিরতে চাইলে, এক মাসি আমায় বলল , তোমার
আরও
দু’টো বোন আছে ! ভেবে দ্যাখো তোমার মা’ তোমায়
নেবে কী না ! আর এর জন্য তোমার
ভাগ্য দায়ী নয় ,
দায়ী এই গলাপচা সমাজ ।
ভেবে দেখলাম, গঙ্গার বুকে তো মৃতের মালাও ভেসে যায় ! আবার পূজার ফুলও ভেসে যায় ! মা গঙ্গা কী তাতে অপবিত্র হয়! সে, সব কিছুই বুকে বহন করে। আমার হাতের মাটিতেই তো মায়ের মূর্তি তৈরি হয় । যেখানে বাবুরা করজোড়ে নত হয়ে পরিবারের মঙ্গল কামনা করে। এসব ভেবে
নিজেকে স্বান্তনা দিতে গিয়ে ঈশ্বরের কাছে
ক্ষোভ জানালাম... “ হে ঈশ্বর যদি সকল জীবের মধ্যেই তুমি বিরাজ করো ,তবে
সমাজে কেন আমরা- ওরা বৈষম্য ! চিন্তার গভীরে ডুবে গিয়ে ভাবি, আমার দুই বোনকেও
যদি আমার সামনেই খদ্দেরের কাছে
পাঠানো হয়...! না না আমি বেঁচে থাকতে এমন হতে দেবো না। কিন্তু বেশ্যাবৃত্তির টাকায় শুধু নিজের পেটটা চলবে, বোনদের শিক্ষিত করা সম্ভব নয়। এক মাসি’কে
মনের কথা খুলে বললাম। উনি
বললেন যদি তোমার গর্ভ ভাড়া
দাও, তবে প্রচুর টাকা পাবে। আর, সে
টাকায় শিক্ষিত করার দায়িত্ব নিতে
পারবে। ভেবে দেখলাম, এই দেহ’তে
জন্ম-কর্ম যখন,
এই দেহ দিয়ে মানুষের সেবা করে যাব । আমার এই দুর্ভাগ্য দিয়ে আমার বোনদের সৌভাগ্যবতী করে তুলব । আর মেয়েদের
মুখে হাসি দেখবো ।
নববধু থেকে
বেশ্যা , বেশ্যা থেকে সরগেট মাদার ,আমার
জীবন ভেসে চলেছে । কিছু দিনের
মধ্যেই সই করে আমার গর্ভ সঞ্চার
করানো হ’ল । এক মাস, দুই মাস,চার
মাস, ধীরে ধীরে আমার তল পেটে একটা ধিকধিক করে স্পন্দন অনুভব করলাম। জীবনে প্রথম মা হব, কিন্তু অন্য
পথে ।
ঠিক নয়মাস পর আমার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখল, কিন্তু আমি সন্তানের মুখ দেখতে পেলাম না । আমার স্বপ্ন’কে
মেরে এক মায়ের মুখে প্রাণবন্ত হাসি দেখলাম
সদ্যজাত শিশুর বদলে দু’হাত ভ’রে
নিলাম অনেক টাকা। সেই টাকাও অন্যের হাতে লেখা একটি চিঠির সাথে আমি লোক মারফৎ মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলাম । চিঠিতে লিখলাম, মা’ শাখা,সিঁদুর,সন্তান নিয়ে তোমার মেয়ে আজ ভীষণ খুশী । তুমি এই টাকায় বোনদের শিক্ষিত করে তুলো, প্রনাম নিও...............ইতি
তোমার ময়না।