গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০১৪

অরুণ চট্টোপাধ্যায়

নায়ক

কৈশোরের কোন এক মুহূর্ত থেকে হাঁটতে শুরু করেছিলাম । হাঁটাটা শুরু হয়েছিল অভিনয়ের রাস্তা ধরে । কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না এ পথ । অজস্র আগাছা আর ইট পাটকেলে ভরা এই পথ ছিল যথেষ্ট বন্ধুর । যথেষ্ট বিপদ-সংকুল । এই বিপদ অবশ্য বাঘ-ভাল্লুকের নয়, এই বিপদ অভিনয়ের রাস্তা থেকে সরে যাবার ভয়ের ।
কোনও পরিচালক যদি হঠাৎ “কাট” বলে বসেন স্যুট করার মাঝে ? তাকান যদি আমার দিকে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ? আমার অদক্ষতা, অপারগতা আর অপেশাদারিতা যদি তাঁকে বিরক্ত করে থাকে ?
তারপর – তারপর যদি ঘাড় ধরে বের করে দেন ? “সুযোগের” এই চেনা রাস্তাটা হারিয়ে যদি এক অনিশ্চয়তার প্রশ্নচিহ্ন ঘাড়ে নিয়ে ঘুরতে হয় সারাটা জীবন ? শরীর হয়ত মরবে না । হাত-পা-চোখ ওয়ালা সক্ষমতা আমাকে দু মুঠো অন্ন হয়ত জুটিয়ে যাবে সারা জীবন ধরে । কিন্তু মন ? তাকে খেতে দেবে কে ? তার প্রসন্নতা তার পরিপূর্ণতা আসবে কোন মহামন্ত্রে । আর আমার স্বপ্ন পূরণ না হবার দুঃখ রাখব কোন ভাঁড়ারে ?

যাহোক, কোনও অসাফল্য আর অনিশ্চয়তার ছেঁড়া গামছা কোনোদিন আমায় কাঁধে বয়ে বেড়াতে হয় নি কখনও । লাভ এট ফার্স্ট সাইটের মতই সাকসেস এট ফার্স্ট চান্স । মানে প্রথম প্রচেষ্টাতেই সাফল্ল । স্যুটিং স্পট থেকে পাঁচতারা হোটেল, সভা-সমিতি সর্বত্র ঘুরেছি সফল নায়কের ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবী পড়ে, কাঁধে চেপেছে পুরস্কারে অলংকৃত শাল ।

আজ আমি এমন এক নায়ক যাকে জনসমাবেশে যেতে হয় নিরাপত্তারক্ষীর কড়া তত্ত্বাবধানে । ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও মেনে নিয়েছিলাম । আমার ভক্তদের সঙ্গে আমি খোলাখুলি মিশতে  পারছি না, তাদের সঙ্গে করমর্দন আলিঙ্গন এসব কিছুই করতে পারছি না । অথচ আমার বই এলে ওরাই হাউস ফুল করে । টিকিটের লাইনে মারামারি করে । সিনেমা পত্রিকায় আমার কাল্পনিক কেচ্ছা-কাহিনী না পড়লে ওদের পেটের ভাত হজম হয় না । রাতের ঘুম নিশ্ছিদ্র হয় না । কোনও টিভি চ্যানেলে আমার সাক্ষাতকারের দিন টি-আর-পি ওঠে চড়চড় করে । স্পনসরদের কমোডিটি বিক্রি হয় না, জাস্ট নিঃশেষ হয়ে যায় । সন্ধ্যায় মোড়ের দোকানে ভাজা চপের মত যেন ফুস করে ফুরিয়ে যায় ।

এমন জনপ্রিয়তাকে আমি একটা নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র বেড়াজালে আটকে রাখব ? বিবেক দংশন করে করে আমাকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে । শেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই । জনতার সঙ্গে মিশতেই হবে । ওরাই তো আমার সফলতার সিংহাসনের পায়া, লেগ রেস্ট, ব্যাক রেস্ট সবকিছু ।

নিরাপত্তা রক্ষীকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিই । একজনের সঙ্গে করমর্দন, তার উষ্ণতা আমার হৃদয় স্পর্শ করল । আবেগ আমাকে টেনে নিয়ে গেল বিশাল সেই জনসমুদ্রে । আমার আবেগ স্পর্শ করল আমার ভক্তদের আবেগকে আর মুহূর্তে আবেগের ঘটল অনুরনন । আর সেই অনুরননের ধাক্কায় আবেগে মুহূর্তে ছুঁয়ে ফেলল যেন আকাশটা ।

একজন আমায় কামড়ে দিল (বোধহয় চুমু খেতে চেয়েছিল), একজন আঁচড়ে । তারপর কজন মিলে আমায় নিয়ে লোফালুফি খেলতে লাগল । তাদেরই মত আমি যে রক্তমাংসের একজন মানুষ এ কথা তারা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে থাকবে হয়ত । তারা হয়ত আমাকে একটা পিং পং বল বা টেনিস বল বা বাস্কেট বল বা ঐ জাতীয় কিছু ভেবে থাকতে পারে । 


কি তারা ভেবেছিল ভাবতে চেষ্টা করছি । নার্সিং হোমের বেডে সারা শরীরে ব্যাথা আর ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে শুয়ে ।