কৈশোরের
কোন এক মুহূর্ত থেকে হাঁটতে শুরু করেছিলাম । হাঁটাটা শুরু হয়েছিল অভিনয়ের রাস্তা
ধরে । কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না এ পথ । অজস্র আগাছা আর ইট পাটকেলে ভরা এই পথ ছিল
যথেষ্ট বন্ধুর । যথেষ্ট বিপদ-সংকুল । এই বিপদ অবশ্য বাঘ-ভাল্লুকের নয়, এই বিপদ
অভিনয়ের রাস্তা থেকে সরে যাবার ভয়ের ।
কোনও
পরিচালক যদি হঠাৎ “কাট” বলে বসেন স্যুট করার মাঝে ? তাকান যদি আমার দিকে সন্দেহ আর
অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ? আমার অদক্ষতা, অপারগতা আর অপেশাদারিতা যদি তাঁকে বিরক্ত করে
থাকে ?
তারপর –
তারপর যদি ঘাড় ধরে বের করে দেন ? “সুযোগের” এই চেনা রাস্তাটা হারিয়ে যদি এক
অনিশ্চয়তার প্রশ্নচিহ্ন ঘাড়ে নিয়ে ঘুরতে হয় সারাটা জীবন ? শরীর হয়ত মরবে না ।
হাত-পা-চোখ ওয়ালা সক্ষমতা আমাকে দু মুঠো অন্ন হয়ত জুটিয়ে যাবে সারা জীবন ধরে ।
কিন্তু মন ? তাকে খেতে দেবে কে ? তার প্রসন্নতা তার পরিপূর্ণতা আসবে কোন
মহামন্ত্রে । আর আমার স্বপ্ন পূরণ না হবার দুঃখ রাখব কোন ভাঁড়ারে ?
যাহোক,
কোনও অসাফল্য আর অনিশ্চয়তার ছেঁড়া গামছা কোনোদিন আমায় কাঁধে বয়ে বেড়াতে হয় নি কখনও
। লাভ এট ফার্স্ট সাইটের মতই সাকসেস এট ফার্স্ট চান্স । মানে প্রথম প্রচেষ্টাতেই
সাফল্ল । স্যুটিং স্পট থেকে পাঁচতারা হোটেল, সভা-সমিতি সর্বত্র ঘুরেছি সফল নায়কের
ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবী পড়ে, কাঁধে চেপেছে পুরস্কারে অলংকৃত শাল ।
আজ আমি
এমন এক নায়ক যাকে জনসমাবেশে যেতে হয় নিরাপত্তারক্ষীর কড়া তত্ত্বাবধানে । ব্যাপারটা
পছন্দ না হলেও মেনে নিয়েছিলাম । আমার ভক্তদের সঙ্গে আমি খোলাখুলি মিশতে পারছি না, তাদের সঙ্গে করমর্দন আলিঙ্গন এসব
কিছুই করতে পারছি না । অথচ আমার বই এলে ওরাই হাউস ফুল করে । টিকিটের লাইনে
মারামারি করে । সিনেমা পত্রিকায় আমার কাল্পনিক কেচ্ছা-কাহিনী না পড়লে ওদের পেটের
ভাত হজম হয় না । রাতের ঘুম নিশ্ছিদ্র হয় না । কোনও টিভি চ্যানেলে আমার
সাক্ষাতকারের দিন টি-আর-পি ওঠে চড়চড় করে । স্পনসরদের কমোডিটি বিক্রি হয় না, জাস্ট
নিঃশেষ হয়ে যায় । সন্ধ্যায় মোড়ের দোকানে ভাজা চপের মত যেন ফুস করে ফুরিয়ে যায় ।
এমন
জনপ্রিয়তাকে আমি একটা নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র বেড়াজালে আটকে রাখব ? বিবেক দংশন করে
করে আমাকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে । শেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই । জনতার সঙ্গে মিশতেই
হবে । ওরাই তো আমার সফলতার সিংহাসনের পায়া, লেগ রেস্ট, ব্যাক রেস্ট সবকিছু ।
নিরাপত্তা
রক্ষীকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিই । একজনের সঙ্গে করমর্দন, তার উষ্ণতা আমার
হৃদয় স্পর্শ করল । আবেগ আমাকে টেনে নিয়ে গেল বিশাল সেই জনসমুদ্রে । আমার আবেগ
স্পর্শ করল আমার ভক্তদের আবেগকে আর মুহূর্তে আবেগের ঘটল অনুরনন । আর সেই অনুরননের
ধাক্কায় আবেগে মুহূর্তে ছুঁয়ে ফেলল যেন আকাশটা ।
একজন
আমায় কামড়ে দিল (বোধহয় চুমু খেতে চেয়েছিল), একজন আঁচড়ে । তারপর কজন মিলে আমায় নিয়ে
লোফালুফি খেলতে লাগল । তাদেরই মত আমি যে রক্তমাংসের একজন মানুষ এ কথা তারা
সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে থাকবে হয়ত । তারা হয়ত আমাকে একটা পিং পং বল বা টেনিস বল বা
বাস্কেট বল বা ঐ জাতীয় কিছু ভেবে থাকতে পারে ।
কি
তারা ভেবেছিল ভাবতে চেষ্টা করছি । নার্সিং হোমের বেডে সারা শরীরে ব্যাথা আর
ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে শুয়ে ।